[২ যুলক্বা‘দাহ, ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ১০ মে, ২০২৪ পবিত্র হারামে মাক্কীর (কা‘বা) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খড. ছালেহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু হুমাইদ হাফিযাহুল্লাহ।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই, যিনি হেদায়াত প্রত্যাশীদের হেদায়াতদানকারী। যিনি তাঁর কাছে প্রার্থনাকারীর ডাকে সাড়াদানকারী। আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অফুরন্ত দানের জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আমাদের নবী ও মহান নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর দরূদ, সালাম ও বারাকাহ অবতীর্ণ করুন। তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবী ও তাঁর অনুসারীদের উপর অগণিত ধারায় ছালাত ও সালাম অবতীর্ণ করুন।
অতঃপর, হে মানুষ সকল! আমি নিজেকে ও আপনাদেরকে আল্লাহভীতির অছিয়ত করছি। আপনারা মহান আল্লাহকে ভয় করে চলুন। আল্লাহ আপনাদের প্রতি রহম করুন। জেনে রাখুন! নিশ্চয় মানুষের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে বুদ্ধিমান, যে দুনিয়া তাকে বর্জন করার পূর্বে সে নিজেই দুনিয়াকে বর্জন করেছে, মহান রবের সাথে সাক্ষাতের পূর্বেই তাঁর সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, কবরের অধিবাসী হওয়ার পূর্বেই তার জন্য পাথেয় সংগ্রহ করেছে এবং অনর্থক বিষয় পরিত্যাগ করেছে। আল্লাহ তার অন্তরকে (দ্বীনের জন্য) খুলে দিন এবং তার বক্ষকে প্রসারিত করে দিন! আর যার যত বিবেচনাবোধ থাকে সে তত কম হোঁচট খায়। বেশি বেশি অন্যের নিন্দা করা ও দোষ ধরার দ্বারা জীবন কখনোই সুন্দর হয় না। যে ব্যক্তি যত ঝগড়ায় লিপ্ত হয় সে তত অপরের নিন্দা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ - وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ ‘আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট; ফলে আপনার ও যার মধ্যে শক্ৰতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। আর এটি শুধু তারাই প্রাপ্ত হবে যারা ধৈর্যশীল। আর এর অধিকারী কেবল তারাই হবে যারা মহাভাগ্যবান’ (ফুছছিলাত, ৪১/৩৪-৩৫)।
হে মুসলিমগণ! মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব, সে বিচ্ছিন্নভাবে একাকী বাস করতে পারে না। বরং তারা পরস্পর সংঘবদ্ধভাবে বাস করতে পছন্দ করে। তারা সমাজের এর সাথে বন্ধুত্ব করে, ওর সাথে সঙ্গী হয়ে বাস করে, এর চাহিদা পূরণ করে, ওর জন্য কল্যাণকর কাজ করে, একে উপদেশ দেয় এবং এভাবে তারা একে অপরের জন্য প্রশংসনীয় কাজ করে থাকে।
হে আমার ভাই! যেহেতু মানুষকে সামাজিকভাবে বাস করতেই হয়, তাই সেখানে নৈতিক ও সামাজিক রীতিনীতি থাকা প্রয়োজন। সেখানে এমন মহৎ চরিত্রের মানুষ থাকা প্রয়োজন যারা সমাজের কল্যাণ সাধন করে এবং সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে। সমাজে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া মহৎ ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য। এটি এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা ব্যক্তির সুন্দর মন ও আত্মার পরিশুদ্ধতাকে নির্দেশ করে। এই উন্নত ও মহৎ চরিত্র কেবল সম্মানিত ব্যক্তিরাই ধারণ করে থাকে। যাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুন্দর ও কল্যাণকর কাজের জন্য মনোনীত করেছেন। যাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে মানুষকে সাহায্য ও সুখী করা। তারা এর বদলায় কোনো প্রতিদান বা কারো কৃতজ্ঞতা কামনা করে না। সৎকাজকে ধারণ করা ও অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়া এবং ইহসান বা দয়ার বিনিময়ে দয়া ফিরিয়ে দেওয়া একটি মহৎ চরিত্র। মহান আল্লাহ বলেন,وَأَحْسِنْ كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ ‘(মানুষের) কল্যাণ সাধন করো, যেমন আল্লাহ তোমার কল্যাণ করেছেন’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/৭৭)।
হে মুসলিমগণ! এ ব্যাপারে প্রথম ও সর্বোত্তম আদর্শের অধিকারী হলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার সমগ্র জীবনী সুন্দর এবং সুন্দর সংরক্ষণের জন্য। তিনি কাছের ও দূরের মুসলিম অথবা কাফের সকলের সাথে উত্তম আচরণ করতেন। মানুষের প্রতি সুন্দর আচরণ করা ছিল নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানিত ও বরকতময় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা বাড়িতে খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর প্রসঙ্গ তুলে তার ভূয়সী প্রশংসা করতেন। এভাবেই তিনি একদিন খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর কথা স্মরণ করে প্রশংসা করলে আমাকে ঈর্ষা পেয়ে বসল। আমি বললাম, তিনি তো ছিলেন একজন বৃদ্ধা মহিলা মাত্র, আল্লাহ আপনাকে তার চেয়েও উত্তম স্ত্রী দান করেছেন। এতে তাঁর অগ্রভাগের চুলগুলো রাগে কেঁপে উঠে। এরপর তিনি বলেন, ‘কখনোই না; আল্লাহর শপথ! তিনি তার চেয়ে উত্তম কাউকে আমার জীবনে আর পাঠাননি। খাদীজা আমার প্রতি ঈমান এনেছিল, যদিও মানুষেরা আমাকে অস্বীকার করেছিল। সে আমাকে সত্যায়ন করেছিল, যদিও মানুষেরা আমার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। যখন মানুষেরা আমাকে বঞ্চিত করেছিল, তখন সে আমাকে তার সম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছিল। আল্লাহ তার মাধ্যমে আমাকে সন্তান দান করেছেন, যেখানে অন্য নারীদের মাধ্যমে সন্তান লাভে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে’। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, তাই আমি মনে মনে বললাম, আমি আর কখনোই তাকে খারাপভাবে উল্লেখ করব না।[1] অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বকরি যবেহ করতেন তখন বলতেন, ‘এর গোশত খাদীজার বান্ধবীদের পাঠিয়ে দাও’।[2]
হাদীছে এসেছে, একজন বৃদ্ধা মহিলা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে আগমন করলেন যখন তিনি আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকটে অবস্থান করছিলেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি কে?’ বৃদ্ধা বললেন, আমি মাযানিয়্যাহ গোত্রের জাযযামাহ (অলস)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বরং আপনি মাযানিয়্যাহ গোত্রের হাসসানাহ (রূপসী)। সেদিনের পরে আপনি কেমন ছিলেন? বৃদ্ধা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার জন্য আমার পিতামাতা কুরবান হোক, ভালোই ছিলাম। অতঃপর সেই বৃদ্ধা মহিলা চলে গেলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি এই বৃদ্ধা মহিলাকে এভাবে অভ্যর্থনা জানালেন, কারণ কী? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এই বৃদ্ধা খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা বেঁচে থাকা অবস্থায় একবার আমাদের নিকটে এসেছিলেন আর নিশ্চয় আত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ঈমানের অংশ’।[3]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্দর জীবনাদর্শ ও মানুষের দয়া-অনুগ্রহ ভুলে না যাওয়ার বড় একটি প্রমাণ হলো যা আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মর্যাদার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আবূ বকর ছাড়া আর কারো যেকোনো ধরনের দয়া আমার উপর ছিল আমি তার প্রতিদান দিয়েছি। আমার উপর তার যে দয়া রয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে তার প্রতিদান দিবেন। আর আমাকে কারো সম্পদ এতটা উপকৃত করেনি, যতটা আবূ বকরের সম্পদ উপকৃত করেছে। আমি যদি কাউকে অন্তরঙ্গভাবে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবূ বকরকেই একনিষ্ঠ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। অবগত হও! তোমাদের এই সাথী আল্লাহ তাআলার অন্তরঙ্গ বন্ধু’।[4] একইভাবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনছারদের দয়া-অনুগ্রহ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যেভাবে তারা তাঁকে নিঃশর্ত সাহায্য করেছিল, আশ্রয় দিয়েছিল এবং তাঁর দাওয়াত ও বিজয়ের জন্য তারা মূল্যবান ত্যাগ স্বীকার করেছিল। এছাড়া তারা যে মুহাজির ভাইদের সাথে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিল, নিজেদের অর্থ দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সর্বোপরি নিজেদের উপর মুহাজিরদেরকে যে প্রাধান্য দিয়েছিল তার বদলায় আনছারদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে হিজরত করানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত না থাকত তাহলে আমি আনছারদের মধ্যকারই একজন থাকতাম। যদি লোকজন কোনো উপত্যকা ও গিরিপথ দিয়ে চলে, তাহলে আমি আনছারদের উপত্যকা ও গিরিপথ দিয়েই চলব। আনছারগণ হলো (নববী) ভিতরের পোশাক আর অন্যান্য লোক হলো উপরের পোশাক। আমার বিদায়ের পর অচিরেই তোমরা দেখতে পাবে অন্যদের অগ্রাধিকার। তখন ধৈর্যধারণ করবে (দ্বীনের উপর টিকে থাকবে) যে পর্যন্ত না তোমরা হাওযে কাউছারে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করো’।[5]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, সমবেত ছাহাবীদেরকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি আনছারগণের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখার জন্য তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি; কেননা তারাই আমার অতি আপনজন, তারাই আমার বিশ্বস্ত লোক। তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পরিপূর্ণভাবে পালন করেছে। তাদের যা প্রাপ্য তা তারা এখনো পায়নি। তাদের নেক লোকদের নেক আমলগুলো গ্রহণ করবে এবং তাদের ভুলত্রুটি মাফ করে দিবে’।[6] এভাবে রাসূলুল্লাহ তাদের সকল ছাহাবীর অনুগ্রহের প্রতিদান দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমার ছাহাবীদেরকে গালমন্দ করো না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ-মুদ-এর সমপরিমাণ ছওয়াব হবে না’।[7] এমনকি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের সদাচরণেরও উত্তম বিনিময় প্রদান করেছেন। তিনি বদরের যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে বলেছেন, ‘আজ মুতঈম ইবনু আদী যদি বেঁচে থাকতেন আর এসব অপবিত্র লোকদের সম্পর্কে যদি আমার নিকট সুপারিশ করতেন, তাহলে তার সম্মানে এদেরকে আমি (মুক্তিপণ ব্যতীতই) ছেড়ে দিতাম’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের ব্যাপারে এরূপ মন্তব্য করেন যে, ‘আজ যদি মুতঈম ইবনু আদী জীবিত থাকতেন এবং তিনি আমার নিকট এসব ঘৃণ্য কয়েদীদের ব্যাপারে সুপারিশ করতেন, তবে আমি তাদেরকে তার খাতিরে ছেড়ে দিতাম’।[8]
হে মুসলিমগণ! সকল প্রকার মানুষের জন্যই সদাচরণ করা ও পরস্পরের মধ্যে দয়া-অনুগ্রহ ভুলে না যাওয়া কর্তব্য। পিতামাতা, স্বামী-স্ত্রী, শিক্ষক এবং সকল শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রেই এমনটা হওয়া জরুরী।
অতঃপর পিতামাতা নিজেরা জাগ্রত থেকে সন্তানদেরকে ঘুম পাড়ায়। তারা নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকে, যাতে সন্তানরা পরিতৃপ্ত হতে পারে। তারা নিজেরা খাবার গ্রহণ না করে সন্তানদেরকে খাওয়ায়। এসকল ক্ষেত্রে তারা সন্তানের জন্য হাসিমুখে সবকিছু মেনে নেয়। অতএব, পিতামাতার দয়া-অনুগ্রহের বিনিময়ে তাদের প্রতি ইহসান করা, সদয় হওয়া ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে ফিরিয়ে দেওয়া কর্তব্য। এছাড়া তাদের প্রতি বিনয়ী হওয়া এবং তাদেরকে কষ্ট দেয় বা বিরক্ত করে এমন সমস্ত কিছু থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا - وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّي ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا ‘তোমার প্রতিপালক হুকুম জারি করেছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না আর পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন বা তাদের উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে বিরক্তি বা অবজ্ঞাসূচক কথা বলো না আর তাদেরকে ভর্ৎসনা করো না। তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। তাদের জন্য সদয়ভাবে নম্রতার বাহু প্রসারিত করে দাও আর বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালনপালন করেছেন’ (আল-ইসরা, ১৭/২৩-২৪)।
অতঃপর স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন হলো প্রশান্তি, আরাম-আয়েশ ও সুখ-শান্তির জীবন। কখনো দাম্পত্য জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় যা জীবনকে দুঃখ-কষ্টে নিমজ্জিত করে ও দুর্বিষহ করে তুলে এবং হঠাৎ করে স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে। এই সময়ে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনা ও সৌভাগ্য ধরে রাখার জন্য পরস্পরের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ স্বীকার করা জরুরী। প্রকৃত স্বামী সেই যে পরিশ্রম করে ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে চলে যাতে সংসারে সুখ-শান্তি বজায় থাকে। আর প্রকৃত স্ত্রী হলো সেই যে স্বামীর অবর্তমানে তার যাবতীয় বিষয়ের হেফাযত করে। তার সন্তানদের লালনপালন করে, সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং সর্বোপরি বাড়িতে সুখ-শান্তি ধরে রাখতে চেষ্টা করে। এভাবে যখন স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখে এবং অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তখন তাদেরকে সুখ-শান্তি ও সৌভাগ্য ছেয়ে ফেলে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَنْسَوُا الْفَضْلَ بَيْنَكُمْ ‘আর তোমরা পরস্পরের মধ্যে অনুগ্রহ ভুলে যেয়ো না’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩৭)।
একজন শিক্ষক তার সর্বস্তরের ছাত্রদের পাঠদান ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেন আর একজন শিক্ষককে কেবল ছাত্রদের উন্নতি ও অগ্রগতিই আনন্দিত করে। ছাত্রদের জন্য উস্তাযের অনুগ্রহ স্বীকার করা, তাকে সম্মান করা, তার জন্য দু‘আ করা, তাকে কষ্ট না দেওয়া ও তার প্রতি খারাপ আচরণ করা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।
ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমার উস্তায হাম্মাদ রাহিমাহুল্লাহ-এর মৃত্যুর পর থেকে প্রতি ছালাতে আমার পিতামাতার সাথে তার জন্যও ইস্তিগফার করেছি। আর অবশ্যই আমি যার কাছ থেকে ইলম অর্জন করেছি এবং যাকে ইলম শিক্ষা দিয়েছি উভয়ের জন্য ইস্তিগফার করি। আবূ ইউসুফ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, অবশ্যই আমার পিতামাতার পূর্বে আমি আমার উস্তায ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ-এর জন্য দু‘আ ও ইস্তিগফার করি।
অতঃপর অবশ্যই লোক দেখানো ও হেয় করা মনোভাব ছাড়াই সম্মান ও শিষ্টাচারের সাথে পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়া জরুরী। যখন আপনি কারো অনুগ্রহের বদলায় অনুগ্রহ করেন, তখন তা গোপন রাখুন। আর যদি কেউ আপনার অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেয়, তাহলে তা প্রচার করুন। একটি প্রবাদ রয়েছে, মানুষের অনুগ্রহ পাথরখণ্ডের উপর খোদাই করে লিখে রাখো আর মানুষের দেওয়া কষ্ট বালুরাশির উপর লিখে রাখো, যাতে অনুগ্রহের বাতাস কষ্টকে মিটিয়ে দেয়।
بارَك الله لي ولكم في القرآن العظيم...
দ্বিতীয়খুৎবা
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সমস্ত সৃষ্টিজগতের রিযেক্বের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং তিনি তাদের রিযিক্ব প্রদান করেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। মহান আল্লাহ আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল ছাহাবীর উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত অগণিত ধারায় দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন।
হে মুসলিমগণ! আপনারা সদাচরণের যোগ্য বা অযোগ্য সকলের প্রতি সদাচরণ বজায় রাখুন। যদি সে প্রকৃতই সদাচরণের যোগ্য হয়, তাহলে সে তার হক্বদার ছিল। আর যদি সে সদাচরণের যোগ্য না হয়ে থাকে, তাহলে আপনি তার হক্বদার হবেন। যখন আপনি কারো উপকার করবেন, তখন তার ফিরতি উপকার পাওয়ার আশা করবেন না; বরং আপনি মানুষের উপকার করতেই থাকবেন। এটা আপনার উত্তম চরিত্রের পরিচায়ক।
[1]. আহমাদ, হা/২৪৯০৮; ত্ববারানী স্বীয় আল-আওসাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা হায়ছামী স্বীয় মাজমাউয যাওয়ায়েদ কিতাবে উক্ত হাদীছকে হাসান বলেছেন।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৩৫।
[3]. মুসতাদরাক হাকেম, হা/৪০।
[4]. তিরমিযী, হা/৩৬৬১।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩৩০।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৯৯।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৭৩।
[8]. আবূ দাঊদ, হা/২৬৯১।