[২১ জুমাদাল আখেরাহ, ১৪৪৪ হি. মোতাবেক ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেনশায়খ আব্দুল্লাহআল-বুয়াইজান হাফিযাহুল্লাহ।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই, যিনি সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর সুগঠিত করেছেন। যিনি চরিত্রকে তাক্বওয়া ও মর্যাদার মাপকাঠি হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আর যিনি ন্যায়পরায়ণদের জন্য জান্নাতুল মাওয়া প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং যালেমদের জন্য নিকৃষ্ট আবাসস্থল হিসাবে জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক ও তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবারবর্গ এবং মর্যাদা ও তাক্বওয়ার অধিকারী সকল ছাহাবীর উপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন।
অতঃপর, নিশ্চয় সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর বাণী; সুতরাং তা মযবূতভাবে ধারণ করুন। আর সর্বোত্তম আদর্শ হলো মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ; সুতরাং আপনারা তা অনুসরণ করুন। নিকৃষ্টতম কাজ (দ্বীনের মধ্যে) নব-আবিষ্কৃত কর্মসমূহ এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।
হে মানবমণ্ডলী! আল্লাহ যে বিষয়ে আদেশ করেছেন সে বিষয়ে তাক্বওয়া অবলম্বন করুন এবং যা থেকে তিনি সতর্ক ও নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকুন। আগামীকাল হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বেই আজই আপনারা নিজেদের আত্মসমালোচনা করুন; কেননা ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকাজ করলে সে তা দেখবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকাজ করলে সে তাও দেখবে’ (আয-যিলযাল, ৭/৮)।
অতঃপর জেনে রাখুন! নিশ্চয় দুনিয়া হলো পরীক্ষাগার। আর আখেরাত হলো প্রতিদান, হিসাব-নিকাশ এবং চিরস্থায়ী নিবাসের জায়গা। আল্লাহ তাআলা বলেন,كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ ‘প্রতিটি জীবন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তোমাদেরকে পূর্ণমাত্রায় বিনিময় দেওয়া হবে। যে ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করা হলো এবং জান্নাতে দাখিল করা হলো, অবশ্যই সে ব্যক্তি সফলকাম হলো, কেননা পার্থিব জীবন ছলনার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়’ (আলে ইমরান, ৩/১৮৫)।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! মানুষের অধিকারের বিষয়ে আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন; কেননা এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা প্রদর্শন মহা বিপদ ও পরিতাপের কারণ। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যেদিন তার কোনো দীনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম থাকলে তার যুলুমের সমপরিমাণ তার নিকট হতে নেওয়া হবে। আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ হতে নিয়ে তা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে’।[1] আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা কি বলতে পার, অভাবী লোক কে? তারা বললেন, আমাদের মাঝে যার দিরহাম (টাকা-কড়ি) ও ধনসম্পদ নেই সে তো অভাবী লোক। তখন তিনি বললেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সে প্রকৃত অভাবী, যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছওম ও যাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা করেছে ও আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যক্তিকে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে, অমুককে নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর যদি পাওনাদারের হক্ব তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না যায় তাহলে তার ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[2]
হে মানবমণ্ডলী! মানুষের মধ্যে অধিক হক্বদার ব্যক্তিই ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে বড় বাদী হবে। হায় আফসোস! কী অবস্থা হবে ঐ ব্যক্তির যার সাথে তার সবচেয়ে নিকটতম ও প্রিয় ব্যক্তি অধিকার নিয়ে আল্লাহর সামনে ঝগড়া করবে। আল্লাহ বলেন,﴿يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ - وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ - وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ - لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ﴾ ‘যেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে এবং তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও তার সন্তান থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন গুরুতর অবস্থা হবে যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে’ (আবাসা, ৮০/৩৪-৩৭)।
সুতরাং আপনারা মানুষের অধিকারের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন। অপরিচিতদের অধিকারের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন; যাদের সাথে হয়তো সাক্ষাতের আর সুযোগ পাবেন না। বস্তুত তাদের অধিকার তাদের পক্ষ হতে ক্ষমা ও তাদের হক্ব ফিরিয়ে দেওয়ার সাথে আবদ্ধ। আর পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের অধিকারের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন, যাদের হক্ব সংরক্ষণের ব্যাপারে আল্লাহ অছিয়ত করেছেন। পিতা-মাতা ও সন্তানসন্ততিদের হক্বের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন, আর আল্লাহকে ভয় করুন স্বামী-স্ত্রীর অধিকারের বিষয়ে।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সহমর্মিতা, ভালোবাসা এবং দয়ার উপর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً﴾ ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন’ (আর-রূম, ৩০/২১)।
এছাড়া তিনি সদাচরণ করতে ও দাম্পত্য সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ﴿وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ﴾ ‘আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো’ (আন-নিসা, ৪/১৯)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,﴿وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ﴾ ‘আর পুরুষদের উপর নারীদেরও হক্ব আছে, যেমন নিয়ম অনুযায়ী পুরুষদের নারীদের উপরও হক্ব আছে’ (আল-বাক্বারা, ২/২২৮)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَلَا تَنْسَوُا الْفَضْلَ بَيْنَكُمْ﴾ ‘আর তোমরা পারস্পরিক সহায়তা হতে বিমুখ হয়ো না’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩৭)।
আল্লাহ তাআলা শরীআতে বৈবাহিক বিধানাবলি ও স্বামী-স্ত্রীর হক্বসমূহ প্রবর্তন করেছেন। প্রত্যেকের জন্য কিছু বিধান, হক্ব এবং দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন। এগুলোর উপর প্রতিদান ও জবাবদিহিতা আরোপ করেছেন। ছওয়াব ও শাস্তি প্রদানের ঘোষণার মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো বাধ্যতামূলক করেছেন।
এ সকল হক্ব শুধু রুচিসম্মত চরিত্র, সামাজিক শিষ্টাচার ও আইনী বিধিবিধান নয়। বরং এগুলো আল্লাহ প্রণীত আসমানী বিধান, কুরআনী আয়াত এবং নবীর সুন্নাত; যা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা হয়। যেমন তাঁর নাফরমানী করা হয় এগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করার মাধ্যমে। এগুলো মূলত পরীক্ষার ময়দান।
সুতরাং আপনারা তাক্বওয়া অবলম্বন করুন এবং আল্লাহর পর্যবেক্ষণের বিষয়টি সর্বদা স্মরণে রাখুন। আপনারা সকলেই দায়িত্বশীল আর আপনাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন।
স্বামী তার গৃহের বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং সে তার দায়িত্ব ও স্ত্রীর অধিকার বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার গৃহের বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং সে তার দায়িত্ব ও স্বামীর অধিকারের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾ ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং পরস্পরের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আল-আনফাল, ৮/১)।
দ্বিতীয় খুৎবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন ও প্রত্যেক প্রাণীর জন্য রিযিক্ব নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং প্রত্যেকের জন্য শরীআতে তার অধিকার প্রবর্তন করেছেন এবং বলেছেন,﴿وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ﴾ ‘আর আত্মীয়স্বজনকে দাও তার প্রাপ্য অধিকার’ (আল-ইসরা, ১৭/২৬)।
অতঃপর ছালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যিনি সত্য নিয়ে আগমন করেছেন।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! স্বামী-স্ত্রীর শ্রেষ্ঠ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হলো, সদ্ভাবে বসবাস করা, কোমল আচরণ করা, সহমর্মিতা প্রদর্শন এবং উত্তম আচরণ করা। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একে অন্যের সাথে উত্তম আচরণ করা ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ﴾ ‘আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো’ (আন-নিসা, ৪/১৯)। তিনি আরো বলেন, ﴿وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً﴾ ‘আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন’ (আর-রূম, ৩০/২১)।
সুন্দর দাম্পত্য জীবনের অন্যতম নিদর্শন হলো, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে হারাম বিষয় থেকে বিরত রাখবে এবং সৎকাজে পরস্পরে সহযোগী হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى﴾ ‘নেককাজ ও তাক্বওয়ার কাজে তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে’ (আল-মায়েদা, ৫/২)। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক হলো, একে অপরের প্রতি মর্যাদা ও সম্মানবোধ বজায় রাখা, পরস্পরের অনুভূতির মূল্যায়ন করা এবং হৃদয়ের একান্ত অভিপ্রায় পূরণ করা। একটি সুন্দর সম্পর্কের জন্য জরুরী হলো, একে অন্যকে কষ্ট প্রদান এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে মন্দ আচরণ করা থেকে বিরত থাকা। কেননা এগুলো এমন সৌহার্দের অন্তর্ভুক্ত নয় যে বিষয়ে আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রী উভয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা জেনে রাখুন যে, স্বামী-স্ত্রীর বড় অধিকারের মধ্যে একটি হলো, পরস্পরের গোপনীয়তা রক্ষা করা। কেননা গোপনীয়তা হলো আমানতস্বরূপ। আর তা প্রকাশ করা বিশ্বাসঘাতকতা ও খেয়ানত। সুতরাং যে ব্যক্তির মাঝে আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই। স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয়তা অন্য যেকোনো গোপনীয়তার চেয়ে অতি একান্ত গোপন বিষয়। সুতরাং উভয়ের মাঝে মতান্তর সৃষ্টি ও বিচ্ছেদ হওয়ার পরও তা রক্ষা করা এবং প্রচার ও প্রকাশ না করা ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের খেয়ানত করো না। আর খেয়ানত করো না নিজেদের আমানতসমূহের, অথচ তোমরা জানো’ (আল-আনফাল, ৮/২৭)।
বিপদ আরো বহুগুণে বেড়ে যায় যখন স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয়তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। সুতরাং আপনারা পরস্পরের আমানতের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন এবং গোপনীয়তা রক্ষা করুন। আর নিকৃষ্টতম ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি হবে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম পর্যায়ের, যে তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সাথে মিলিত হয়, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়’।[3]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! স্বামী-স্ত্রীর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হলো, পরস্পরের মীরাছের অধিকার। কেননা আল্লাহ তাআলা বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছেন এবং তা ন্যায্যভাবে বণ্টন করেছেন এবং স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেকের জন্য একটি নির্ধারিত অংশ ধার্য করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা কর্তৃক ফরযকৃত ও অছিয়তকৃত মীরাছের অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা জায়েয নয়; চাই সে মীরাছ ভূ-সম্পত্তি হোক বা টাকা-পয়সা হোক। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾ ‘এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর এটাই মহাসফলতা’ (আন-নিসা, ৪/১৩)।
হে মানুষসকল! আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের উপর কিছু হক্ব নির্ধারণ করেছেন। স্ত্রীর উপর স্বামীর হক্ব হলো, তার প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া, তার সম্মান রক্ষা করা এবং তার অনুমতি ব্যতীত বাহিরে বের না হওয়া। আর স্বামীর উপর স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো, মোহরানা প্রদান, ব্যয়ভার বহন, বাসস্থান ও পোশাক প্রদান এবং ইনছাফ বজায় রাখা।
সুলায়মান ইবনু আমর ইবনুল আহওয়াছ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার পর বললেন, ‘শোনো! আমি তোমাদেরকে নারীদের সাথে ভালো ব্যবহারের উপদেশ দিচ্ছি। তারা তোমাদের নিকট বন্দির মতো যুক্ত। তাদের উপর তোমাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই, যদি না তারা কোনো প্রকাশ্য অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ে। যদি তারা তাই করে তাহলে তোমরা তাদের বিছানা পৃথক করে দাও এবং একান্ত প্রয়োজন হলে হালকাভাবে আঘাত করো। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তবে তাদের প্রতি বাড়াবাড়ির পথ অন্বেষণ করো না। জেনে রেখো! তোমাদের যেরূপ অধিকার রয়েছে তোমাদের স্ত্রীদের উপর, তোমাদের স্ত্রীদেরও তদ্রূপ অধিকার রয়েছে তোমাদের উপর (কাজেই উভয়ের প্রতি উভয়ের অধিকার আদায় করা কর্তব্য)’।[4]
অতঃপর হে মানবসকল! আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন এবং হক্বদারের হক্ব আদায় করুন। হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা নিজেদের আত্মসমালোচনা করুন হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বেই। মৃত্যুর পূর্বেই আপনারা যিম্মাদারী মুক্ত হোন, পাওনাদারদের সাথে মীমাংসা করে নিন, অন্যায়ভাবে অর্জিত বস্তু তার মালিককে ফিরিয়ে দিন ও প্রত্যেক হক্বদারকে তার হক্ব বুঝিয়ে দিন।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে ন্যায়পরায়ণতা ও তাক্বওয়া অবলম্বনের তাওফীক্ব দিন। আমাদেরকে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমাদেরকে অন্যায় ও যুলুম থেকে রক্ষা করুন এবং সুখময় অবস্থার পর দুঃখময় অবস্থায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করুন। হে আল্লাহ! আমাদের আগের ও পরের, গোপন ও প্রকাশ্য এবং যেসব বিষয়ে আপনি আমাদের চেয়ে বেশি অবগত তা ক্ষমা করে দিন।
হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গসহ তাঁর সকল সহচরবৃন্দের উপর রহমত নাযিল করুন। হে আল্লাহ! আপনি ইসলাম ও মুসলিমদের শক্তিশালী করুন এবং আপনার তাওহীদপন্থী বান্দাদেরকে সাহায্য করুন।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৪৯।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮১।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৩৭।
[4]. তিরমিযী, হা/৩০৮৭, হাসান।