[৮ রবীউল আখের, ১৪৪৬ হি. মোতাবেক ১১ অক্টোবর, ২০২৪ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খড. ছালাহ বিন মুহাম্মাদ আল-বুদাইর রাহিমাহুমুল্লাহ। উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি বিনয়ের অধিকারীদের জন্য ভালোবাসা ও সম্মান রেখেছেন এবং অহংকারীদের জন্য ঘৃণা ও অপমান নির্ধারণ করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। এমন সাক্ষ্য যা দ্বারা আমাদের ঈমান ও উপকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং ঐক্য ও সংহতি মজবুত হয়। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও সর্দার মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, যিনি তার আনুগত্যকে সুন্নাহর অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে আবশ্যক করে দিয়েছেন। তাঁর উপর, তাঁর পরিবার ও ছাহাবীদের উপর আল্লাহর এমন রহমত বর্ষিত হোক, যার আলো পাহাড়ের চূড়া ও উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর প্রতি অবারিত শান্তি বর্ষিত হোক, যতক্ষণ দৃষ্টিসমূহ আলো ও রশ্মি দেখে।
অতঃপর, হে মুসলিমগণ! আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন এমন ব্যক্তির ন্যায়, যে চিরস্থায়ী সুখের আবাসের আশা করে এবং অপমান ও ধ্বংসের আবাসকে ভয় পায়। মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যথাযথ ভয় আর তোমরা মুসলিম না হয়ে মারা যেয়ো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০২)। হে মুসলিমগণ! মহৎ চরিত্র, উচ্চ নৈতিকতা ও প্রশংসনীয় গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করা এবং অহংকার, আত্মগরিমা, বড়াই ও মানুষকে অবজ্ঞা করা থেকে বিরত থাকা।
বিনয় হলো কোমল মনোভাব, সুন্দর কথাবার্তা, মানুষের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করা এবং মুমিনদের প্রতি কোনো রকম ত্রুটি, অপমান বা হেয়জ্ঞান করা ছাড়াই অনুকম্পার বাহু প্রসারিত করা। আবূ হাতেম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, অহংকারের ন্যায় অন্যকিছু মানুষের ঘৃণা আনতে পারে না আর বিনয়ের ন্যায় অন্যকিছুর মাধ্যমে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায় না।
সর্বোত্তম মানুষ হলো সেই ব্যক্তি, যে সম্মানিত হয়েও নম্র থাকে, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে এবং প্রভাবশালী হয়েও ন্যায়পরায়ণ থাকে। সবচেয়ে খারাপ মানুষ হলো সেই ব্যক্তি, যে অহংকারী, দাম্ভিক, আত্মপ্রসারী, বড়াইকারী এবং নাক-মাথা উঁচু করে দম্ভভরে চলা ব্যক্তি; যাকে তার নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতা বিভ্রান্ত করে রেখেছে। তাই সে নিজের মর্যাদা ও অবস্থার গণ্ডি অতিক্রম করে এবং অন্যদের থেকে নিজেকে উঁচু ভাবতে থাকে। সে অন্যের অধিকারের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না এবং মনে করে যে, কেউ তার চেয়ে উপরে ও উচ্চতায় পৌঁছতে পারবে না। আসলে যখন আত্মমুগ্ধ অহংকারী ব্যক্তি কোনো মর্যাদা অর্জন করে বা পদে অধিষ্ঠিত হয় বা দায়িত্ব পায়, তখন সে অহংকার ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সেই স্থানটিকে হট্টগোল ও অশান্তিতে পরিপূর্ণ করে তোলে। সে ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষের মাধ্যমে এর পবিত্রতাকে কলুষিত করে এবং এর ঐক্য বিনষ্ট করে।
প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি নিজেকে মর্যাদার ক্ষেত্রে নিচু মনে করে, মানুষ তাকে তার মর্যাদার উপরে স্থান দেয় আর যে ব্যক্তি নিজের মর্যাদাকে সীমাতিরিক্ত তুলে ধরে, মানুষ তাকে নিচে নামিয়ে দেয়। ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সর্বোচ্চ মর্যাদাবান সেই ব্যক্তি যে অন্যের উপর নিজের মর্যাদাকে মেলে ধরে না এবং সবচেয়ে গুণী ব্যক্তি সেই, যে নিজেকে অন্যের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান মনে করে না।
মহান আল্লাহ বলেন,وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا ‘আর রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/৬৩)। ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বিনয় ও সম্মানের সাথে, কোনো গর্ব বা অহংকার ছাড়া। মহান আল্লাহ আরও বলেন,تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا في الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘এই হচ্ছে আখেরাতের নিবাস, যা আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা যমীনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/৮৩)।
ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মহান আল্লাহ এ মর্মে সংবাদ দিচ্ছেন যে, পরকালের আবাস এবং চিরস্থায়ী নেয়ামত, যা কখনো পরিবর্তন হবে না বা শেষ হবে না; তিনি তা তাঁর বিনয়ী মুমিন বান্দাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন, যারা পৃথিবীতে উদ্ধত আচরণ করে না তাদের জন্য। অর্থাৎ যারা আল্লাহর সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে না, তাদের উপর গর্ব করে না, তাদের উপর জবরদস্তি করে না এবং যারা মানুষের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করে না। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تَمْشِ في الْأَرْضِ مَرَحًا ‘আর যমীনে বড়াই করে চলো না’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৩৭)। ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এতে দাম্ভিকতার প্রতি নিষেধাজ্ঞা ও বিনয়ের প্রতি নির্দেশ রয়েছে।
মহান আল্লাহ সৎকর্মশীল উত্তম বান্দাদের গুণাবলি সম্পর্কে বলেন, أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ ‘তারা মুমিনদের উপর বিনম্র হবে’ (আল-মায়েদা, ৫/৫৪)। অর্থাৎ সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তারা হলেন মুমিনদের প্রতি নম্র, কোমল, বিনয়ী, সুহৃদ, দয়ার্দ্র ও দয়াশীল। ইয়ায বিন হিমার রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমার প্রতি অহী নাযিল করেছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও, তোমাদের কেউ কারো উপর যেন গর্ব না করে এবং কারো প্রতি যুলম না করে’।[1]
ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘বিনয় অহংকারের বিপরীত আর অহংকার হলো, অন্যের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ছাদাক্বা করাতে সম্পদের হ্রাস হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা সমুন্নত করে দেন’।[2] আয়েশা g বলেন, তোমরা তো একটি উত্তম ইবাদত থেকে উদাসীন থাক আর তা হলো বিনয়ী হওয়া।[3] ইয়াহইয়া ইবনে আবূ কাছীর বলেন, বিনয় প্রকাশের মূল হলো তিনটি বিষয়— ১. মজলিসের উচ্চাসনের চেয়ে নিম্নাসনে সন্তুষ্ট থাকবে, ২. যার সাথে সাক্ষাৎ হবে তাকে প্রথমে সালাম দিবে এবং ৩. কারো সাথে সদাচরণের কারণে প্রশংসা, সুখ্যাতি ও লৌকিকতাকে অপছন্দ করবে।
বিনয়ের উল্লেখযোগ্য চিত্র হলো বড়দেরকে শ্রদ্ধা করা, ছোটদের প্রতি দয়া করা, সমবয়সীদের সম্মান করা, সঙ্গীকে শ্রদ্ধা করা, অভাবী ও ভগ্নহৃদয়ের ব্যক্তির প্রতি সদয় আচরণ করা, মিসকীন ও দরিদ্রের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা, পথহারা ও জিজ্ঞাসুদের সঠিক পথ দেখানো এবং যারা জ্ঞানলাভ করতে চায় তাদের সঠিক নির্দেশনা দেওয়া।
হে মুসলিমগণ! আপনারা যাদের সাথে বাড়িতে বসবাস করেন তাদের প্রতি বিনয়ী হোন এবং তাদেরকে পাথেয় ও খাদ্যে শামিল করুন। আপনারা যাদের সাথে সকাল-সন্ধ্যায় একসাথে উঠাবসা করেন তাদের প্রতি বিনয়ী হোন এবং আপনারা পরিবার, সন্তান ও নারীদের প্রতি বিনয়ী হোন। আপনারা বিনয়ী হোন আপনাদের পিতা-মাতার প্রতি; যাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ আপনাকে বিনয়াবনত থাকতে, আপনার ভাষাকে নরম করতে, তাদের প্রতি আপনার বিনয়-নম্রতা ও সহানুভূতি প্রকাশ করতে, তাদের সামনে আপনার কণ্ঠস্বরকে নিচু করতে আদেশ দিয়েছেন। তাদের প্রতি ‘উহ্’ শব্দ বলা, বিরক্তি প্রকাশ করা, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আপনারা যার কাছে কিছু আবেদন করেন এবং তার থেকে উত্তর আশা করেন, তাদের প্রতি বিনয়ী হোন। আপনারা বিনয়ী হোন আলেম, উস্তায, শিক্ষক ও উপকারী ব্যক্তিদের প্রতি। আপনারা বিনয়ী হোন শিক্ষার্থীদের প্রতি। আপনারা যাদের সাথে কেনাবেচা, ঋণ আদান-প্রদান, লেনদেন, উঠাবসা ও বন্ধুত্ব করেন তাদের প্রতি বিনয়ী হোন।
বিনয় একটি নববী বৈশিষ্ট্য ও মুস্তাফা চরিত। মহান আল্লাহ বলেন, وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ ‘আর মুমিনদের জন্য তোমার (অনুকম্পার) বাহু অবনত করো’ (আল-হিজর, ১৫/৮৮)। অর্থাৎ আপনি আপনার পার্শ্বকে মুমিনদের জন্য নরম করুন, দরিদ্র মুসলিমদের প্রতি বিনয়ী হোন এবং দুর্বল ও মিসকীনদের প্রতি কোমল হোন।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উত্তম চরিত্র, বিনয় ও দয়ার্দ্রতার অন্যতম নিদর্শন হলো তিনি বাচ্চাদের নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে তাদেরকে সালাম দিতেন। তিনি মিসকীনদের সাথে উঠাবসা করতেন, বিধবা ও ইয়াতীমদের প্রয়োজন পূরণের জন্য যেতেন, এমনকি দাসী তাঁর হাত ধরে যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারত। জনৈকা মহিলা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূর! আপনার নিকট আমার একটু প্রয়োজন আছে। তখন তিনি তাকে বলেন, ‘হে অমুকের মা! তুমি তোমার ইচ্ছামতো কোনো গলির কোণায় গিয়ে বসো, আমি সেখানে গিয়ে তোমার কাছে বসব’। রাবী বলেন, সে মহিলা বসলে, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পাশে গিয়ে বসেন এবং তার প্রয়োজন পূরণ করেন।[4] তিনি নিজ পরিবারের খেদমত করতেন, নিজের জুতা ও কাপড় সেলাই করতেন, ছাগলের দুধ দোহন করতেন, নিজের কাজগুলো নিজেই সমাধা করতেন এবং কৃতদাসের যবের রুটির দাওয়াত পর্যন্ত গ্রহণ করতেন। তিনি বলতেন, ‘যদি আমাকে হালাল পশুর পায়া বা হাতা খেতে ডাকা হয়, তবুও তা আমি গ্রহণ করব আর যদি আমাকে পায়া বা হাতা হাদিয়া দেওয়া হয়, আমি তা গ্রহণ করব’।[5] তিনি ছিলেন অল্পে সন্তুষ্ট, কোমল চরিত্রের, উদার প্রকৃতির, সদাচরণকারী এবং সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল। তিনি বিনম্র ছিলেন, তবে নিজেকে কখনোই অপমানিত মনে করতেন না। তিনি উদার ছিলেন, কিন্তু কখনোই অপচয় করতেন না। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী, প্রতিটি মুসলিমের প্রতি সহানুভূতিশীল, ঈমানদারদের প্রতি বিনয়ী ও কোমল আচরণকারী। তিনি অসুস্থদের দেখতে যেতেন, জানাযায় অংশগ্রহণ করতেন, গাধার পিঠে আরোহণ করতেন। এমনকি তিনি আহযাবের যুদ্ধের দিনে ছাহাবীদের সঙ্গে খন্দক খননে অংশ নিয়েছিলেন, মাটি বহন করেছিলেন, এমনকি তার বাহুর নিচের সাদা অংশ মাটিতে ঢেকে গিয়েছিল এবং ক্ষুধার কারণে তিনি তাঁর পেটে পাথর বেঁধে রেখেছিলেন।
অতএব, আপনারা গর্ব, অহংকার, দম্ভ ও সম্পর্কহীনতা পরিহার করুন এবং কোমলতা, নম্রতা ও বিনয় অবলম্বন করুন। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হবে আল্লাহ তার প্রতিদান দেবেন, তার প্রতি অনুগ্রহ করবেন, তাকে সাহায্য করবেন এবং তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন। যে ব্যক্তি গর্ব, অহংকার, দাম্ভিকতা প্রকাশ করবে; আল্লাহ তাকে পরাভূত করবেন, জবরদস্তি করবেন, হেয় করবেন এবং সর্বোপরি তাকে ধ্বংস করে দিবেন।
أقول ما تسمعون وأستغفِر الله فاستغفِروه، ويا فوز المستغفرين...
দ্বিতীয় খুৎবা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর কোমলতায় আশ্রয় গ্রহণকারীকে আশ্রয় দেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তিনি স্বীয় অনুগ্রহের মাধ্যমে তাদের আরোগ্য দান করেন, যারা অসুস্থতার কারণে নিরাশ হয়ে পড়েছিল। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নবী ও সর্দার মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। যে তাকে অনুসরণ করে সে হেদায়েতের পথে থাকে আর যে তার অবাধ্য হয়, সে গোমরাহী ও ধ্বংসের মধ্যে থাকে। আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর উপর, তাঁর পরিবার ও ছাহাবীদের উপর।
অতঃপর হে মুসলিমগণ! আপনারা আল্লাহভীতি অবলম্বন করুন। আপনারা তাঁরই আনুগত্য করুন, কখনোই তার অবাধ্য হবেন না। মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো’ (আত-তাওবা, ৯/১১৯)।
হে মুসলিমগণ! বিনয়ের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তর রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর হলো আল্লাহর জন্য বিনয়ী হওয়া আর সর্বনিম্ন স্তর হলো অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বিনয়ী হওয়া। সর্বোচ্চ বিনয়ের নিদর্শন হলো আল্লাহর সম্মান ও মহত্ত্বের সামনে বান্দার বিনয়ী হওয়া এবং আল্লাহর মর্যাদা ও তাঁর অহংকারের নিকট বান্দার বিনয়াবনত হওয়া। অতএব, যখনই তার হৃদয় অহংকারী হবে, তখনই যেন সে মহান রবের মহত্ত্বকে স্মরণ করে। ফলে আল্লাহর জন্য তার হৃদয় বিনয়ী হয়, তাঁর বড়ত্বের সামনে তার অন্তর নত হয় এবং তাঁর ভীতি ও ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হয়, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাঁর ভালোবাসায় নত হয়, তাঁর ভয়ে বিনম্র হয়, তাঁর নিকট নতিস্বীকার করে; আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন এবং তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্রষ্টা ও মাওলার প্রতি বিনয়ী হওয়ার একটি নমুনা হলো, তিনি উম্মতকে তাঁর প্রশংসায় অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা আমাকে নিয়ে (আমার তা‘যীমে) বাড়াবাড়ি করো না, যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়ামকে নিয়ে করেছে। আমি তো আল্লাহর দাস মাত্র। অতএব, তোমরা আমাকে আল্লাহর দাস ও তাঁর রাসূলই বলো’।[6]
আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হওয়ার অন্তর্গত হলো, হক্বকে গ্রহণ করা ও সে অনুযায়ী আমল করা। ফুযাইল বিন ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ-কে বিনয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, সে হক্বের অনুগত হবে ও তা মেনে চলবে এবং যে হক্ব বলবে, তার নিকট হতে তা গ্রহণ করবে।
হে বিশ্বজগতের প্রতিপালক! আমাদের অসুস্থদের সুস্থতা দিন, বিপদগ্রস্তদের বিপদ থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাদের মৃতদের উপর রহম করুন- আমীন!
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৬৫।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৮।
[3]. আবূ দাঊদ, হা/৩২৪।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/৪৮১৮, আলবানী ছহীহ বলেছেন।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫৬৮।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৫।