কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আমলে ছালেহ-এর উপর অটল থাকার উপদেশ

post title will place here

[৩শাওয়াল, ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ১২ এপ্রিল, ২০২পবিত্র হারামে মাক্কীর (কা‘বা) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খ. আব্দুল্লাহ ইবনে আওয়াদ আল-জুহানী হাফিযাহুল্লাহউক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]

প্রথমখুৎবা

যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। একমাত্র তাঁরই প্রশংসা, যিনি আমাদের লালনপালন করেছেন ও সাফল্য দান করেছেন। সাহায্য প্রদান ও পরিপূর্ণ দানের জন্য একমাত্র তাঁরই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি মহান দাতা ও মহা সম্মানিত। তিনি পরম করুণাময় ও দয়াশীল রব। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আমাদের নবী ও মহান নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনি ছিলেন ছালাত আদায়কারী ও ছায়েমদের মধ্যে সর্বোত্তম। তিনি যারা মানুষের ঘুমানোর সময়ে আল্লাহর জন্য সিজদায় রত থাকে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম। আল্লাহ তাঁর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবীগণ, তাঁর অনুসারীদের উপর ছালাত ও সালাম অবতীর্ণ করুন।

অতঃপর, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহকে ভয় করে চলুন। তিনি যা আদেশ করেছেন তার অনুসরণ করুন এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের উপর মহান আল্লাহর কৃত নিয়ামত ও অবারিত দানের শুকরিয়া আদায় করুন। যেমন তিনি আপনাদেরকে রামাযান মাসের ছিয়াম রাখা ও ক্বিয়াম করার তাওফীক্ব দান করেছেন এবং পুরো মাস জুড়ে ছিয়াম রাখা ও তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে মহা অনুগ্রহ দান করলেন।

তার জীবন সুখকর হোক, যে রামাযান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ছিয়াম রেখেছে ও ক্বিয়াম করেছে। তার জীবন আনন্দময় হোক, যাকে তার মাওলা ঘনিষ্ট করে নিয়েছেন এবং স্বীয় মুনাজাতে শরীক হওয়ার স্বাদ দান করেছেন। তার জন্য সুখকর অবস্থা হোক, যে পাপ কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে, মন্দ কাজ থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ রেখেছে, বাদানুবাদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং সকল প্রকাশ্য পাপ থেকে নিজেকে হেফাযত করেছে। তাদের অবস্থা সুখকর হোক, যারা তাদের রবের আনুগত্য করেছে, রামাযান মাসকে সম্মান করেছে এবং তাদের প্রতিপালকের জন্য একনিষ্টভাবে আমল করেছে।

অতএব, হে সম্মানিত ভাই! আল্লাহ আপনাদের উপর রহম করুন। আপনারা সকল সময়ে ও স্থানে আল্লাহর আনুগত্যের উপর অবিচল থাকুন। আপনারা রামাযান পরবর্তী সময়ে রামাযানে কৃত সৎ আমল ও ইহসানকে কখনোই কলুষিত করবেন না। রামাযান পরবর্তী সময়ে কখনোই মন্দ কাজ, শয়তানের আনুগত্য, ফাসেক্বী ও আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজের দিকে প্রত্যাবর্তন করবেন না। কেননা ভুল শুধরিয়ে নেওয়ার পর আবার বদ আমল করে যাওয়া আপনার জিদ ও গোঁড়ামি করে নিষিদ্ধ ও প্রত্যাখ্যাত আমলের উপর অটল থাকা প্রমাণ করে। কেননা যিনি রামাযান মাসের রব, তিনি শাওয়াল ও অন্যান্য মাসেরও রব। আর তিনি যেকোনো সময় বা কালেই স্বীয় অবাধ্যতাকে অপছন্দ করেন। কাজেই আপনারা আল্লাহর কাজে লজ্জিত হোন এবং তাকে পর্যবেক্ষণকারী হিসাবে ভয় করে চলুন। নিশ্চয়ই তিনি আপনার প্রতি সদা নযর রাখছেন এবং তিনি আপনার প্রকাশ্য ও গোপনীয় সকল বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,أَلَا حِينَ يَسْتَغْشُونَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ ‘জেনে রাখো! যখন তারা কাপড় আবৃত হয়, তখন তিনি জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা প্রকাশ করে। নিশ্চয়ই তিনি অন্তর্যামী’ (হূ, ১১/৫)

জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‍দিকনির্দেশনা হলো, আমলে ছালেহ-এর উপর অটল থাকা। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো আমল বা কাজ করলে তা সর্বদা অর্থাৎ নিয়মিতভাবে করতেন আর রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়লে বা অসুস্থ হলে তার পরিবর্তে দিনের বেলা ১২ রাকআত ছালাত আদায় করে নিতেন। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কখনো ভোর পর্যন্ত সারা রাত জেগে ইবাদত করতে এবং রামাযান মাস ছাড়া এক নাগাড়ে পুরো মাস ছিয়াম পালন করতে দেখিনি।[1] মাসরূক রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, আমি আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কোন আমল সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল? তিনি বললেন, যা সর্বদা নিয়মিতভাবে করা হয়। আমি বললাম, তিনি রাতে কখন উঠতেন? তিনি বললেন, তিনি উঠতেন যখন তিনি মোরগের ডাক শুনতেন।[2] উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি চাশতের ছালাত আট রাকআত পড়তেন ও বলতেন, আমার মা-বাবাকে জিন্দা করে পাঠানো হলেও আমি এই আট রাকআত ছালাতকে ছাড়ব না।[3]

নিয়মিত আমলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা ও বেলায়াত বা আল্লাহর অভিভাবকত্ব লাভে সক্ষম হন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে’ (আল-বাক্বারা, ২/২২২)। উক্ত আয়াতের তাফসীরে আল্লামা সা‘দী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নিশ্চয় মহান আল্লাহ নিয়মিত পাপ থেকে তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন অর্থাৎ পাপকাজসমূহ পরিত্যাগকারীগণকে।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! মহান আল্লাহকে ভয় করুন। জেনে রাখুন! নিশ্চয় এই দিন, রাত, মাস, বছর এ সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট সময় ও কাজের পরিমাপক। এটি আপনাকে নির্ধারিত সময়ের দিকে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে নিয়ে যায়। সময় আপনার ভালো ও মন্দ কাজকে গচ্ছিত রাখে। এটি আপনাদের আমলের সংরক্ষণাগার; অতএব, সময়কে মূল্যায়ন করে আপনার পক্ষে সাক্ষী হবে এমন আমল গচ্ছিত রাখুন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ ‘আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদত করো’ (আল-হিজর, ১৫/৯৯)

بارَك الله لي ولكم في القرآن العظيم، ونفعني وإيَّاكم بما فيه من الآيات والذِّكر الحكيم...

দ্বিতীয়খুৎবা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তার জন্য অফুরন্ত, পবিত্র ও কল্যাণময় প্রশংসা, যেমনটা আমাদের রব পছন্দ করেন ও যাতে সন্তুষ্ট হন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। মহান আল্লাহ আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল ছাহাবীদের উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত অগণিত ধারায় দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন।

অতঃপর, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহকে সত্যিকারের ভয় করে চলুন। আপনারা দৃঢ় ও মযবূতভাবে ইসলামকে ধারণ করুন। জেনে রাখুন! নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ববর্তী সকল উম্মাহর উপর এই উম্মাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ ও সুউচ্চ মর্যাদা হলো, তিনি এই ‍উম্মাহকে নিয়মিতভাবে কল্যাণ ও নেকী লাভের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছেন। হে আল্লাহর বান্দাগণ! তাঁর পক্ষ থেকে এই ধরনের বড় একটি অনুগ্রহ হলো, তিনি এই উম্মাহর জন্য শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম রাখার বিধান দিয়েছেন। যেমন আবূ আইয়ূব আল-আনছারী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযান মাসের ছিয়াম পালন করার পর শাওয়াল মাসের ছয় দিন ছিয়াম পালন করে, তা সারা বছর ছিয়াম পালন করার সমতুল্য হবে’।[4] অতএব, আপনারা দ্রুত শাওয়াল মাসের ছিয়াম সম্পূর্ণ করুন এবং কল্যাণ ও আনুগত্যের দিকে অগ্রগামী হোন। মহান আল্লাহ বলেন, رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! সৎ পথ প্রদর্শনের পরে তুমি আমাদের অন্তরগুলোকে বক্র করে দিয়ো না, আমাদেরকে তোমার নিকট হতে রহমত প্রদান করো। মূলত, তুমিই মহান দাতা’ (আলে ইমরান, ৩/৮)

হে আল্লাহ! আমাদের নিকটে ঈমানকে প্রিয় করে দিন এবং আমাদের অন্তরকে ঈমান দ্বারা সুসজ্জিত করুন। আমাদের নিকটে কুফর, ফাসেক্বী ও অবাধ্যতাকে অপছন্দনীয় করে দিন এবং আমাদেরকে সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আপনি আমাদের অন্তরকে আপনার আনুগত্যের উপর সুদৃঢ় রাখুন।

হে আল্লাহ! আপনি ফিলিস্তীনে বসবাসরত অসহায় মুসলিমদের সহযোগিতা করুন। হে আল্লাহ! দখলদার ইয়াহূদীদের বিরুদ্ধে আপনার সাহায্যকে আরো শক্তিশালী করুন। হে আল্লাহ! আপনি ইয়াহূদীদের উপর ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর সময়কার দুর্ভিক্ষের ন্যায় দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য যাবতীয় ফেতনার ছায়া থেকে রক্ষা করুন। আপনি মুসলিম জনপদ থেকে বালা-মুছীবত ও দুঃখ-দুর্দশা দূর করুন। হে আল্লাহ! আপনি উম্মাহকে সুপথ দান করুন, তাদের দুর্দশা দূর করুন এবং তাদের দ্বীনের শত্রুদের বিতাড়িত করুন। আমাদেরকে বিভক্তি ও যুদ্ধের কুফল থেকে মুক্ত রাখুন এবং মুসলিম জনপদ ও দেশসমূহকে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করুন।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা ছালাত ক্বায়েম করুন। মহান আল্লাহ বলেন,وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ‘আর ছালাত ক্বায়েম করো, নিশ্চয় ছালাত অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা করো’ (আল-আনকাবূ, ২৯/৪৫)


[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৪৬।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬১; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৪১।

[3]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৩০।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৬৪।

Magazine