[৯ জুমাদাল আখেরাহ, ১৪৪২ হি. মোতাবেক ২২ জানুয়ারি, ২০২১। পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারার (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খ ড. আহমাদ ইবনু হুমাইদ (হাফি.)।উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহীর সম্মানিত সিনিয়র শিক্ষক ও ‘আল-ইতিছাম গবেষণা পর্ষদ’-এর গবেষণা সহকারী শায়খ আব্দুল কাদের বিন রইসুদ্দীন। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সমুন্নত, ক্ষমতাবান, মুমিনদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী। তার মতো কেউ নেই, তার সমকক্ষ কেউ নেই, তিনি অনন্য। ‘তিনি সবকিছু শুনেন এবং দেখেন’ (আশ-শুআরা, ২৬/১১)। আমি তার প্রশংসা করছি তার কৃতজ্ঞ বান্দাদের প্রশংসার ন্যায়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তাকে স্মরণকারী বান্দাদের কৃতজ্ঞতার ন্যায় এবং স্মরণ করছি তাকে তাওহীদবাদীদের স্মরণের ন্যায়। ‘আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা এবং বড় পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন’ (আল-আহযাব, ৩৩/৩৫)। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তার রুবূবিয়্যাত সম্পর্কে জ্ঞাত, ওয়াহদানিয়্যাত সম্পর্কে পরিচিত ও তার ইবাদতে বিনয়ী ব্যক্তির ন্যায় এই মর্মে যে, এক আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নাই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নেতা নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তাকে তিনি সৃষ্টির সেরা এবং বন্ধু হিসাবে বিশেষিত করেছেন। তাকে তিনি অহীর জন্য মনোনীত করেছেন। তার মাধ্যমেই নবীগণের আগমনী ধারা মোহরাঙ্কিত করেছেন। তাকে পাঠিয়েছেন তিনি জগতবাসীর জন্য রহমতরূপে, সত্যান্বেষীদের পথপ্রদর্শকরূপে, সত্যের নিদর্শন ও সত্য পথের দ্যুতিরূপে।
হে বিশ্বাসীগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে থেকে মুমিন বান্দাদের মধ্য থেকে তাদেরকে বাছাই করেছেন, যারা তার সম্পর্কে ও তার নির্দেশ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। আর যারা তাদের পথ পরিহার করবে, তাদের পথ থেকে বিচ্যুত হবে, তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি জানে যে হক্ব আপনার রবের কাছ থেকে আপনার কাছে অবতীর্ণ হয়, সে কি তার মতো যে অন্ধ? বস্তুত জ্ঞানীরাই উপদেশ গ্রহণ করে। প্রকৃত জ্ঞানী তারাই যারা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে না। আর যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে, যার আদেশ আল্লাহ করেছেন; যারা তাদের রবকে ভয় করে, মন্দ হিসাবের ভয় করে; যারা তাদের রবের সন্তুষ্টির সন্ধানে ধৈর্যধারণ করে, ছালাত আদায় করে, আমার দেওয়া রিযিক্ব থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, মন্দের প্রত্যুত্তর করে ভালোর মাধ্যমে; তাদের জন্য রয়েছে পরকালীন আবাস (জান্নাত)। স্থায়ী বসবাসের জান্নাত, যাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান সন্ততিদের মধ্যে থেকে যারা নেক আমল করেছে তারাও প্রবেশ করবে। ফেরেশতারা তাদের (অভ্যর্থনা জানানোর জন্য জান্নাতের) প্রতিটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং বলবে, ‘তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক! যেহেতু তোমরা (দুনিয়ায়) ধৈর্যধারণ করেছিলে। কতই না উত্তম পরকালীন আবাস! আর যারা আল্লাহকে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার যে আদেশ আল্লাহ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তাদের জন্য রয়েছে লা‘নত এবং মন্দ আবাস (জাহান্নাম)’ (আর-রা‘দ, ১৩/১৯-২৫)।
অতএব, ইসলাম বুঝার জন্য আল্লাহ যার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিয়েছেন, হৃদয়কে ঈমানের নূর দ্বারা আলোকিত করেছেন, সে সর্বদা আল্লাহর সীমারেখা হেফাযত ও নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে জ্ঞানীদের মানহাজ আঁকড়ে ধরে। যে পথের দিকে মহান আল্লাহ তার মুত্তাক্বী বান্দাদের আহ্বান করে বলেন, ‘এটা হচ্ছে আমার সরল পথ। তোমরা তা অনুসরণ করো, এ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করো না। কেননা তা (ভিন্ন পথ অবলম্বন) তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। এ ব্যাপারেই তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে তোমরা মুত্তাক্বী হতে পার’ (আল-আনআম, ৬/১৫৩)।
যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা তাদের রবের কাছে কামনা করে বলে, ‘আপনি আমাদের সরল পথ দেখান, তাদের পথ যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন’ (আল ফাতিহা, ০৬)। ফলে মহীয়ান গরীয়ান মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নেয়াতমপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তারা হচ্ছেন, নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও নেককার বান্দাগণ (আন-নিসা, ৪/৬৯-৭০)।
যারা জ্ঞানী তারা আল্লাহর অবাধ্যতার চেয়ে আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়, মূর্খতার উপর জ্ঞান প্রাধান্য দেয়, দ্বীনকে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দেয়। সুতরাং জ্ঞান তাদের সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা তাদের সম্মান, সম্মান তাদের পূর্ণতা। তারা সকল সৃষ্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহর দরবারে কড়া নাড়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহই হলেন অমুখাপেক্ষী এবং প্রশংসিত’ (ফাত্বির, ৩৫/১৫)।
দ্বিতীয় খুৎবা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং যিনি নেককার লোকদের অভিভাবক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নাই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নেতা নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাকে জগতবাসীর জন্য রহমতস্মরূপ পাঠিয়েছেন।
ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী আমার খালা মায়মূনার ঘরে রাত কাটালাম। আমি বিছানায় বালিশের পাশে আড়াআড়ি হয়ে শুইলাম এবং আমার খালা ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লম্বালম্বি হয়ে শুইলেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্ধরাত্রি অথবা এর কিছু কম অথবা বেশি সময় পর্যন্ত ঘুমালেন। তারপর তিনি ঘুম থেকে উঠে বসে হাত দ্বারা মুখ রগড়িয়ে ঘুমের ভাব দূর করতে লাগলেন। তারপর তিনি সূরা আলে ইমরানের শেষ ১০ আয়াত পাঠ করে মশকের কাছে গিয়ে পানি নিয়ে ভালোভাবে ওযূ করলেন। অতঃপর ছালাত আদায় করলেন।[1] উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সবচেয়ে আশ্চর্যকর কোন বিষয়টি দেখেছেন? তিনি প্রশ্ন শুনে চুপ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কোনো এক রাতে তিনি আমাকে বললেন, আয়েশা! আজ রাতে আমাকে তুমি আমার রবের ইবাদত করার জন্য ছেড়ে দাও। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি আপনার সঙ্গ পেতে ভালোবাসি এবং আপনাকে যা আনন্দ দেয় সেটাও ভালোবাসি। আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, অতঃপর তিনি উঠে পবিত্র হয়ে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছালাতে তিনি এত অধিক পরিমাণে কাঁদলেন যে, তার দাঁড়ি ও বুক ভিজে গেল; শেষ পর্যন্ত যমীনও ভিজে গেল। অতঃপর বেলাল রযিয়াল্লাহু আনহু (ফজরের) ছালাতের আযান দেওয়ার জন্য আসলেন। তাকে কাঁদতে দেখে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার তো পূর্বাপর সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? আজ রাতেই আমার কাছে কিছু আয়াত নাযিল হয়েছে। ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি! যে এই আয়াতগুলো পাঠ করল অথচ তা নিয়ে গবেষণা করল না। এ কথা বলে তিনি এই আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, ‘নিশ্চয়ই আসমান-যমীনের সৃষ্টির মধ্যে দিন এবং রাতের পরিবর্তনের মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে, আসমান-যমীনের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে আর বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! এগুলো আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আপনি সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। সুতরাং আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। প্রতিপালক! আপনি যাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন, তাকে বেইজ্জতি করে ছাড়বেন। আর যারা যালেম তাদের জন্য তো কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। প্রতিপালক! আমরা একজন ঘোষণাকারীকে এই ঘোষণা করতে শুনেছি যে, তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আনো। তাই আমরা ঈমান এনেছি। প্রতিপালক! অতএব, আপনি আমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিন, আমাদের আমলনামা থেকে আমাদের অপরাধসমূহ মুছে দিন, নেককার লোকদের সাথে আমাদের মৃত্যু দান করুন। প্রতিপালক! আপনি আপনার রাসূলের মাধ্যমে যেসব প্রতিশ্রুতি আমাদের দিয়েছেন, তা আমাদের দান করুন। আর কিয়ামতের দিন আমাদের অপমানিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি ওয়াদা খেলাফ করেন না। অতঃপর তাদের রব তাদের ডাকে এই বলে সাড়া দিলেন যে, তোমাদের মধ্যে থেকে নারী হোক অথবা পুরুষ হোক কোনো আমলকারীর আমল আমি বিনষ্ট করব না। তোমরা একে অপরের মতো। অতঃপর যারা হিজরত করেছে (নিজেদের দেশ ত্যাগ করেছে), যাদেরকে নিজেদের জন্মভূমি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, আমার পথে যারা নির্যাতিত হয়েছে, যারা আমার পথে লড়াই করেছে এবং শহীদ হয়েছে, অবশ্যই আমি তাদের থেকে তাদের গুনাহ মাফ করে দিব এবং তাদের এমন জান্নাতে প্রবেশ করাব যার তলদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত হতে থাকবে। এটা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার। আর আল্লাহর কাছেই আছে উত্তম পুরস্কার। (হে মুহাম্মাদ), দেশে দেশে, জনপদে যারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে তাদের (দাম্ভিকতাপূর্ণ) পদচারণা আপনাকে যেন ধোঁকায় ফেলে না দেয়।
(কেননা তাদের এ পদচারণা) সামান্য কয়দিনের উপভোগ মাত্র। এরপর তাদের থাকার জায়গা হবে জাহান্নাম। আর তা কতই না নিকৃষ্ট আবাস। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত হচ্ছে। তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। এটা হবে তাদের রবের পক্ষ থেকে মেহমানদারী। আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা হবে নেককার লোকদের জন্য অতীব উত্তম। নিশ্চয়ই আহলে কিতাবদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং তোমাদের কাছে পাঠানো কিতাবের উপর ঈমান আনে এবং তাদের কাছে পাঠানো কিতাবের উপরও ঈমান আনে। তারা আল্লাহর অনুগত থাকে। তারা আল্লাহর আয়াতকে অল্প মূল্যে বিক্রি করে না। এদের জন্য আল্লাহর কাছে পুরস্কার রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাবগ্রহণকারী। হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং এ কাজে সুদৃঢ় থাকো, শত্রুর মোকাবিলায় তৎপর থাকো, আল্লাহকে ভয় করো, অবশ্যই তোমরা সফলকাম হবে’।
আল্লাহর বান্দাগণ! জ্ঞানীদের এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের ধারণ করতে হবে। হে আল্লাহ! আপনি ইসলাম এবং মুসলিমদের সম্মানিত করুন। মুশকিদের লাঞ্ছিত করুন। আপনার ও আপনার দ্বীন ইসলামের শত্রুদের ধ্বংস করুন। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পাকড়াও করবেন না, যদি আমরা ভুলে যাই অথবা ভুল করি। প্রতিপালক! আমাদের হেদায়াত দেওয়ার পর আমাদের হৃদয়গুলো বক্র করে দিয়েন না। আল্লাহ! আমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দিন এবং কার্যক্ষেত্রে আমাদের সীমালঙ্গন ক্ষমা করে দিন। লড়াইয়ের ময়দানে আমাদের দৃঢ়পদ রাখুন, কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৬৪।