[২০ রবীউল আউয়াল, ১৪৪৭ হি. মোতাবেক ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ পবিত্র হারামে মাক্কীর (কা‘বা) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খ মাহের বিন হামাদ আল-মুআইক্বলী হাফিযাহুল্লাহ।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি সুউচ্চ ও সুমহান এবং যিনি তাঁর বান্দাদের কথা ও কাজে সত্যবাদী হওয়ার দিকে আহ্বান করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। তাঁর মহিমা সুমহান, তাঁর নামসমূহ পবিত্র, তাঁর মর্যাদা অতুলনীয় এবং তাঁর গুণাবলি সুউচ্চ।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি সর্বোত্তম গুণাবলির অধিকারী এবং প্রজ্ঞা ও অল্প কথায় ব্যাপক অর্থ প্রকাশের বরকতময় গুণে ভূষিত। মহান আল্লাহ তাঁর উপর দরূদ, সালাম ও বরকত বর্ষণ করুন এবং তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবী ও ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁর অনুসারীদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
অতঃপর, হে ঈমানদারগণ! আমি নিজেকে ও আপনাদেরকে আল্লাহভীতির অছিয়ত করছি। যে আল্লাহকে ভয় করে, তার মনোযোগ আখেরাতের দিকে নিবদ্ধ হয় এবং যার লক্ষ্য হয় আখেরাত, আল্লাহ তার অন্তরে পরিতৃপ্তি দান করেন, তার এলোমেলো অবস্থাকে গুছিয়ে দেন আর দুনিয়া তার কাছে অনীহার জায়গা হিসাবে ধরা দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। আর তাকে রিযিক্ব দিবেন (এমন উৎস) থেকে যা সে ধারণাও করতে পারে না’ (আত-তালাক, ৬৫/২-৩)।
হে মুসলিম উম্মাহ! ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তার ‘আছ-ছহীহ’ গ্রন্থে কা‘ব ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কা‘ব ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি যখন জানতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় ফিরে আসছেন, তখন আমি চিন্তিত হয়ে গেলাম এবং মিথ্যা অজুহাত খুঁজতে থাকলাম। মনে মনে স্থির করলাম, আগামীকাল এমন কথা বলব যাতে করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্রোধকে ঠান্ডা করতে পারি। আর এ সম্পর্কে আমার পরিবারের জ্ঞানীগুণীদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে থাকলাম। এরপর যখন প্রচারিত হলো যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন আমার অন্তর থেকে মিথ্যা দূর হয়ে গেল আর মনে দৃঢ় প্রত্যয় হলো যে, এমন কোনো উপায়ে আমি তাঁকে কখনো ক্রোধমুক্ত করতে সক্ষম হব না, যাতে মিথ্যার লেশ থাকে। অতএব, আমি মনে মনে স্থির করলাম যে, আমি সত্য কথা-ই বলব। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকালবেলায় মদীনায় প্রবেশ করলেন। তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দুই রাকআত ছালাত আদায় করতেন, তারপর লোকদের সামনে বসতেন। কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে হাযির হলাম। আমি যখন তাঁকে সালাম দিলাম, তখন তিনি রাগান্বিত চেহারায় মুচকি হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, ‘এসো’। আমি সে মতে এগিয়ে গিয়ে একেবারে তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কারণে তুমি অংশগ্রহণ করলে না? তুমি কি যানবাহন ক্রয় করনি?’ তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, করেছি। আল্লাহর কসম! এ কথা সুনিশ্চিত যে, আমি যদি আপনি ব্যতীত দুনিয়াদার অন্য কোনো ব্যক্তির সামনে বসতাম, তাহলে আমি তার অসন্তুষ্টিকে ওযর-আপত্তি পেশের মাধ্যমে ঠান্ডা করার চেষ্টা করতাম আর আমি তর্কে পটু। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি পরিজ্ঞাত যে, আজ যদি আমি আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলে আমার প্রতি আপনাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করি, তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তাআলা আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দিতে পারেন। আর যদি আপনার কাছে সত্য প্রকাশ করি, যাতে আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তবুও আমি এতে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার অবশ্যই আশা করি। না, আল্লাহর কসম! আমার কোনো ওযর ছিল না। আল্লাহর কসম! সেই যুদ্ধে আপনার সঙ্গে না যাওয়ার সময় আমি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে সত্য কথা-ই বলেছে। তুমি এখন চলে যাও, যতদিন না তোমার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ফয়সালা করে দেন’। এরপর যখন আল্লাহ কা‘ব ইবনু মালেক ও তার দুই সঙ্গীর ব্যাপারে ফয়সালা করে দিলেন এবং তাদের ব্যাপার শেষ করলেন তওবার মাধ্যমে। তখন কা‘ব নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলেন আর তিনি মসজিদে ছিলেন। কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এরপর আমি যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাম জানালাম, তখন তাঁর চেহারা আনন্দের আতিশয্যে ঝকঝক করছিল। তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার মাতা তোমাকে জন্মদানের দিন হতে যতদিন তোমার উপর অতিবাহিত হয়েছে তার মধ্যে উৎকৃষ্ট ও উত্তম দিনের সুসংবাদ গ্রহণ করো’। কা‘ব বলেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এটা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে’। আর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুশি হতেন, তখন তাঁর চেহারা এত উজ্জ্বল ও ঝলমলে হতো যেন পূর্ণিমার চাঁদের ফালি, এতে আমরা তাঁর সন্তুষ্টি বুঝতে পারতাম। আমি যখন তাঁর সম্মুখে বসলাম, তখন আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহ তাআলা সত্য বলার কারণে আমাকে রক্ষা করেছেন, তাই আমার তওবা কবুলের নিদর্শন ঠিক রাখতে আমার বাকি জীবনে সত্য-ই বলব। আল্লাহর কসম! যখন থেকে আমি এ সত্য বলার কথা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানিয়েছি, তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার জানা মতে কোনো মুসলিমকে সত্য কথার বিনিময়ে এরূপ নেয়ামত আল্লাহ দান করেননি, যে নেয়ামত আমাকে দান করেছেন। (কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন) যেদিন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে সত্য কথা বলেছি সেদিন হতে আজ পর্যন্ত অন্তরে মিথ্যা বলার ইচ্ছাও করিনি। আমি আশা পোষণ করি যে, বাকি জীবনও আল্লাহ তাআলা আমাকে মিথ্যা থেকে রক্ষা করবেন। এরপর আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর এই আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ নবী, মুহাজির ও আনছারদের তওবা কবুল করলেন’ (আত-তাওবা, ৯/১১৭)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো’ (আত-তাওবা, ৯/১১৯)। (কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন) আল্লাহর শপথ! ইসলাম গ্রহণের পর থেকে কখনো আমার উপর এত উৎকৃষ্ট নেয়ামত আল্লাহ প্রদান করেননি যা আমার কাছে শ্রেষ্ঠতর, তা হলো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আমার সত্য বলা এবং তাঁর সঙ্গে মিথ্যা না বলা; যদি মিথ্যা বলতাম, তবে মিথ্যাচারীদের মতো আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম।[1]
অতঃপর আল্লাহ তাআলা কা‘ব ইবনু মালেক ও সকল ছাহাবী n-এর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর আমরা তাদের সাথে একত্রিত হব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় মুত্তাক্বীরা থাকবে বাগ-বাগিচা ও ঝরনাধারার মধ্যে, যথাযোগ্য আসনে, সর্বশক্তিমান মহান অধিপতির নিকটে’ (আল-ক্বামার, ৫৪/৫৪-৫৫)।
হে মুমিনগণ! সত্যবাদিতা সকল অবস্থায় একজন মুমিনের পরিচায়ক এবং এটা তার কথাবার্তায়, কাজে ও আচরণে পোশাকের মতো। সত্যবাদিতা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, তার স্বভাবের গভীরে প্রোথিত, এমনকি সত্যবাদিতা তার সহজাত চরিত্রে পরিণত হয় যা কখনোই তার থেকে পৃথক হয় না। তাই সে নিজেকে বিচার-বিবেচনা ও প্রমাণহীন কোনো কথা বলার সুযোগ দেয় না এবং মিথ্যা ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তও দেয় না। বরং সে সত্যকে অনুসন্ধান করে, সেটাকে কামনা করে এবং তার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, অবশেষে আল্লাহর কাছে তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ তথা সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ মর্যাদা হলো নবুঅত ও শহীদী মর্যাদার মধ্যবর্তী এক মহান ও সুউচ্চ মর্যাদা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, ছিদ্দীক্ব, শহীদ ও নেককার লোকদের সঙ্গী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, তারা কতই না উত্তম সঙ্গী!’ (আন-নিসা, ৪/৬৯)।
ছহীহ মুসলিমের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সত্যকে ধারণ করা তোমাদের একান্ত কর্তব্য। কেননা সততা নেক কর্মের দিকে পথপ্রদর্শন করে আর নেক কর্ম জান্নাতের দিকে পথপ্রদর্শন করে। কোনো ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সত্য বলার চেষ্টায় রত থাকলে, অবশেষে আল্লাহর নিকটে সে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়’।[2]
অতএব, সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর প্রতি সত্যবাদী হলো, ফলে আল্লাহও তাকে সত্যায়িত করলেন। সুসংবাদ তার জন্য, যে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সত্যবাদী হলো, ফলে আল্লাহও তাকে সম্মানিত করলেন। আরও সুসংবাদ তার জন্য, যে সত্যবাদীদের পথে দৃঢ় রইল, অবশেষে আল্লাহও তাকে (এই অবস্থায়) মৃত্যু দিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের মধ্যে কতক লোক আল্লাহর সঙ্গে কৃত তাদের অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে। তাদের কতক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে (শাহাদাত বরণ) করেছে আর তাদের কতক অপেক্ষায় আছে। তারা (তাদের সংকল্প) কখনো তিল পরিমাণ পরিবর্তন করেনি’ (আল-আহযাব, ৩৩/২৩)।
أقولُ ما تسمعون، وأستغفرُ اللهَ لي ولكم من كل ذنبٍ وخطيئةٍ، فاستغفِروه؛ إنه كان غفَّارًا.
দ্বিতীয়খুৎবা
সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। তিনি সত্য-ই বলেন আর তিনি সর্বোত্তম ফয়সালাকারী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্যিকারের উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তিনিই একমাত্র মহান রাজাধিরাজ ও সত্যিকারের উপাস্য। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি ছিলেন সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত। আল্লাহ তাঁর উপর দরূদ ও বরকত বর্ষণ করুন আর তাঁর পবিত্র পরিবারবর্গ, ছাহাবী এবং যারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করবে তাদের উপরও শান্তি ও বরকত অবতীর্ণ হোক।
অতঃপর, হে মুমিনগণ! সত্যবাদিতা একটি মহান চরিত্র। মহান আল্লাহ স্বীয় কিতাবে সুস্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে নিজেকে সত্যবাদিতার গুণে প্রশংসিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি ক্বিয়ামত দিবসে সকলকে একত্রিত করবেন-ই, এতে কোনো সন্দেহ নেই, আল্লাহ অপেক্ষা আর কার কথা অধিক সত্য হতে পারে?’ (আন-নিসা, ৪/৮৭)। তিনি আরও বলেন, ‘আর কথায় আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী কে?’ (আন-নিসা, ৪/১২২)। রাসূলগণকে যেসব গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে তার মধ্যে সত্যবাদিতা-ই সবচেয়ে মর্যাদাকর গুণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ করো এই কিতাবে ইবরাহীমকে। নিশ্চয় সে ছিল পরম সত্যবাদী নবী’ (মারইয়াম, ১৯/৪১)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর স্মরণ করো এই কিতাবে ইসমাঈলকে। সে ছিল সত্যিকারের ওয়াদা পালনকারী এবং সে ছিল রাসূল ও নবী (মারইয়াম, ১৯/৫৪)।
অতঃপর, আমাদের নবী ও নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবুঅত পূর্ববর্তী জীবনেও সৎ ও আমানতদার ছিলেন। এরপর তিনি সত্যসহ আগমন করেছেন, সত্য সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন এবং সত্যের উপর চলার আদেশ দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সবচেয়ে সত্যনিষ্ঠ প্রতিশ্রুতিদাতা এবং অঙ্গীকারকারী। তাঁর রব তাঁকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে সত্য দ্বারা শোভিত করেছেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন ভিতরে ও বাইরে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দিতে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর বলো, হে আমার রব! আমাকে প্রবেশ করাও উত্তমভাবে এবং বের করো উত্তমভাবে। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাকে সাহায্যকারী শক্তি দান করো’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৮০)।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরীআত হলো সত্যের শরীআত এবং তাঁর ছাহাবীগণ হলেন ছিদ্দীক্ব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং যে তা সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই হলো মুত্তাক্বী’ (আয-যুমার, ৩৯/৩৩)।
হে ঈমানদারগণ! মিথ্যার বিষয়টি যত বড় হয়, তার বিপদও তত ভয়াবহ হয় এবং তার শাস্তিও গুরুতর হয়। বিশেষত আজকের ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যমের উপস্থিতি এবং কোনো বিষয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার যুগে যেভাবে গুজব তৈরি আর প্রচার করা হয় তা সমাজ ও তার নিরাপত্তার ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অতএব, বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে সতর্ক থাকতে হবে যে, সে যেন শত্রুদের হাতের হাতিয়ার হয়ে না পড়ে এবং সে নিজের, তার সমাজের ও দেশের ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচাই-বাছাই করা ছাড়া খবর প্রচার করা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়’।[3] তাহলে (একবার ভাবুন তো) সেই ব্যক্তির অবস্থা কী হতে পারে, যে নিজেই গুজব ও মিথ্যা ছড়ায়? সে তো কঠোর শাস্তির ঝুঁকিতে পড়ে যায়। যেমনটি ছহীহ বুখারীতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বপ্নের বিবরণীতে এসেছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অতঃপর ঐ ব্যক্তি যার কাছে গিয়ে দেখলাম যে, তার মুখের এক ভাগ মাথার পিছন দিক পর্যন্ত, এমনিভাবে নাসারন্ধ্র ও চোখ মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলা হচ্ছিল সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে সকালে নিজ ঘর থেকে বের হয়ে এমন কোনো মিথ্যা বলে, যা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে’।[4]
আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর মিথ্যারোপ করা সবচেয়ে ভয়াবহ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে ক্বিয়ামতের দিন তুমি তাদের চেহারাগুলো কালো দেখতে পাবে। অহংকারীদের বাসস্থান জাহান্নামের মধ্যে নয় কি?’ (আয-যুমার, ৩৯/৬০)।
ছহীহ বুখারীর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার উপর মিথ্যারোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার আসন বানিয়ে নেয়’।[5]
অতএব, সাবধান! হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা সত্যবাদিতাকে নিজেদের প্রতীক ও বাহ্যিক আচরণের অলংকার হিসেবে গ্রহণ করুন। গোপনে ও প্রকাশ্যে সকল অবস্থায় সত্যকে আঁকড়ে ধরুন। আল্লাহ যেন আপনাদের অন্তরে তাক্বওয়া দান করেন এবং আপনাদের জীবন চলার পথে সঠিকতা ও দৃঢ়তা দান করেন। আর স্মরণ রাখুন! সত্যবাদিতা হলো ইখলাছের অংশ আর ক্বিয়ামতের দিনে কেবল সত্যবাদীরাই মুক্তি লাভ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ বলবেন, এটা হলো সেই দিন, যেদিন সত্যবাদীগণকে তাদের সততা উপকার করবে। তাদের জন্য আছে জান্নাতসমূহ, যার নিচে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এটাই মহাসাফল্য’ (আল-মায়েদা, ৫/১১৯)।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪১৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৯।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬০৭।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫১।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৪৭।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/১১০।
