কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

যুদ্ধ নাকি ভয়ংকর নাটক?

post title will place here
কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলায় ২৮ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২৫ জন ছিল হিন্দু পর্যটক। এই হামলার পরপর তদন্ত ছাড়াই ভারতের কসাই খ্যাত মোদি সরকার পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। অথচ, ঘটনাস্থল থেকে পাকিস্তান ৪০০ কিলোমিটার দূরে। বর্তমান কাশ্মীরে সন্দেহের জেরে দেড় হাজারের মতো নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সন্দেহের জেরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকার মুসলিমদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিচ্ছে। বর্তমানে কাশ্মীরের ৪০টি পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে বর্তমান ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উত্তেজনায়। ভারত-পাকিস্তান প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হবে ইনশা-আল্লাহ।

জঙ্গিবাদ না সন্ত্রাসী হামলা?

বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়াসহ ভারতপন্থি প্রতিটি মিডিয়া ফলোআপ করে প্রচার করছে—জঙ্গিবাদী হামলা। আজ পর্যন্ত জঙ্গি শব্দটির সংজ্ঞা তেমন কেউ দিতে পারেনি। তবে, ঠিকই জঙ্গিবাদ ট্যাগ দিতে পেরেছে। পেহেলগামের এই ঘটনাকে জঙ্গিবাদ বলা হাস্যকর ছাড়া কিছুই না। বিশ্ব মিডিয়ার মতে, যেকোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য অবশ্য তথ্যবহুল প্রমাণ দরকার। তথ্যবহুল প্রমাণ না থাকলেও সুস্পষ্ট আলামত দরকার। এই ঘটনায় সুস্পষ্ট তদন্ত না হতেই বিশ্ব মিডিয়া জঙ্গি বলে মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিল!

হামলাটা কারা করেছে?

সকলের মনে একটাই প্রশ্ন— এই হামলাটা কারা করেছে? হামলাটা কারা করেছে? এই বিষয়ে জানার আগে আমাদের বর্তমান কাশ্মীর প্রসঙ্গে কিছু তথ্য জানা আবশ্যক। কাশ্মীরে সবসময় ৫ লক্ষ নিরাপত্তাকর্মী অবস্থান করে। পর্যটনকেন্দ্রে থাকে কঠোর নিরাপত্তা। তাহলে এই হামলা করার ক্ষেত্রে ভারত সরকারের সহযোগিতা অবশ্যই আছে। এই ছোট্ট কাশ্মীরে ৫ লক্ষ নিরাপত্তাকর্মী থাকার পরও সন্ত্রাসী হামলা হলে সেটা ভারত সরকারের নিরাপত্তাজনিত ব্যর্থতা অন্যথা ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বলা চলে। অবশ্য The Registance front (TRF) নামে একটি মুজাহিদ বাহিনী নাকি এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। ঠিক এমন বিজ্ঞপ্তি অনলাইন দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। আর সেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কয়েকটি বিশ্ব গণমাধ্যম বড় হেডলাইন দিয়ে নিউজ করেছে। অথচ, সত্যতা হলো The Registance front (TRF) এর বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা এই ঘটনার সাথে জড়িত নই। বরং আমাদের নামে ভুয়া এডিট করা বিজ্ঞপ্তির প্রচারণা চালিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’।

আমরা কেউ স্বচক্ষে দেখিনি, হামলা কে করেছে! তবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, কাশ্মীরে অবস্থানরত ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীরা এই হামলার সাথে জড়িত। কেননা, ২০০২ সালে গুজরাট সবরমতী এক্সপ্রেসে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কামরায় আগুন দেওয়া নিয়ে দাঙ্গা। অথচ, আদৌ এই ঘটনার সুষ্ঠু কোনো তদন্ত প্রকাশ করেনি ভারত সরকার। ভারত সরকার এমন অনেক রহস্যময় ঘটনার তদন্ত প্রকাশ না করে নিজের দোষ ঢাকায় ব্যস্ত থাকে।

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা:

২২ এপ্রিল কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ২৩ এপ্রিল ভারত ঐতিহাসিক সিন্ধু চুক্তি স্থগিত, ভিসামুক্ত ভ্রমণ সেবা বাতিলসহ বর্ডার পারাপার বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়ায় ভারতের বিমান চলাচলে অর্থনৈতিক ধাক্কা পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় ২৪ এপ্রিল স্থগিত করে ঐতিহাসিক শিমলা চুক্তি। ২৪ ও ২৫ এপ্রিল ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখায় চলে গুলাগুলি। গুলাগুলি বন্ধ হয় ২৯ এপ্রিল। পাকিস্তান ভারতের একটি ড্রোন নিষ্ক্রিয় করে।

২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, আতঙ্কবাদী আশ্রয়স্থল ধ্বংসকারী গুরুতর শাস্তি আসন্ন। অন্যদিকে ২৮ এপ্রিল প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালাতে পারে বলে অবগত হয়েছি গোয়েন্দা সূত্রে। তাছাড়াও কাশ্মীরের পেহেলগামের এই ঘটনায় দুদেশের জনগণের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে! অনলাইন থেকে শুরু করে অফলাইনেও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা তুঙ্গে।

বিশ্ব প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তান উত্তেজনা:

দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর উত্তেজনা বিশ্বে বড় প্রভাব ফেলবে। তাই বিশ্ব মোড়লরা সমাধান চায়। আমেরিকা আপাতত ভারত-পাকিস্তানের সাথে আলাদা আলাদা কূটনৈতিক বৈঠক করা শুরু করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের মিত্র চীনের দাবি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। ইরান অবশ্য ভারত-পাকিস্তানকে মিলিয়ে দিতে সহায়তা করতে চায় বলে জানিয়েছে। সঊদী আরব, তুরস্কসহ জাতিসংঘ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে শান্তি ফিরে আসুক এমন বিবৃতি দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছে। কূটনৈতিক সমাধান। চীন নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান করেছে। ইরান দুই প্রতিপক্ষকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলেছে। সঊদী আরব, তুরস্ক, জাতিসংঘ শান্তির পক্ষে জোর দিয়ে আলোচনার কথা বলেছে।

যুদ্ধ নাকি নাটক?

বর্তমান সময়ে এমন ঘটনায় ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনাকে একদল বিশেষজ্ঞ পূর্বপরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব ইনশা-আল্লাহ। প্রথমে আমরা জানব কেন নাটক? বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য অনুযায়ী নিচে আলোচনা করা হলো—

শাক দিয়ে মাছ ঢাকা:

কাশ্মীর একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হলেও ভারতের সংবিধান নয়; বরং কাশ্মীরের সংবিধানে কাশ্মীর পরিচালনা হতো। কাশ্মীরের আলাদা পতাকাও ছিল। কেননা, ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরের জন্য আইনে বলা হয়, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ভারতীয় আইন প্রযোজ্য হতো। তাছাড়া কাশ্মীর আলাদা একটি রাষ্ট্রের মতোই স্বতন্ত্র নিয়মে চলত। কাশ্মীরে তখন ভারতীয় কেউ জমি কিনতে পারত না। কাশ্মীরের সেই ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয় ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। তার মধ্য দিয়ে কাশ্মীর ভারতের সংবিধান অনুযায়ী চলতে বাধ্য। তখন কাশ্মীরে ব্যাপক সেনা মোতায়েন করা হয়। যারা প্রতিবাদ করতে চায় তাদের ব্যাপক ধরপাকড় চলে। কাশ্মীরের নেতাদের গৃহবন্দী করা হয়। ভারত সরকারের যেকোনো আইন সংসদে পাশ করার পর এমন অত্যাচার করার অভ্যাস ইতিহাসেও পাওয়া যায়। কেননা, ভারত রাষ্ট্রটি চৈতন্যের থিউরিতে চলে।

বর্তমান সময়ে ভারত উত্তাল ওয়াকফ আইন নিয়ে। ওয়াকফ তথা মসজিদ-মাদরাসা কিংবা দ্বীনের স্বার্থে দান করে দেওয়াকে বুঝায়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকে ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগের পাতায়—ওয়াকফ শব্দটির উপস্থিতি আছে।

ভারতের প্রতিটি রাজ্যে ১টি করে মোট ৩২টি স্ট্রেট ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। প্রতিটি রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড তার নিজস্ব এলাকার দায়িত্ব পালন করে। ওয়াকফ বোর্ড স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি বোর্ড একটি আইনি সংস্থা।

১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় পরামর্শদাতা হিসেবে সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিল-এর সূচনা হয়। এটি ভারতের সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ভারতের ওয়াকফ আইনের ইতিহাস বলে, ভারত বিভিন্ন সময় ওয়াকফ আইন পরিবর্তন করেছে। যেমন: ১৯১৩ সালে ওয়াকফ ভ্যালেডেটিং আইন, ১৯২৩ সালে মুসলিম ওয়াকফ আইন, ১৯৫৪ সালে সেন্ট্রাল ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইন, ২০১৩ সালে ওয়াকফ আইন (সংশোধন)।

অবশ্য ভারতের ওয়াকফ বোর্ডের সম্পদ সম্পর্কে জানা যায়, ৮ লাখ ৭২ হাজার সম্পত্তি ভারতের ওয়াকফ বোর্ডের। সম্পত্তির মোট আয়তন ১০ লাখ একর। রেলওয়ে এবং সামরিক বাহিনীর পর সবচেয়ে বেশি জমির মালিক ওয়াকফ বোর্ড। ১৪.২২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য ১৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।

ওয়াকফ বোর্ডে নতুন আইন নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য যুক্ত করা বাধ্যতামূলক। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অমুসলিমরা প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে। ধর্মীয় কোনো কাজে নয়। শতাব্দী ধরে চলে আসা ওয়াকফ বোর্ডের ইতিহাসকে কলুষিত করেছে ভারত সরকার। যার ফলে ভারতের সংখ্যালঘু তথা মুসলিমরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।

ওয়াকফ আইন প্রসঙ্গে অন্যতম একটি আলোচিত আইন হলো, ওয়াকফ বোর্ডের সকল সম্পত্তির দলীল-দস্তাবেজ সরকারকে দেখাতে হবে। ইতিহাসের সেই হাজার বছরের দলীলগুলো কোথায় পাবে ওয়াকফ বোর্ড? এই সুযোগে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো আদালতে মামলা করছে, এই মসজিদ আগে মন্দির ছিল। এই খানকা আগে মন্দির ছিল। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, বুলডোজার দিয়ে গুজরাটে মসজিদ ভাঙা হচ্ছে। অবশ্য ওয়াকফ বোর্ডের ২৫০টিরও বেশি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। এত আলোচনা করার একটাই কারণ, ভারত যখনি কোনো যুলুম করে তখন ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা করে। বর্তমানে ভারতের মুসলিম ভাইদের উপর চলছে অকথ্য নির্যাতন। ওয়াকফ আইন ইস্যুতে পুরো ভারত এখনো উত্তাল। তাই এটা ভারতের পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা।

বিশ্লেষণ:

পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে আগেও উত্তেজনা হয়েছে। সর্বোচ্চ কয়েকদিন গুলাগুলির পর সব সমাধান হওয়া স্বাভাবিক। উপরে উল্লিখিত কথার ব্যতিরেকে যুদ্ধ হলে কী কী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা? আর যুদ্ধ কি কখনো সম্ভব?

এক কথায় ভারত কখনো যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। কেননা, ভারতের সেভেন সিস্টার্স-সহ কয়েকটি এলাকা আগে থেকে স্বাধীনতা চায়। সুযোগে সৎ ব্যবহার করতে কেউ দেরি করে না। তারাও সেই সুযোগটা নিবে। সর্বোপরি, আপাতদৃষ্টিতে পাঠক মনে একটাই প্রশ্ন জাগ্রত হয়, যুদ্ধ নাকি ভয়ংকর নাটক?

ইবনু মাসউদ

 অর্গানাইজার, রেনেসাঁ লিটারেচার অ্যান্ড কালচারাল ডিপার্টমেন্ট, রেনেসাঁ ফাউন্ডেশন।


Magazine