[৩০ ছফর, ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ মদীনা মুনাওয়ারার আল-মাসজিদুল হারামে (মসজিদে নববী) জুমআর খুৎবা প্রদান করেন শায়খআব্দুল্লাহআল-বুয়াইজান হাফিযাহুল্লাহ। উক্ত খুৎবা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর আরবী বিভাগের সম্মানিত পিএইচডি গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ। খুৎবাটি ‘মাসিক আল-ইতিছাম’-এর সুধী পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।]
প্রথমখুৎবা
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। যিনি পানি থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আত্মীয়তা ও বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। আর যিনি আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখাকে আবশ্যক করেছেন এবং এর জন্য বড় প্রতিদান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনি মানুষের মাঝে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর। এছাড়া তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবী ও তাঁর সমস্ত অনুরাগীদের উপর দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক।
অতঃপর নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর আনুগত্যের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, যা তাঁর সন্তুষ্টিকে নিশ্চিত করে। তিনি তাদেরকে তাঁর অবাধ্য হতে নিষেধ করেছেন যা তাঁর ক্রোধকে অবধারিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ - وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ ‘অতএব, কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে তা সে দেখবে। আর কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখবে’ (আল-যিলযাল, ৯৯/৭-৮)। অতএব, একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করে চলুন। আর আপনার জীবনকে আমলের মাধ্যমে যাপন করুন এবং কর্মের মাধ্যমে আপনার কথার হক্ব আদায় করুন। কেননা মানুষের জীবনের যে অংশটুকু আল্লাহর আনুগত্যে অতিবাহিত হয়েছে তাই হলো আসল। বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি যে নিজেকে আল্লাহর জন্য সঁপে দেয় এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। আর সে ব্যক্তি হতভাগা যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর ইচ্ছার উপরে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়।
হে মুসলিমগণ! নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, শ্রেষ্ঠ ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো হক্ব ও কর্তব্যসমূহ পালন করা। হে আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহর নিকটে উক্ত হক্বসমূহের মধ্যে অন্যতম পালনীয় হক্ব হলো নিকটাত্মীয়ের হক্ব। আল্লাহ তাআলা তাদের উপরে নিকটাত্মীয়ের হক্ব আদায় করা এবং তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ ذَلِكَ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يُرِيدُونَ وَجْهَ اللهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘অতএব আত্মীয়স্বজনকে তাদের হক্ব দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। এটি উত্তম তাদের জন্য, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় এবং তারাই সফলকাম’ (আর-রূম, ৩০/৩৮)। এখানে আল্লাহ তাআলা নিকটাত্মীয়দের অধিকার সাব্যস্ত করেছেন এবং তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাদের অধিকারকে স্বীয় তাওহীদ বা একত্বের সাথে উল্লেখ করে বলেন,وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا ‘তোমরা ইবাদাত করো আল্লাহর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতাপিতার সাথে, নিকটাত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আত্মীয়-প্রতিবেশী, অনাত্মীয়-প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহংকারী’ (আন-নিসা, ৪/৩৬)। কাজেই আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা একটি বড় হক্ব ও কর্তব্য এবং এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল ও সৎকর্ম।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আত্মীয়তার বন্ধন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও আনুগত্য, ভ্রাতৃত্ব ও প্রশান্তি তৈরি করে এবং ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা ও শত্রুতাকে ধ্বংস করে। এই কারণে আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি এই মর্মে পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিও নিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ثُمَّ تَوَلَّيْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مُعْرِضُونَ ‘আর স্মরণ করো, যখন আমি বনী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না এবং সদাচরণ করবে পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে। আর মানুষকে উত্তম কথা বলো, ছালাত ক্বায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া তোমরা সকলে উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নিলে’ (আল-বাক্বারা, ২/৮৩)।
হে মানুষসকল! আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসের অন্যতম দাবি ও আবশ্যকীয় বিষয়। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনে ঈমান রাখে, সে যেন তার রক্তের সম্পর্ককে অটুট রাখে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনে ঈমান রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা নীরব থাকে’।[1]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা জীবিকা বৃদ্ধি, অর্থসম্পদে বরকত, দীর্ঘায়ু লাভের অন্যতম কারণ। আনাস ইবনু মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِى رِزْقِهِ وَأَنْ يُنْسَأَ لَهُ فِى أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তার মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করে’।[2]
হে মুসলিমগণ! আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন অধিকার যা আল্লাহ অবধারিত করে দিয়েছেন, এটা এমন ইবাদত যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আপনাদেরকে খুব শীঘ্রই এ সম্পর্কে আল্লাহর সামনে জিজ্ঞাসিত হতে হবে; কাজেই রক্তের সম্পর্ক ও স্বজনদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন।
যারা আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আপনি তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখুন, যারা আপনাকে বঞ্চিত করেছে আপনি তাদের প্রদান করুন, যারা আপনার সাথে অন্যায় করেছে আপনি তাদের ক্ষমা করুন। সর্বক্ষেত্রে ইহসান করুন; নিশ্চয় আল্লাহ ইহসানকারীদের ভালোবাসেন। অতঃপর জেনে রাখুন! আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা বিনিময়ের মাধ্যমে হয় না, বরং ছওয়াবের প্রত্যাশা ও দ্রুত সম্পন্নকরণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার আত্মীয়স্বজন আছেন। আমি তাদের সাথে সদাচরণ করি; কিন্তু তারা আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি তাদের উপকার করে থাকি, কিন্তু তারা আমার অপকার করে। আমি তাদের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করে থাকি আর তারা আমার সঙ্গে মূৰ্খতাসুলভ আচরণ করে। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি যা বললে, তাহলে যদি প্রকৃত অবস্থা তাই হয় তুমি যেন তাদের উপর জ্বলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করছ। আর সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহর তরফ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী (ফেরেশতা) থাকবে, যতক্ষণ তুমি এ অবস্থায় বহাল থাকবে’।[3]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! সর্বোত্তম কাজ হলো নিকটাত্মীয় শত্রুর সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে নিজের নফসের সাথে লড়াই করা। কেননা এতে তা নফসের বিভিন্ন অনুসঙ্গ (হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা ইত্যাদি) দ্বারা কলুষিত হয় না। হাকিম ইবনু হিযাম রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, ছাদাক্বাসমূহের মাঝে কোন ছাদাক্বাটি উত্তম? তিনি বললেন, عَلَى ذِى الرَّحِمِ الكَاشِحِ ‘সম্পর্ক ছিন্নকারী বা শত্রুতা পোষণকারী নিকটাত্মীয়দের প্রদানকৃত ছাদাক্বা’।[4]
জনৈক কবি বলেন, (ভাবার্থ) ‘ওহে স্বজাতির সন্তানেরা! শত্রুতার কুফল হলো, বিদ্বেষ যা স্বজনের হৃদয়ে অবশিষ্ট থাকে। কত মানুষ রয়েছে যার উপকারিতা দূরের লোকেরা পায়, অথচ তার নিকটাত্মীয়রা আজীবন বঞ্চিত থাকে। এটা কল্যাণকর জীবন নয় যে, তার জীবিকা থেকে পরিবার উপকৃত হয় না, তার মৃত্যুতে নিকটজনও হা-হুতাশ করে না’।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় থাকে তাদের প্রতি আন্তরিকতা দেখানো, তাদের প্রতি খরচ করা বা দান করা এবং তাদের প্রতি ইহসান প্রদর্শন ও তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে। এছাড়া তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন, তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাদের পাশে থাকা কর্তব্য, যা আত্মীয়তার বন্ধনকে শক্তিশালী করে, ভালোবাসার রশিকে সুদৃঢ় করে এবং হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি করে। এ সম্পর্ক রক্ষা হয় পরস্পর শুভকামনা জ্ঞাপন, সহযোগিতা, পরোপকার এবং ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে। অনুরূপভাবে একে অপরকে ভালো কথা বলা, হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সাক্ষাৎ করা, বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দেওয়া এবং অন্যান্য ভালো কাজ দ্বারাও আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চেয়ে থাক। আর ভয় করো রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক’ (আন-নিসা, ৪/১)।
بارَك اللهُ لي ولكم في القرآن العظيم، ونفعني وإيَّاكم بما فيه...
দ্বিতীয়খুৎবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর বান্দাদের উপর ইহসান করেছেন। দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর। তাঁর পরিবারবর্গ, ছাহাবী ও তাঁর সমস্ত অনুরাগীদের উপর অগণিত দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক।
হে মানবসকল! আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন এবং তা থেকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন,فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ * أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ ‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লা‘নত করেছেন, ফলে তাদেরকে বধির ও তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করে দিয়েছেন’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/২২-২৩)।
কাজেই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা পাপ এবং মহা অপরাধ, যা আল্লাহর লা‘নত ও শাস্তিকে অবধারিত করে। এটা এমন যুলম যা হৃদয়কে নিঃসঙ্গতা, ঘৃণা ও কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেয়। আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তার যে বন্ধনকে অটুট রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করার চেয়ে বড় যুলম আর কী হতে পারে? আল্লাহ তাআলা বলেন,وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ ‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছে আখেরাতের মন্দ আবাস’ (আর-রা‘দ, ১৩/২৫)।
হে মানবসকল! রক্তসম্পর্ক আল্লাহর রহমতের একটি নিদর্শন যা তাঁর রহমতের সাথে জড়িত। কাজেই যে তা ছিন্ন করল সে যেন আল্লাহর রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন হলো, আর যে তা রক্ষা করল আল্লাহর রহমত যেন তাকে ছেয়ে নিল। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করলেন। তারপর যখন তিনি এর থেকে অবসর হলেন, তখন রহীম (আত্মীয়তার বন্ধন) উঠে দাঁড়াল। আল্লাহ তাকে বললেন, তুমি থামো। আত্মীয়তার বন্ধন তখন বলল, আমাকে ছিন্নকারী থেকে আশ্রয় চাওয়ার জায়গা এটা। এতে আল্লাহ ঘোষণা করলেন, তুমি কি এতে রাযী নও যে, যে লোক তোমার সঙ্গে সদ্ভাব রাখবে আমিও তার সঙ্গে সদ্ভাব রাখব আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিন্ন করব? সে বলল, আমি এতে সন্তুষ্ট, হে আমার প্রতিপালক! আল্লাহ বললেন, তা-ই তোমার জন্য’।[5]
হে মানুষসকল! আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা জীবনের স্থায়িত্বকে নিশ্চিত করে আর সম্পর্কচ্ছেদ জীবনে বিনাশ ডেকে আনে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা প্রতিদান ও ছওয়াবের কাজ, পক্ষান্তরে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা গুনাহ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যুবায়ের ইবনু মুতইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[6] আবূ বাকরা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যেসব পাপীকে পার্থিব জগতেই তার পাপের ত্বরিত শাস্তি দেন এবং আখেরাতেও তার জন্য শাস্তি জমা রাখেন, তা হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ও রাষ্ট্রদ্রোহীর পাপ’।[7]
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন। রবের সামনে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হওয়ার আগে নিজেদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনুন। মৃত্যুর আগেই আপনার ঋণ পরিশোধ করুন। রক্তের সম্পর্ককে ঠিক করুন। একমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রতিদানের আশা করুন। মৃত্যুর আগেই আত্মীয়তার ছিন্ন সম্পর্ককে ঠিক করে নিন। যারা আপনার উপর যুলম করেছে তাদের ক্ষমা করুন, কারণ এটি আপনার দুনিয়ার জীবনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে এবং আখেরাতের জন্য কল্যাণকর হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ‘আর সৎকর্ম করো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৫)।
হে আল্লাহ! আপনি ইসলাম ও মুসলিমদেরকে সম্মানিত করুন। হে আল্লাহ! আপনি আপনার দ্বীন, কিতাব ও আপনার প্রেরিত নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহকে সাহায্য করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন, আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন। আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা বেশি বেশি মহান আল্লাহকে স্মরণ করুন, তিনি আপনাদের স্মরণ করবেন। আপনারা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া করুন, তিনি আরো বৃদ্ধি করে দিবেন।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৩৮।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৭।
[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৮।
[4]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৩৫৫।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৫০২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৪।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৬।
[7]. আহমাদ, হা/২০৩৯৮; তিরমিযী, হা/২৫১১; ইবনু মাজাহ, হা/৪২১১, হাদীছ ছহীহ।