[২০ছফর, ১৪৪৪ হি. মোতাবেক ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২। পবিত্র হারামে মাক্বীতে (কা‘বা) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খড. উসামা ইবনুআব্দুল্লাহ আল-খায়ইয়াত হাফিযাহুল্লাহ ।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচ-ডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। তিনি যাকে ইচ্ছা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের পথে চালিত করেন। আমি সেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রশংসা জ্ঞাপন করছি, যিনি স্নেহময় ও পরম দয়ালু। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আমাদের মহান নেতা ও নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনি সঠিক পথ প্রদর্শনকারী ও মহান চরিত্রের অধিকারী। হে আল্লাহ! আপনি আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ বর্ষণ করুন এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীদের উপরও শান্তি বর্ষণ করুন, যারা কল্যাণ ও গভীর মর্যাদার অধিকারী। আর তাদের উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত অগণিত শান্তির ধারা অবতীর্ণ করুন।
অতঃপর, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহকে ভয় করে চলুন। একমাত্র তাঁর নিকটেই অসীলা বা মধ্যস্ততা কামনা করুন এবং তাঁকেই ভয় করুন। অতঃপর যে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁরই অভিমুখী হয় তার জন্য রয়েছে সৌভাগ্য, আল্লাহ তাআলা তাকে নেয়ামত দেন এবং মনোনীত করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَآمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। তিনি নিজে অনুগ্রহের দ্বিগুণ অংশ তোমাদেরকে দিবেন, তোমাদেরকে দিবেন জ্যোতি, যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়’ (আল-হাদীদ, ৫৭/২৮)।
হে মুসলিম সম্প্রদায়! একমাত্র সৎকর্মশীল ও আমলকারীগণই প্রশংসার যোগ্য। মুজতাহিদগণের জন্যও রয়েছে গুণকীর্তন। নীতিমালা হবে কুরআনের আলোকে, হেদায়াত হবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেখানো পথে। যে পথে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ চলেছেন এবং যেই পথকে ন্যায়ের পথ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাক্বওয়াবান সৎকর্মশীলরাই একে আঁকড়ে ধরে থাকেন, যাদের অন্তর সকল প্রকার বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত এবং তাদের অন্তরগুলো তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা ও যাবতীয় বিদ্বেষ থেকে পবিত্র।
নিশ্চয়ই তারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের রবের কিতাব তেলাওয়াত করে, যাতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছাহাবীদের জন্য তাদের সুন্দর গুণাবলি ও সম্মানিত কাজের উত্তম প্রশংসাগাথা রয়েছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا﴾
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকূ ও সিজদারত দেখবেন। তাদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সিজদার চিহ্ন। তাওরাতে তাদের অবস্থা এরূপ এবং ইঞ্জীলে তাদের অবস্থা যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মযবূত হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, চাষিকে আনন্দে অভিভূত করে, যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন’ (আল-ফাতহ, ৪৮/২৯)।
একইভাবে কুরআনুল কারীমে এই উম্মতের প্রশংসাগাথার উল্লেখ পাওয়া যায়। কেননা তারাই হলো সর্বোত্তম জাতি, মানুষের জন্য অধিক উপকারী। যেহেতু তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আদেশ করেছেন তার আদেশ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে নিষেধ করে। আর তারা একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ﴾ ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে’ (আলে ইমরান, ৩/১১০)।
এছাড়া কুরআনুল কারীমের মধ্যে আনছার ছাহাবীদের প্রশংসাগাথার উল্লেখ পাওয়া যায়, তাদের ভাই মুহাজির ছাহাবীদের প্রতি হৃদ্যতা ও নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কাছে থাকা সবকিছু দ্বারা তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,﴿وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾ ‘যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে, মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (আল-হাশর, ৫৯/৯)।
যখন তারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর দিকে দৃষ্টি ফেরাল তখন সেখানে আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের প্রশংসায় অগণিত স্পষ্ট প্রমাণপঞ্জি পেল, যেখানে তাদের মহান স্বভাব ও সুন্দর বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করা হয়েছে।
স্বয়ং নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রযিয়াল্লাহু আনহু-এর দ্বীন গ্রহণে অগ্রগামিতা, উত্তম সাহসিকতা এবং আল্লাহর রাস্তায় তার সম্পদ খরচ করার গুণকীর্তন করেছেন। ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إنَّ أمَنَّ النَّاسِ عَلَيَّ في صُحْبَتِهِ ومَالِهِ أبو بَكْرٍ ‘নিজের সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে আমাকে যিনি সবচেয়ে বেশি ইহসান করেছেন তিনি হলেন আবূ বকর’।[1] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রযিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে বলেন,والذي نَفْسِي بيَدِهِ ما لَقِيَكَ الشَّيْطَانُ سَالِكًا فَجًّا قَطُّ، إلَّا سَلَكَ فَجًّا غيرَ فَجِّكَ ‘কসম ঐ সত্তার যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তুমি যে পথে গমন কর শয়তান কখনো সেই পথে চলে না বরং সে তোমার পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে’।[2]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনছার ছাহাবীদের প্রশংসা করেছেন, যা ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ স্বীয় ‘আছ-ছহীহা’-এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে হিজরত করানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত না হতো, তাহলে আমি আনছারদের মধ্যকারই একজন থাকতাম। যদি লোকজন কোনো উপত্যকা ও গিরিপথ দিয়ে চলে তা হলে আমি আনছারদের উপত্যকা ও গিরিপথ দিয়েই চলব। আনছারগণ হলো (নববী) দেহসংযুক্ত গেঞ্জি আর অন্যান্য লোক হলো উপরের জামা’।[3]
এছাড়া তিরমিযীতে ছহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন রযিয়াল্লাহু আনহুমা সম্পর্কে বলেন,الحسنُ والحسينُ سيِّدَا شبابِ أهلِ الجنةِ ‘হাসান ও হুসাইন জান্নাতের যুবকদের নেতা হবেন’।[4] রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে আব্দুল ক্বায়েস গোত্রের আশাজ্জ্ব আব্দুল ক্বায়েস গমন করলে তার প্রশংসা করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন,إن فيك خصلتين يحبهما الله: الحلم والأناة ‘তোমার দুটি বিশেষ গুণ রয়েছে, যা আল্লাহ পছন্দ করেন (তা হলো) সহিষ্ণুতা ও ধীর-স্থিরতা’।[5] এছাড়াও বিভিন্ন হাদীছের কিতাবের মানাকিব অধ্যায়গুলোতে এ ধরনের অনেক ঘটনা সংকলিত হয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, উক্ত কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক মানহাজ উম্মতের সালাফগণের উপর সর্বোচ্চ প্রভাব ফেলেছিল; যারা তাদের কাছে উত্তম কাজ ও উন্নত স্বভাবের জন্য যারা প্রশংসার যোগ্য তারা তাদের প্রশংসা করেছে। যেমন ইমাম সুফিয়ান ছাওরী ও আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুমাল্লাহ ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ হলেন তার সময়কালের সবচেয়ে বড় ফক্বীহ’। ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলেন, ‘আলেমদের কথা উল্লেখ করতে গেলে ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ ছিলেন আকাশের নক্ষত্র সমতুল্য, ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ হলেন সৃষ্টির উপর দলীলস্বরূপ’। ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ স্বীয় ছাত্র ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি বাগদাদ থেকে প্রস্থানের সময় আহমাদ ইবনু হাম্বলের চেয়ে অধিক উত্তম, তাক্বওয়াশীল, জ্ঞানী ও ফক্বীহ ব্যক্তি অন্য কাউকে ছেড়ে আসিনি’। আবার ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহ ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলেন, ‘যে ব্যক্তিই হাতে দোয়াত কলম নিয়েছে, তার প্রতিই ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ-এর অনুগ্রহ রয়েছে’। এছাড়া যখন ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ স্বীয় উস্তায ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-কে একটি হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার উদ্দেশ্যে হাদীছের ইল্লত বা দুর্বল হওয়ার কারণ স্পষ্ট করেছিলেন, তখন ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ তার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘হে উস্তাযের উস্তায! হে হাদীছের ঈলাল বিষয়ে মহান বিদ্বান! আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন’।
এটাই ছিল প্রত্যেক যুগে ও প্রত্যেক শহরের মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অবস্থা এবং আলেমদের রীতি যা ক্বিয়ামত অবধি চলতে থাকবে।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় সৎকর্মশীলদের গুণকীর্তনের মধ্যে অনেক হিকমাহ ও গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা রয়েছে। যেমন, প্রশংসার যোগ্য ব্যক্তির সুন্দর স্বভাব-চরিত্র ও প্রশংসিত কাজের দিকে দৃষ্টি ফেরানো। যে ব্যক্তি এসকল সুন্দর গুণের অধিকারী তাকে এর উপর অটল থাকার প্রতি উৎসাহ উদ্দীপনা দেওয়া। এসকল সুন্দর গুণের অধিকারী নয় এমন ব্যক্তিদের বীরত্বপূর্ণ কাজে উদ্বুদ্ধ করা ও দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে উৎসাহ দেওয়া। আদল বা ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কার্য সম্পাদন করা অর্থাৎ ব্যক্তি যেভাবে ভুলকারীর সমালোচনা করবেন সেভাবে সৎকর্মশীলদের জন্য তাদের সৎকর্মেরও প্রশংসা করবেন।
অতএব, সর্বোত্তম হলো প্রত্যেকে এসব উত্তম আচরণ গ্রহণ করবেন, এসব গুণাবলিতে নিজেকে অলংকৃত করবেন এবং এসব গুণাবলির উপরেই নিজ নিজ সন্তানসন্ততি, পরিবার এবং তার অধীনস্তদের অভ্যস্ত করাবেন। এ বিষয়গুলো আল্লাহ তাআলা যার জন্য সহজ করে দেন এবং তাওফীক্ব দেন তার জন্য এটি খুবই সহজ।
এটি একটি ‘কালেমা তায়্যেবাহ’ বা উত্তম কথা, যা দ্বারা ব্যক্তি নিজের ও তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে ছাদাক্বা আদায় করেন, যার প্রতিদান তাকে দেওয়া হবে। যেমন হাদীছে এসেছে, والكلمةُ الطيبةُ صدقةٌ ‘উত্তম কথাও ছাদাক্বা’।[6] আর সৎকর্মশীল ব্যক্তির জন্য দু‘আ অর্থাৎ সৎকর্মশীলের জন্য উত্তম প্রতিদানের দু‘আ। এটি একটি ইবাদত যা দাঈদের উপর বর্তায়। যেমন তিরমিযী ও ইবনু মাজাহতে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত ছহীহ হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الدعاء هو العبادة ‘দু‘আও একটি ইবাদত’।[7]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় মানুষ নিজেকে হিংসা থেকে দূরে রেখে উত্তমের স্তরে উন্নীত হওয়া এবং সকল মর্যাদাকর ও কল্যাণকর কাজে সালাফগণের অনুকরণ ব্যতীত অকৃজ্ঞতা, মূর্খতা, পরিবারের ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে না পারার মতো খারাপ চরিত্র থেকে মুক্ত হতে পারবে না।
এছাড়া উক্ত উত্তম চরিত্র ও গৌরবময় স্বভাবে নিজেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার মধ্যে আরও অগণিত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে যা এই উম্মতে মুহাম্মাদীর উজ্জ্বল রূপরেখাকে তুলে ধরে। যখন ব্যক্তি সৎকর্মশীলের ইহসানকে স্বীকার করবে, তার প্রশংসা করা হবে যেভাবে একজন ভুলকারীকে তার ভুলের জন্য সমালোচনা করা হয়। এটিই হলো আদল বা ন্যায়নিষ্ঠতার সাথে সকল সৃষ্টির সাথে আচরণ। এই নির্দেশনা দিয়েই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার করো, এটাই আল্লাহভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞাত’ (আল-মায়েদাহ, ৫/৮)।
আল্লাহ তাআলা আমাকে ও আপনাদেরকে তাঁর কিতাবের হেদায়াত থেকে এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ থেকে উপকৃত করুন।
দ্বিতীয়খুৎবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্তে, আমরা তার প্রশংসা করছি। তাঁর কাছে সাহায্য চাচ্ছি ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের নাফসের কুপ্রবৃত্তি ও আমলের ভুলভ্রান্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান, কেউ তাকে হেদায়াত দিতে পারে না। আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বূদ নেই, তিনি একক তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! অগণিত দরূদ ও শান্তি বর্ষণ করুন আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় সৎকর্মশীল ব্যক্তির প্রশংসার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি বর্জনীয়। কেননা ছহীহায়নে বর্ণিত হাদীছে এ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। ছহীহ আল-বুখারীর হাদীছে এসেছে, আবূ মূসা আশআরী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে অপর এক ব্যক্তির প্রশংসা করতে শুনে বললেন, ‘তোমরা তাকে ধ্বংস করে দিলে’ কিংবা (রাবীর সন্দেহ) বলেছেন, ‘তোমরা লোকটির মেরুদণ্ড ভেঙে ফেললে’।[8] ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, احثُوا في وجوه المدَّاحينَ التُّرابَ ‘তোমরা (মুখোমুখি) প্রশংসাকারীদের দেখলে তাদের মুখে ধুলা ছিটিয়ে দিয়ো’।[9]
সৎকর্মশীলদের উপর আবশ্যক হলো, তিনি তার রবের সন্তুষ্টি লাভ ও আমল কবুলের জন্য সর্বাত্মক মেহনত করবেন। তিনি প্রশংসার যোগ্য ব্যক্তির প্রশংসা করবেন এবং কখনোই সমালোচনাকারীর সমালোচনা করবেন না। যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ নিয়্যতে, সুন্দর বাসনার সাথে একমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য সৎআমল করবে, আল্লাহ তার প্রতিদানকে কখনই নষ্ট করবেন না।
অতএব, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহকে ভয় করে চলুন। আল্লাহর উত্তম সৃষ্টি মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ ও তাসলীম পাঠ করুন। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,﴿إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾ ‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্য রহমতের দু‘আ করো এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ করো’ (আল-আহযাব, ৩৩/৫৬)। অতঃপর সম্মানিত খত্বীব রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পাঠ করেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾ ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব’ (আল-আ‘রাফ, ৭/২৩)। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ﴾ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ইহকালে কল্যাণ দান করুন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং দোযখের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন’ (আল-বাক্বারা, ২/২০১)।
এরপর সম্মানিত খত্বীব রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার, চার খলীফা ও ছাহাবীদের উপর দরূদ এবং সালাম পাঠের পর নিজেদের ও সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য দু‘আ করে খুৎবা শেষ করেন।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৬৬।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৯৬।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩৩০।
[4]. তিরমিযী, হা/৩৭৩৮; ইবনু মাজাহ, হা/১১৮।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৯৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৯৬।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯৮৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০০৯।
[7]. আবূ দাঊদ, হা/১৪৭৯; তিরমিযী, হা/২৯৬৯।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৩০০১।
[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩০০২; আবূ দাঊদ, হা/৪৭২৯।