কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

দুঃখ-দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায়

[১২ জুমাদাল আখের, ১৪৪ হি. মোতাবেক ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খআব্দুল্লাহআল-বুয়াইজান হাফিযাহুল্লাহউক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]

প্রথমখুৎবা

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি বান্দার হতাশা, দুঃখ-কষ্ট ও বিষণ্নতা লাঘবকারী এবং যিনি যন্ত্রণা ও উদ্বেগের অবসান ঘটান, সংকীর্ণতা ও বেদনা দূর করেন এবং সর্বোপরি যিনি শয়তান থেকে তাঁর কাছে আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দেন। আমরা আমাদের অন্তরের অনিষ্টতা ও মন্দ কর্ম থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তিনি যাকে হেদায়াত দেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্টকারী নেই আর যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোনো হেদায়াতদাতা নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবার ও ছাহাবীগণের উপর এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা তাঁর হেদায়াত ও সুন্নাহর পথে পরিচালিত হবে তাদের সকলের উপর দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন।

অতঃপর, নিশ্চয় আল্লাহর কিতাবই সর্বোত্তম বাণী এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শই সর্বোত্তম আদর্শ আর সর্বনিকৃষ্ট বিষয় হলো দ্বীনের মাঝে নব আবিষ্কার তথা বিদআত করা। বস্তুত প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা, যার পরিণাম জাহান্নাম।

আল্লাহর বান্দাগণ! আমি আপনাদেরকে তাক্বওয়া অবলম্বনের অছিয়ত করছি। কেননা এটাই পূর্বাপর সকলের প্রতি আল্লাহর অছিয়ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো’ (আন-নিসা, ৪/১৩১)

হে মানবমণ্ডলী! মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও অবস্থা সর্বদা পরিবর্তনশীল। কখনো মানুষের জীবন হাসি-আনন্দে ভরা থাকে, আবার কখনো তাকে দুঃখ-কষ্ট ও বেদনা ঘিরে ধরে। এই এখনই যদি সে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও নেয়ামতে ডুবে থাকে; আবার পরক্ষণেই তাকে সংকীর্ণতা, বঞ্চনা ও বিপদ ঘিরে ধরে। কখনো সে সুস্থতা, আরাম ও শান্তিতে বাস করে; আবার কখনো রোগ, অসুস্থতা ও যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। একারণেই মুমিনের উপর কল্যাণ ও নেয়ামত লাভের বিনিময়ে আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক। সে বিপদ ও দুর্যোগেও তাঁর প্রশংসা করবে এবং ধৈর্যধারণ করবে। বস্তুত, সর্বাবস্থায়ই আল্লাহর জন্য প্রশংসা। তাঁর জন্যই সমস্ত প্রশংসা, যা তিনি নির্ধারণ করেছেন এবং তাঁর প্রতি শুকরিয়া, যা তিনি দান করেছেন ও অনুগ্রহ করেছেন।

আল্লাহর বান্দাগণ! নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। আনাস ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়শই বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা, পেরেশানি, অপারগতা, অলসতা, কৃপণতা, কাপুরুষতা, ঋণের বোঝা এবং মানুষের আধিপত্য থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।[1]

হে মানুষ! এখানে আমি দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার আলোচনা করছি, কিন্তু আপনারা কি জানেন, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা কী? ‍দুশ্চিন্তা হলো দুঃখ-বেদনা ও অন্তরের সংকীর্ণতা, বিষণ্নতা, অস্থিরতা, স্নায়বিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সমষ্টি। একইসাথে এটি একাকিত্ব, হতাশা, নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা এবং শারীরিক ও মানসিক শক্তিহ্রাসের একটি প্রক্রিয়া মাত্র।

দুশ্চিন্তা বার্ধক্যের অর্ধেক। এটি রোগ-ব্যাধির কারণ এবং অলসতা, স্থবিরতা, দুর্বলতা, ব্যর্থতা ও হতাশারও কারণ। দুশ্চিন্তা এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধি, যা হতাশা, বিষণ্নতা, উত্তেজনা, আবেগপ্রবণতা, অস্থিরতা, অশান্তি ও বিভ্রমের কারণ। এজন্যই শয়তান চেষ্টা করে মুমিনকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করতে এবং তার দুঃখ-কষ্ট ও দুশ্চিন্তাকে উসকে দিতে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘গোপন পরামর্শ তো হলো মুমিনরা যাতে দুঃখ পায় সে উদ্দেশ্যে কৃত শয়তানের কুমন্ত্রণা মাত্র। আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া সে তাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। অতএব, আল্লাহরই ওপর মুমিনরা যেন তাওয়াক্কুল করে’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/১০)

শয়তান মানুষকে ফাঁদে ফেলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাকে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দেয়। যার ফলে তার হৃদয় সংকুচিত হয়ে যায়, সময় অপচয় হয়, চিন্তা-ভাবনাগুলো অগোছালো হয়, মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এর ফলে ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তার শক্তি ও সামর্থ্য ক্ষয় হতে থাকে। তার সুখ ও শান্তি হারিয়ে যায়, আশা ভঙ্গ হয়, সে অলসতার অন্ধকারে ডুবে যায়। সে কাজের প্রতি আগ্রহ হারায়, তার উদ্যম ও পরিশ্রমের ক্ষমতা নষ্ট হয় এবং তার মধ্যে উদ্বেগ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। দুশ্চিন্তার কারণে তাকে বিষণ্নতা, হতাশা, শূন্যতা ও অবসাদ আচ্ছন্ন করে ফেলে।

অতএব, হে আল্লাহর বান্দাগণ! এসব দুশ্চিন্তা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও সংকল্পের সাথে প্রতিহত করতে হবে। দুশ্চিন্তার কাছে কখনোই আত্মসমর্পণ করা যাবে না, একে লাগামহীন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় মহান আল্লাহ বান্দাদের মর্যাদা, সুখ্যাতি বা প্রতিদান বৃদ্ধির জন্য তাদের সুখ-দুঃখ এবং কষ্ট ও স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন। কেননা সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন নবীগণ, অতঃপর পর্যায়ক্রমে তাদের নিকটবর্তীগণ। সা‘দ ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন, ‘নবীদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা নেককার তাদের, এরপর যারা নেককার তাদের বিপদের পরীক্ষা। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের অনুপাত অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশি ধাৰ্মিক, তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে, তাহলে তাকে সে মোতাবেক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, বান্দার উপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে যমীনে চলাফেরা করে; অথচ তার কোনো গুনাহই থাকে না’।[2]

হে আল্লাহর বান্দাগণ! কখনো কখনো বান্দা পরীক্ষায় নিপতিত হয় তার অবাধ্যতা ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং তা থেকে দ্রুত তওবা না করার কারণে। যেমন- মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের প্রতি যে মুছীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন’ (আশ-শূরা, ৪২/৩০)। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন তার কোনো বান্দার কল্যাণ সাধন করতে চান, তখন তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে তাকে বিপদে পতিত করেন আর যখন তিনি তার কোনো বান্দার অকল্যাণ সাধন করতে চান, তখন তাকে তার অপরাধের শাস্তি প্রদান হতে বিরত থাকেন। তারপর ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাকে পুরোপুরি শাস্তি দেন’।[3]

আল্লাহর বান্দাগণ! তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্টি সৌভাগ্য ও বিপদমুক্তির উপলক্ষ্য; পক্ষান্তরে তাক্বদীরের প্রতি অসন্তুষ্টি দুর্ভাগ্য, বিপদ ও সংকীর্ণতার কারণ। কাজেই যে ব্যক্তি তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে আর যে তাক্বদীরের প্রতি অসন্তুষ্ট হবে, সে আল্লাহর ক্রোধে পতিত হবে। আনাস ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বিপদ যত মারাত্মক হবে, প্রতিদানও তত বড় হবে। আল্লাহ তাআলা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তাদেরকে (বিপদে ফেলে) পরীক্ষা করেন। যে লোক তাতে (বিপদে) সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য (আল্লাহ তাআলার) সন্তুষ্টি বিদ্যমান আর যে লোক তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য (আল্লাহ তাআলার) অসন্তুষ্টি বিদ্যমান’।[4]

মূলত তাক্বদীর বা ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্টি মানসিক সুখ-শান্তি, অন্তরের স্বস্তি এবং ‍হৃদয়ের প্রশস্ততা নিশ্চিত করে আর ভাগ্যের প্রতি অসন্তুষ্টি দুশ্চিন্তা, বিষাদ, বেদনা, উৎকণ্ঠা, অনিদ্রা এবং মানসিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আসলে দুশ্চিন্তা কখনো মুছীবত দূর করতে পারে না আর বিষণ্নতাও কখনো বিপদ ঘোচাতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। তারাই জান্নাতের অধিবাসী, তাতে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে, তারা যা আমল করত তার পুরস্কারস্বরূপ’ (আল-আহকাফ, ৪৬/১৩-১৪)

بارَك اللهُ لي ولكم في القرآن العظيم، ونفعني وإيَّاكم بما فيه...

দ্বিতীয়খুৎবা

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, তাঁর ইহসানের জন্য। তাঁরই শুকরিয়া আদায় করছি, তাঁর ভালো কাজের তাওফীক্ব দান ও অনুগ্রহের জন্য। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি ছিলেন তাঁর সন্তুষ্টির দিকে আহ্বানকারী। মহান আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবারবর্গ ও ছাহাবীদের উপর অগণিত দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন।

হে মানবসকল! অন্তরে স্বস্তি ও প্রফুল্লতা নিয়ে আসা এবং তা থেকে দুঃখ-কষ্ট, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার অন্যতম মাধ্যম হলো হেদায়াত ও ঈমান এবং আল্লাহর তাওহীদের বাস্তবায়ন করা, যিনি এক ও উত্তম প্রতিদানদাতা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ খুলে দিয়েছেন, ফলে সে তার রবের পক্ষ থেকে নূরের উপর রয়েছে, (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়?)। অতএব, ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে আল্লাহর স্মরণ থেকে। তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত’ (আয-যুমার, ৩৯/২২)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘সুতরাং যাকে আল্লাহ হেদায়াত করতে চান, ইসলামের জন্য তার বুক উন্মুক্ত করে দেন আর যাকে ভ্রষ্ট করতে চান, তার বুক সংকীর্ণ-সংকুচিত করে দেন, যেন সে আসমানে আরোহণ করছে। এমনিভাবে আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর, যারা ঈমান আনে না’ (আল-আনআম, ৬/১২৫)। মূলত, বান্দার ঈমান ও তাওহীদ যত বৃদ্ধি পাবে তার অন্তরের প্রফুল্লতাও তত বেশি হবে।

অন্তরে স্বস্তি ও প্রফুল্লতা নিয়ে আসা এবং তা থেকে সংকীর্ণতা, দুঃখ ও দুশ্চিন্তা দূর করার আরেকটি মাধ্যম হলো সর্বদা আল্লাহর যিকির করা এবং কুরআন তেলাওয়াত করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা আর মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত’ (ইউনুস, ১০/৫৭)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘জেনে রেখো! আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’ (আর-রাদ, ১৩/২৮)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে ক্বিয়ামত দিবসে উঠাব অন্ধ অবস্থায়’ (ত্ব-হা, ২০/১২৪)

অন্তরের প্রফুল্লতা নিয়ে আসা ও তা থেকে দুঃখ-কষ্ট, দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা দূর করার আরেকটি মাধ্যম হলো দু‘আ করা এবং আল্লাহর নিকট মুনাজাত করা। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো বান্দাকে যদি কোনো দুঃখ-কষ্ট বা দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে আর সে যদি বলে, হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার বান্দা, আপনার বান্দার ছেলে, আপনার বান্দির ছেলে, আমার ললাট আপনার হাতে, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালা চলমান, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালা ন্যায়সংগত, আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি আপনার প্রতিটি নামের বদৌলতে, যে নামে আপনি নিজেকে নামকরণ করেছেন অথবা যা আপনি আপনার কিতাবে অবতীর্ণ করেছেন অথবা যা আপনি আপনার সৃষ্টিজীবের কাউকে শিক্ষা দিয়েছেন অথবা যা আপনি ইলমুল গায়েবে নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রেখেছেন (আপনার এসকল নামের অছিলায় প্রার্থনা করছি যে), আপনি কুরআনকে আমার হৃদয়ের বসন্ত, আমার দৃষ্টির ‍নূর, আমার দুঃখ-কষ্টের অপসারণকারী ও আমার দুশ্চিন্তা দূরকারী বানিয়ে দিন। তবে আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা দূর করে দিবেন এবং তার দুঃখ-কষ্টকে খুশি দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন’। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাদের কি তা শিক্ষা করা উচিত? তিনি জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ, যে ব্যক্তি এগুলো শ্রবণ করবে, তার জন্য উচিত হবে তা শিক্ষা করা’।[5]

অন্তরের প্রফুল্লতা নিয়ে আসা এবং তা থেকে দুঃখ-দুর্দশা, দুশ্চিন্তা দূর করার আরেকটি মাধ্যম হলো আমলে ছালেহ করা। সদাচরণ করা, তাক্বওয়া অবলম্বন করা এবং মানুষের প্রতি কথা, কর্ম ও সকল ধরনের ভালো কাজের মাধ্যমে ইহসান করা আমলে ছালেহের অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ বান্দার দুঃখ-কষ্ট ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব’ (আন-নাহল, ১৬/৯৭)

অন্তরে প্রফুল্লতা ও স্বস্তি আনার আরেকটি মাধ্যম হলো অধিক পরিমাণে আল্লাহর জন্য সিজদা ও ইসতিগফার করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর অবশ্যই আমি জানি যে, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সংকুচিত হয়। সুতরাং তুমি তোমার রবের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করো এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদত করো’ (আল-হিজর, ১৫/৯৭-৯৯)

অতএব, হে ভাই! আপনাদের মধ্যে যাকে দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-দুর্দশা সংকুচিত করে ফেলেছে, দ্রুত তওবা ও ইসতিগফার করুন এবং প্রতাপশালী এক আল্লাহর যিকিরকে আঁকড়ে ধরুন।

হে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাই! অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করুন এবং বেশি বেশি তাসবীহ পাঠ ও কুরআন তেলাওয়াত করুন। হে বিষাদগ্রস্ত ভাই! আপনি আল্লাহর কাছে নত হোন, আপনার রবের অভিমুখী হোন, তাঁর কাছেই ফিরে যান, আপনার প্রভুর প্রতি ভরসা রাখুন, তাঁর নিকটেই সাহায্য প্রার্থনা করুন এবং তাঁর কাছেই দু‘আ করুন, শুধুই দু‘আ।


 [1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৯৩, ৬৩৬৩।

 [2]. তিরমিযী, হা/২৩৯৮।

 [3]. তিরমিযী, হা/২৩৯৬, হাদীছ ছহীহ।

 [4]. তিরমিযী, হা/২৩৯৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৩১, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে হাসান বলেছেন।

 [5]. আহমাদ, হা/৪৩১৮, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ ছহীহ বলেছেন; সিলসিলা ছহীহা, হা/১৯৯।

Magazine