[১৫যুলক্বা‘দা, ১৪৪২ হি. মোতাবেক ২৫ জুন, ২০২১। মদীনামুনাওয়ারারআল-মাসজিদুলহারামে (মসজিদেনববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-বাঈজান(হাফি.)।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহীর সম্মানিত সিনিয়র শিক্ষক ও ‘আল-ইতিছাম গবেষণা পর্ষদ’-এর গবেষণা সহকারী শায়খ মুরসালীন বিন আব্দুর রউফ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
প্রশংসা মাত্রই আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁরই গুণকীর্তণ ও সহযোগিতা কামনা করি এবং আশ্রয় চাই আমাদের অন্তরের অনিষ্ট হতে। তিনি যাকে সঠিক পথ দেখাতে চান তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তাকে কেউ সঠিক পথ দেখাতে পারে না। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি ছাড়া সত্যিকার কোনো মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। যিনি তাঁর রিসালাত ও আমানত যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন এবং মৃত্যু অবধি তিনি আল্লাহর রাস্তায় সাধ্যমতো জিহাদ করেছেন। দরূদ ও শান্তি বর্ষিত হোক তার পরিবার ও অনুসারীদের উপর কিয়ামতের পূর্বপর্যন্ত।
অতঃপর, নিশ্চয় সর্বোত্তম কথা হলো আল্লাহর বাণী ও হেদায়াতের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করা। কারণ প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহর বাণী,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করে চলো এবং প্রকৃত মুসলিম না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০২)।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলো। দীর্ঘ আশা ও মৃত্যুর কথা ভুলে যাওয়া যেন তোমাদের ধোঁকা দিতে না পারে। তোমরা দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে যেয়ো না, কেননা তা হলো অস্থায়ী ঠিকানা এবং পরীক্ষার জায়গা। আর আখেরাত হলো চিরস্থায়ী ও প্রতিদানের জায়গা। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন,كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
‘প্রত্যেক আত্মাই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। আর কিয়ামতের দিন তোমাদের প্রাপ্য পরিপূর্ণই দেওয়া হবে। অতএব, যাকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সেই মূলত সফলতা অর্জন করবে। আর দুনিয়ার জীবন কেবল ধোঁকাস্বরূপ’ (আলে ইমরান, ৩/১৮৫)।
হে মানুষ সকল! সময়ের গতিতে আবহাওয়া এক অবস্থা হতে আরেক অবস্থায় পরিবর্তন হচ্ছে ও দিন-রাতের পরিবর্তন ঘটছে এবং একের পর এক ঋতুসমূহের পালাবদল হচ্ছে। কখনও প্রচণ্ড ঠান্ডা, কখনও প্রচণ্ড গরম, কখনও আবার নাতিশীতোষ্ণ। এগুলো মূলত সবই আল্লাহর রহস্য। আর আল্লাহর নিকট এর সবকিছুর পরিমিত মাত্রা রয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টির মাঝে, রাত ও দিনের এই আবর্তনের মাঝে, সাগরে ভাসমান জাহাজসমূহে, যা মানুষের জন্য কল্যাণকর দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে (বৃষ্টি আকারে) যা কিছু নাযিল করেন (সেই বৃষ্টির) পানির মাঝে, ভূমির নির্জীব হওয়ার পর তিনিই পানি দ্বারা তাতে নতুন জীবন দান করেন, অতঃপর এখানে তিনি সব ধরনের প্রাণীর আবির্ভাব ঘটান, অবশ্যই বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি করার মাঝে এবং সেই মেঘমালা— যাকে আসমান-জমিনের মাঝে বশীভূত করে রাখা হয়েছে, তাতে সুস্থ বিবেকবান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৬৪)।
হে মুসলিমগণ! নিশ্চয় গ্রীষ্মের জ্বলন্ত তাপদাহ এবং প্রকৃতি ঝলসানো লু-হাওয়া অনেক বড় স্পষ্ট সতর্ককারী এবং আল্লাহর শাস্তি হতে কঠোর নছীহতকারী। যে জাহান্নামে রয়েছে প্রজ্বলিত আগুন, যার তীব্রতা অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আল্লাহর বাণী, إِنَّهَا لَظَى - نَزَّاعَةً لِلشَّوَى - تَدْعُو مَنْ أَدْبَرَ وَتَوَلَّى - وَجَمَعَ فَأَوْعَى ‘কক্ষনো নয়! নিশ্চয় জাহান্নাম হচ্ছে একটি প্রজ্বলিত আগুনের লেলিহান শিখা, যা চামড়া ও তার অভ্যন্তরীণ মাংসগুলোকে খসিয়ে দেবে। সেদিন সে আগুন এমন সব লোকদের ডাকবে, যারা (দুনিয়ার জীবনে তা থেকে) ফিরে গিয়েছিল এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল, (যারা বিপুল) ধনরাশি জমা করে তা আগলে রেখেছিল’ (আল-মাআরিজ, ৭০/১৫-১৮)। নিশ্চয় জাহান্নাম হচ্ছে লু-হাওয়া ও গরম পানি এবং আশ্রয়স্থলে থাকবে কালো ধোঁয়া, যেখানো কোনো শীতলতা বা আতিথেয়তা থাকবে না।
হে আল্লাহর বান্দা! নিশ্চয় গরমের প্রচণ্ড উত্তাপ হলো জাহান্নামের শ্বাসপ্রশ্বাস। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করে বলল, হে আমার রব! আমার কিছু অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলছে। এর ফলে আল্লাহ জাহান্নামকে দুটি নিঃশ্বাস ছাড়ার অনুমতি প্রদান করেন, যার একটি হলো শীতকালে আর অপরটি হলো গ্রীষ্মকালে। এর কারণেই তোমরা শীতকালের ঠান্ডা ও গ্রীষ্মকালের উত্তাপ অনুভব করে থাক’।[1]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা জাহান্নামের আগুন হতে নিজেদের রক্ষা করো যদিও একটি খেজুরের আঁটির ছিলকা দিয়ে হলেও। আল্লাহর কসম করে বলছি! দুনিয়ার আগুন সহ্য করার মতো কারো ক্ষমতা নেই তাহলে আখেরাতের আগুন কীভাবে সহ্য করবে? আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মানুষেরা যে আগুন জ্বালিয়ে থাক জাহান্নামের আগুনের তুলনায় তার ৭০ ভাগের মাত্র এক ভাগ উত্তাপ রয়েছে। ছাহাবীগণ বলল, আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়ার আগুনই তো যথেষ্ট হতো। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘জাহান্নামের আগুনকে দুনিয়ার আগুনের তুলনায় ৬৯ গুণ বেশি শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। আর প্রত্যেক গুণ দুনিয়ার আগুনের সমান’।[2]
আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় গ্রীষ্মকালের তাপদাহ কিয়ামতের মাঠের ভয়াবহ অবস্থা এবং মানুষকে যে তাদের রবের কাছে বিবস্ত্র, নগ্নপদ ও খাৎনাবিহীন অবস্থায় উঠানো হবে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,كَأَنَّهُمْ إِلَى نُصُبٍ يُوفِضُونَ - خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ ذَلِكَ الْيَوْمُ الَّذِي كَانُوا يُوعَدُونَ ‘তারা যেন কোনো শিকারের দিকে ছুটে চলেছে, তাদের দৃষ্টি থাকবে অবনমিত, অপমান ও লাঞ্ছনায় তাদের সবকিছু থাকবে আচ্ছন্ন; তাদের বলা হবে এটাই হচ্ছে সেই দিন, যার প্রতিশ্রুতি তাদের দেওয়া হয়েছিল’ (আল-মাআরিজ, ৭০/৪৩-৪৪)।
সেই কিয়ামতের দিন অবস্থা কঠিনতর হবে এবং বিপদ-আপদ, দুঃখকষ্ট প্রকটতর হবে এবং সূর্য সৃষ্টিকুলের মাথার নিকটবর্তী হয়ে যাবে, উত্তাপ প্রচণ্ড আকার ধারণ করবে, কঠিন ভিড় হবে, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। হাদীছে এসেছে, মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘কিয়ামতের মাঠে সূর্যকে সৃষ্টিকুলের এতটা নিকটবর্তী হবে যে, তার দূরত্ব হবে এক মাইল। ফলে সেই দিন মানুষ তাদের আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে ডুবে থাকবে। তাদের মধ্যে কারো টাখনু পর্যন্ত, আবার কারো হাঁটু পর্যন্ত, আবার কারো কোমর পর্যন্ত, আবার কেউ ঘামে হাবুডুবু খেতে থাকবে’।[3]
হে মুসলিম সম্প্রদায়! দুনিয়া এক অস্থায়ী নেয়ামত, যার ছায়া হলো ক্ষণস্থায়ী এবং সময় হলো অল্প কয় দিনের। আল্লাহ তাআলা বলেন, فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ ‘পার্থিব জীবন তোমাদের কোনো রকম প্রতারিত করতে না পারে এবং প্রতারক শয়তানও যেন কখনো তোমাদের আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে কোনো ধোঁকা দিতে না পারে’ (লুক্বমান, ৩৩/৩৩)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘এ পার্থিব জীবনের উদাহরণ (হচ্ছে) যেমন আমি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করলাম, তা দ্বারা অতঃপর জমিনের গাছপালা ঘন সন্নিবেশিত হয়ে উদগত হলো যা থেকে মানুষ ও জন্তু-জানোয়ার তাদের আহার সংগ্রহ করলে; এরপর যখন জমিন তার সৌন্দর্যের রূপ ধারণ করল এবং আপন সৌন্দর্যে সে শোভিত হয়ে উঠল, তখন তার মালিক মনে করলে, তারা বুঝি এর (ফসল ভোগ করার) উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান (এ সময় হঠাৎ করে) রাতে কিংবা দিনে আমার (আযাবের) ফয়সালা তাদের উপর আপতিত হলো, অতঃপর আমি তাদের এমনভাবে নির্মূল করে দিলাম যেন গতকাল তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না; চিন্তাশীল লোকদের জন্য এভাবেই আমি আমার আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি’ (ইউনুস, ১০/২৪)।
দ্বিতীয় খুৎবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি সাহায্যের সাহায্যদাতা, নিরুপায় ব্যক্তির ডাকে সাড়াদানকারী, বিপদগ্রস্তদের বিপদ উদ্ধারকারী এবং সকল মানুষের উপর তার নেয়ামতসমূহকে পরিপূর্ণকারী। আল্লাহর বাণী,وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ ‘জমিনের উপর বিচরণশীল এমন কোনো জীব নেই, যার রিযিক্বের দায়িত্ব আল্লাহর নয়, তিনি যেমন তার আবাস সম্পর্কে অবহিত, (তেমনি তার মৃত্যুর পর) তাকে যেখানে সোপর্দ করা হবে তাও (তিনি জানেন); এসব বিবরণ একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে’ (হূদ, ১১/৬)।
হে আল্লাহর বান্দা! গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড উত্তাপ ও প্রবল ঝড়ের মাঝে ধুলোবালি উড়ার মাধ্যমে যে দৃশ্য আমরা থাকি তা আমাদের একটি বিষয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তা হলো, দুর্বল ও অপারগদের কথা। তারা এতে ভীষণ কষ্ট পায়। তা থেকে বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পায় না। অতএব, তোমাদের কর্তব্য হলো তাদের প্রতি দয়া করা, তাদের প্রয়োজন মেটানো, তাদের সহযোগিতা করা এবং তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া। কেননা তাদের মাধ্যমেই তোমরা রহমত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাক। অতএব, তোমরা তাদের চিন্তা, দুর্দশা ও কাঠিন্য দূর করার চেষ্টা করো। কেননা যে ব্যক্তি কোনো মুমিন ব্যক্তির দুনিয়ার দুশ্চিন্তা দূর করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার হতেও দুশ্চিন্তা দূর করবেন। আর যে অসচ্ছল ব্যক্তির উপর সহজতা অবলম্বন করবে আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সচ্ছলতা দান করবেন, আর যে কোনো মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন করবে আল্লাহও তার দুনিয়া ও আখিরাতে দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ কোনো বান্দার প্রতি ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করে থাকেন যতক্ষণ সে অন্য ভাইয়ের প্রতি সহযোগিতা করে থাকে।
হে আল্লাহর বান্দা! তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ (ক্বরযে হাসানা) দাও তাহলে আল্লাহও এর বিনিময়ে তোমাদের সম্পদকে দ্বিগুণে পরিণত করবেন এবং সাথে তোমাদের গুনাহগুলোও ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ‘ক্বরযে হাসানা’ দিবে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার (সম্পদে) আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৪৫)। আল্লাহ তাআলা অপর আয়াতে বলেন, ‘তোমরা ভালো ও উত্তম কাজ হতে যা নিজেদের জন্য আগেভাগেই আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে রাখবে তা তোমরা তার কাছে সংরক্ষিত পাবে, পুরস্কার ও এর বর্ধিত পরিমাণ হিসাবে তা হবে অতি উত্তম’ (মুযযাম্মিল, ৭৩/২০)।
যে ব্যক্তি অসচ্ছলকে অবকাশ দিয়ে অথবা ঋণ কমিয়ে সহযোগিতা করবে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে কিয়ামতের মাঠে তার ছায়া প্রদান করে সম্মানিত করবেন। যেদিন তার ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অসচ্ছলকে অবকাশ দিবে অথবা ঋণ কমিয়ে দিবে, তাহলে আল্লাহ তাকে কিয়ামতের মাঠে তার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না’।[4]
হে লোক সকল! প্রচণ্ড উত্তাপের সময় উদাসীন ও অলস ব্যক্তির যেমন ইবাদত কবুল করা হয় না, তেমন ঐ ব্যক্তিরও যে জামাআতের সাথে ছালাত আদায় করা হতে সব সময় অলসতা করে থাকে। এই কষ্টের সময়ে ছওয়াবের আশা করা অনেক মহৎ ব্যাপারে। কেননা কষ্ট ও যন্ত্রণার মাধ্যমেই ছওয়াব অর্জিত হয়। আর জান্নাতকে কষ্ট দ্বারাই ঘিরে রাখা হয়েছে। গরমের সময় হলো পরীক্ষা ও ভোগান্তির সময়। আল্লাহ তাআলা মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে করে তিনি তাদের মধ্যে কে উত্তম আমল করছে তা পরীক্ষা করে নিতে পারেন। অতএব, তোমাদের কর্তব্য হলো মৃত্যুর পূর্বেই ভালো আমল করা। কেননা যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে তাকে আল্লাহ কিয়ামতের মাঠে তাঁর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে সম্মানিত করবেন। যেমনটি হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন; যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। তার একজন হলো— ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলানো থাকে।[5]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামত ও নিদর্শনাবলির জন্য তারই প্রশংসা জ্ঞাপন করো এবং তাঁর শুকরিয়া ও মহত্ত্ব বর্ণনা করো, কেননা তিনি তোমাদের উপর তাঁর নেয়ামতসমূহ গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করেছেন। তিনি বলেন, ‘যা তোমাদের উপর নেয়ামত পাঠানো হয় তা মূলত আল্লাহর পক্ষ হতেই হয়’ (আন-নাহল, ১৬/৫৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ‘যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গননা কর, তাহলে তোমরা তা গননা করে শেষ করতে পারবে না’ (ইবরাহীম, ১৪/৩৪)। তিনি তোমাদের জন্য পাহাড়কে পেরেকস্বরূপ করেছেন, পোশাককে গরম হতে রক্ষা করার মাধ্যম বানিয়েছেন এবং তিনি বিদ্যুৎ, ঠান্ডা করার যন্ত্রসহ বিভিন্ন যন্ত্রাদি দিয়েছেন। অতএব, তোমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করে তাঁর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। খরচ করার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা এবং অপচয় ও নষ্ট করা হতে বিরত থাকা। কারণ, যখন কোনো নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা তখন তা স্থায়ী হয়। অপরপক্ষে নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হলে তা স্থায়ী হয় না। আল্লাহর বাণী, ‘যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, যদি তোমরা আমার অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, তাহলে আমি তোমাদের প্রতি আরো অনুগ্রহ বাড়িয়ে দিব। আর যদি আমার নেয়ামতের অস্বীকার কর তাহলে জেনে রেখো আমার আযাব বড়ই কঠিন’ (ইবরাহীম, ১৪/৭)।
অতএব, একজন মুমিনের কর্তব্য হলো, তাদের যে সকল নেয়ামত দেওয়া হয়েছে তার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া, আল্লাহ কর্তৃক যা ফয়সালা করা হয়েছে তার প্রতি সন্তুষ্টি থাকা এবং তার প্রতি প্রশংসা ও তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। সাথে সাথে এ কথা বিশ্বাস রাখা যে, সকল বিষয় তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
অতঃপর সম্মানিত খত্বীব ইসলাম, মুসলিম, হারামাইন, মুসলিম নেতৃবর্গ ও সকল মুসলিম দেশসমূহের জন্য কল্যাণের দু‘আ করে খুৎবা শেষ করেন।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৫; মিশকাত, হা/৫৯১।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৪৩; তিরমিযী, হা/২৫৮৯।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮৬৪; মিশকাত, হা/৫৫৪০।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৭০৪; তিরমিযী, হা/১৩০৬; মিশকাত, হা/২৯০৬।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৬০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪২৭; তিরমিযী, হা/২৩৯১।