বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার পরিচয় : ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘ভালোবাসা’ শব্দদ্বয় আকারে ছোট্ট হলে এগুলোর উচ্চতা গগণচুম্বী, গভীরতা অতলস্পর্শী, ব্যাপ্তি বিশ্বময় এবং অনুরণন হৃদয় থেকে হৃদয়ে। ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘ভালোবাসা’-এর সমার্থক শব্দ হলো ভ্রাতৃত্ব, প্রেম, হৃদ্যতা, সখ্যতা ইত্যাদি। শব্দদ্বয়ের আরবী প্রতিশব্দ হলো— ‘বেলায়াত’, ‘উখুওয়াত’ ‘মুওয়াদ্দাত’, ‘খুল্লাতুন’ ‘মুহাব্বত’ ‘হুব্বুন’ ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলা হয় যথাক্রমে Love ও Friendship। অভিধানে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসাকে সমার্থক হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা উভয়টির উৎস স্বয়ং স্রষ্টা এবং ভিত্তি হলো বিশ্বাস।
পরিভাষায় একাধিক মানুষের গভীর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্ব। অন্যকথায়, দুইজনের গভীর আত্মিক সম্পর্কের অপর নাম বন্ধুত্ব। ভালোবাসার সংজ্ঞায় বলা হয়— মনঃপূত বস্তুর প্রতি হৃদয়ের আকর্ষণ। অন্যকথায়, কোনো কিছুর মধ্যে কোনো যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে তার প্রতি মনের আকর্ষণকে ভালোবাসা বলে। ভালোবাসার একান্ত দাবি হলো, যাকে ভালোবাসা হয় তার মনের চাহিদা অনুযায়ী চলা।
ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বের মাঝে আপাত দৃষ্টিতে পার্থক্য মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা এক অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত। কারণ বন্ধুত্ব ছাড়া ভালোবাসা হয় না, আবার ভালোবাসার স্পর্শহীন বন্ধুত্বও অস্তিত্বহীন। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার উপলব্ধি একেক জনের কাছে একেক রকম হলেও ব্যাপকার্থে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা হলো— পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, অধিকার, কর্মশক্তি, অনুপ্রেরণা, নৈতিক শাসন, দায়িত্ব, আমানত। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্রষ্টার বিশেষ দান, বন্ধুত্ব চির অম্লান, দুটি হৃদয়ের টান, পারস্পরিক সম্মান, বিশ্ববিজয়ী শক্তি, বেঁচে থাকার প্রয়াস, সুখ-শান্তির উৎস। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা হলো সহজাত মানবিক গুণ, মানব অস্তিত্বের মূল ভিত্তি, জীবনের অনিবার্য অনুসঙ্গ, পারস্পরিক কল্যাণ কামনা, এক সুতোয় গাঁথা দুটি প্রাণ, অসম্ভবকে সম্ভব করার মন্ত্রণা, পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করা, ভক্তি-শ্রদ্ধার তীব্র বিস্ফোরণ, স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ, মনের নিঃস্বার্থ সুন্দর অনুভূতি, আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা, ইপ্সিতজনকে কাছে না পাওয়ার যাতনা, ত্যাগের মহিমায় নিজেকে উজ্জীবিত করা, হৃদয় কন্দরে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য সুতোর টান, সত্য ও সুন্দরের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা, নিঃসংকোচে পাশাপাশি বসা আর একসাথে চলার অনুমতি, একজনের দুঃখ-কষ্টের সংবাদে অন্যের সমদুঃখ বা কষ্টের অনুভূতি, ফুলের সুভাস আর সূর্যের কিরণ, যাকে কোনোদিন ঢেকে রাখা যায় না।
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার গুরুত্ব :
(১) সহজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্য : জগতে জীবন মাত্রই ভালো লাগা আছে, ভালোবাসা আছে। অন্যান্য জীবে বা জড়ে স্বাধীন বিবেক-বুদ্ধি না থাকলেও তাদের পরস্পরের আচরণে ভালোবাসা সুস্পষ্ট। গবেষণার দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় সবকিছুর মধ্যেই ভালোবাসা নামক আকর্ষণ রয়েছে। মধ্যাকর্ষণ শক্তির আকর্ষণ দ্বারা আসমান-যমীনকে স্থিতিশীল রাখা হয়েছে। ভালোবাসার টানেই নদী ছুটে যায় সাগর পানে। আহ্নিক গতি হয়, জোয়ার-ভাটা হয়। পাখিরা গান গায়, ফুলেরা সৌরভ ছড়ায়। প্রজাপতি ছুটে চলে। জলপ্রপাত বয়ে যায়। ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর সবকিছু চলমান, বহমান ও আবর্তিত।
(২) স্রষ্টার সেরা দান : ভালোবাসা আল্লাহর সেরা দান। তিনি যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন সে ব্যক্তির ভালোবাসা মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে দেন। মানুষ আল্লাহর ভালোবাসা থেকে ভালোবাসা, দয়া, মায়ার শিক্ষা লাভ করেছে। রাসূলুল্লাহ a বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর একশটি রহমত আছে, যার মধ্য থেকে মাত্র একটি রহমত তিনি জিন, মানব, পশু ও কীটপতঙ্গের মধ্যে অবতীর্ণ করেছেন। ঐ এক ভাগের কারণেই হিংস্র জন্তু তার সন্তানকে মায়া করে থাকে...’।[1]
(৩) অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক : ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলো অবিচ্ছেদ্য ও চিরন্তন। মৃত্যুর পরও এ সম্পর্ক জারি থাকে। যেমন- রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই যাকে ভালোবাসে, সে তার সাথী হবে’।[2]
(৪) বন্ধুত্বের পরকালীন প্রতিদান : হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক যে সাত শ্রেণির লোক কিয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন— সেই দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।[3]
(৫) বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আল্লাহর নিয়ামত : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিলেন। অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)।
(৬) বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা অমূল্য সম্পদ : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি তাদের অন্তরসমূহে পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। যদি তুমি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে, তবুও তাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আল-আনফাল, ৮/৬৩)।
(৭) আল্লাহর ভালোবাসা লাভের মাধ্যম : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে যারা মহব্বত করে, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যারা উপবেশন করে, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যারা খরচ করে এবং আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে যারা পরিদর্শন করে, আমার ভালোবাসা তাদের জন্য ওয়াজিব (আবশ্যক) হয়ে গিয়েছে’।[4]
(৮) বন্ধুত্ব হলো নিরাপত্তার গ্যারান্টি : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে’ (ইউনুস, ১০/৬২)।
(৯) জান্নাত লাভের উপায় : আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মুমিন না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে’।[5]
(১০) সর্বোত্তম প্রভাবক : বন্ধু হলো সর্বোত্তম প্রভাবক। এক্ষেত্রে বিখ্যাত কবি শেখ সাদী রহিমাহুল্লাহ-এর কবিতাংশটি কতই না চমৎকার। তিনি লিখেছেন,
‘সংগীর গুণ পশিয়াছে মম মাঝে গো,
নইলে কাদায় সুবাতাস কি এতো পাইতে?’
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার মূলনীতি :
ইসলাম স্বভাবধর্ম। মানবতার কল্যাণে এর সকল বিধিবিধান প্রণীত। তাই স্বভাবধর্ম ইসলাম নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে।
(১) ভালোবাসার উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি : ভালোবাসা হবে শুধু আল্লাহর জন্য। এটিই ভালোবাসার সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান মূলনীতি। জগতের সব ভালোবাসা আবর্তিত হবে আল্লাহকে কেন্দ্র করে এবং শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য; যাতে থাকবে না কোনো লৌকিকতা ও কৃত্রিমতা এবং পার্থিব চাওয়া পাওয়া।
(২) ভালোবাসার ভিত্তি হলো ঈমান ও ইসলাম : ভালোবাসার ভিত্তি হলো ঈমান ও ইসলাম। সুতরাং যার মধ্যে ঈমান নেই, যে ব্যক্তি ইসলামের অনুসারী নয়, তার সাথে কখনোই অন্তরঙ্গ কোনো বন্ধুত্ব নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অন্যের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। ছালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তাআলা দয়া করবেন’ (আত-তওবা, ৯/৭১)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না’ (আলে ইমরান, ৩/২৮)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’ (আল মায়েদা, ৫/৫১)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ যে জাতির প্রতি রুষ্ট, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না’ (আল-মুমতাহিনা, ৬০/১৩)।
(৩) বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার পাত্র হলেন আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং ঈমানদারগণ : একজন মানুষ শুধু বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক করতে পারে তাঁর মহান স্রষ্টা আল্লাহর সাথে, তাঁর রাসূলের সাথে এবং তাঁর অনুগামী ও অনুসারী মুমিনদের সাথে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ— যারা ছালাত ক্বায়েম করে, যাকাত দেয় এবং বিনম্র’ (আল মায়েদা, ৫/৫৫)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘যারা আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাদেরকে তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না। হোক না এই বিরুদ্ধাচরণকারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা তাদের জাতি-গোত্র’ (আল-মুজাদালাহ, ৫৮/২২)।
(৪) সর্বোত্তম বন্ধু আল্লাহ তাআলা : যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ ঈমানদারদের বন্ধু (অভিভাবক)। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যান’(আল-বাক্বারা, ২/২৫৭)। এদিকে লক্ষ্য রেখেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জান-মাল দ্বারা আবূ বকর ইবনে আবূ কুহাফার চেয়ে অধিক কেউ আমার প্রতি ইহসান করেনি। আমি কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে অবশ্যই আবূ বকরকে গ্রহণ করতাম। তবে ইসলামের বন্ধুত্বই সর্বোত্তম’।[6]
(৫) মানুষের মাঝে সর্বোত্তম ভালোবাসার পাত্র রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের অপেক্ষা অধিকতর প্রিয়পাত্র হই’।[7]
(৬) পঙ্কিলতা ও কলুষতা থেকে পবিত্রতা : বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা হতে হবে নিষ্কলুষ এবং তা অবশ্যই পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবে। কারণ হারাম ও অবৈধ কাজের ক্ষেত্রে কোনো বন্ধুত্ব বা ভালোবাসার সুযোগ নেই। তাই ভালোবাসার নামে বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, জাস্টফ্রেন্ড কালচার এবং বিবাহবহির্ভূত অথবা বিবাহপূর্ব ছেলে-মেয়েদের নষ্টামি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, নিশ্চয় আমার প্রতিপালক আল্লাহ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতাকে হারাম করেছেন’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৩৩)। অশ্লীলতার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, যা ইসলামে হারাম। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/৩২)।
(৭) নাম-ঠিকানা ও পরিচয় জানা : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি কারো সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে সে যেন তার নাম, পিতার নাম ও গোত্র বা বংশের নাম জিজ্ঞেস করে নেয়। কেননা তা ভালোবাসার সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য খুব বেশি কার্যকরী হয়’।[8]
(৮) কৃত্রিমতা বর্জন : ভালোবাসার অন্যতম মূলনীতি হলো তা হবে নির্ভেজাল ও খাঁটি। তাতে কৃত্রিমতার কোনো স্থান থাকবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলিম নামধারী এবং মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী সন্তানদের অনেকেই উপরিউক্ত মূলনীতিসমূহকে অবজ্ঞা কিংবা অস্বীকার করে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার মতো ভয়ংকর ঈমানবিধ্বংসী খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের বিরাট অংশ অমুসলিম ও বিজাতীয়দের সাদৃশ অনুসরণে ব্যস্ত। তাদের বস্তাপচা সংস্কৃতি ও ক্রীড়াকৌতুকের সামগ্রীকে নিজেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করছে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো—
(ক) বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ও জাস্টফ্রেন্ড কালচার : বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ও জাস্টফ্রেন্ড কালচার পাশ্চাত্য থেকে আমাদানি করা বস্তাপচা সংস্কৃতি। এটি মুসলিমদের কোনো সংস্কৃতি নয়। ইসলাম বন্ধুত্বের নামে এসব নোংরামিকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। হাদীছে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা আছে, ‘কোনো পুরুষ যেনো কোনো (বেগানা) নারীর সাথে মাহরাম ব্যতীত একাকিত্বে না থাকে’।[9]
(খ) বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে অহেতুক মাতামাতি : প্রতি চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ফুটবল ও ক্রিকেটের আসর বসে। এ বিশ্বকাপকে ঘিরে মদ, জুয়া, ব্যভিচার ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ি দেখা দেয়। কোটি কোটি দর্শক তাদের মূল্যবান সময়, সম্পদ ও স্বাস্থ্য নষ্ট করে বৃথা উল্লাসে মেতে ওঠে। এ উন্মাদনা শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সীর মাঝেই কম-বেশি দেখা যায়। পক্ষ-বিপক্ষ সমর্থন, হার-জিত নিয়েও তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা ও বাড়াবাড়ির শেষ নেই। এ খেলাকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও ওয়ায মাহফিল ও তাফসির মাহফিল বন্ধের মতো দুঃখজনক ঘটনার সংবাদও শোনা যায়। এ খেলাকে কেন্দ্র করে বিবাহবিচ্ছেদ, স্ত্রীকে বাজি ধরা, আত্মহত্যা এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো গর্হিত কর্মের কথাও অহরহ শোনা যায়। অথচ এ ক্ষেত্রেও মুসলিম যুবক-যুবতি, তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতার বড় একটি অংশ ভুলে যায় বন্ধুত্ব সম্পর্কে ইসলামের সেই সুমহান নীতিমালা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যারা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও খেল-তামাশারূপে গ্রহণ করেছে’ (আল-মায়েদা, ৫/৫৭)।
(গ) থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন : ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখের দিবাগত রাতকে থার্টিফার্স্ট নাইট বলা হয়। এটি পশ্চিমা ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের একটি কালচার। তারা এদিনে আতশবাজি, পটকাবাজি, নাচ-গান, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদকসেবন, নারীর শ্লীলতাহানি, যেনা-ব্যভিচারসহ নানা পাপকাজের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করে। এ দিনে অবাধে ও প্রকাশ্যে চলে নারীর সতীত্ব হরণের মতো জঘন্য কাজ। এটি ইসলামিক সংস্কৃতি নয়। বরং মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে একটি একটি অপসংস্কৃতি। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্কলাররা ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ উদযাপনকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ এক্ষেত্রে মুসলিমদের বিরাট অংশ ভুলতে বসেছে ইসলামের সেই সর্তকবার্তা— ‘যে কোনো জাতির সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে (কিয়ামতের দিন) সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে’।[10]
(ঘ) সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবস উদযাপন : খ্রিষ্টানরা ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ উদযাপন করে। দিবসটির উৎপত্তি খ্রিষ্টীয় ও প্রাচীন প্রথা থেকে। খ্রিষ্টানদের কাছে এটি একটি মহৎ ও পবিত্র দিন। গির্জায় গির্জায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে এদিনে তারা তাদের যাজক ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’কে বিশেষভাবে স্মরণ করে। এ তারিখটি তাদের সংস্কৃতির অংশ। মধ্য ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ার কাউন্টির তরুণীরা এ দিনের মধ্যরাতে দলবেঁধে ৩ থেকে ১২ বার চার্চ প্রদক্ষিণ করত এবং সুর করে প্রেমগীতি আবৃত্তি করত। অর্থডক্স খ্রিষ্টানরা ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ উদযাপন করে ৭ জুলাই। তারাও এদিনে গির্জায় আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালন করে। দিবসটির অপর নাম ‘ফিস্ট অব সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’।
ভ্যালেন্টাইন নামের ব্যক্তিটি নিজেই রহস্যাবৃত। তাকে নিয়ে স্বয়ং খ্রিষ্টসমাজ দ্বিধাবিভক্ত। এই ভ্যালেনটাইনকে নিয়ে যত কাহিনী প্রচলিত আছে সবগুলোর ভিত্তিই হলো পৌরাণিক ও খ্রিষ্টধর্মীয় উপকাহিনী। কাহিনীগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি কাহিনী প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের অশ্লীল যৌনপূজার ধারা বহন করে। আর একটি কাহিনী একজন পৌলিয় ধারার খ্রিষ্টধর্মপ্রচারকের মাহাত্ম্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ যাকে আমরা ভালোবাসা বলে থাকি, এমন কোনো ভালোবাসার ব্যাপার অন্তত এই পৌরাণিক উপকাহিনীগুলোতে নেই। যাহোক, প্রচলিত কাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কাহিনীটি হলো— ‘সাম্রাজ্যবাদী, রক্তলোলুপ রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের দরকার ছিল এক বিশাল সৈন্যবাহিনীর। একসময় তার সেনাবাহিনীতে সেনা সংকট দেখা দেয়। কিন্তু কেউ তার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে রাজি ছিল না। সম্রাট লক্ষ্য করলেন, অবিবাহিত যুবকরা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে অত্যধিক ধৈর্যশীল। ফলে তিনি যুবকদের বিবাহ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। যাতে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ না করে। তার এ ঘোষণা দেশের অবিবাহিত তরুণ-তরুণীরা, যুবক-যুবতীরা মেনে নিতে পারে না। ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ নামের এক ধর্মযাজকও সম্রাটের এ নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে তিনি ভালোবেসে সেন্ট মারিয়াসকে বিয়ের মাধ্যমে রাজার আদেশকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার গির্জায় গোপনে বিয়ে পড়ানোর কাজ চালাতে থাকেন। একটি রুমে বরবধূ বসিয়ে মোমবাতির স্বল্প আলোয় ভ্যালেন্টাইন ফিস ফিস করে বিয়ের মন্ত্র পড়াতেন। এই ব্যাপারটা বেশি দিন গোপন থাকেনি। বিষয়টি একসময়ে সম্রাট ক্লডিয়াস জেনে যান। ভ্যালেন্টাইন ধরা পড়ে যান এবং কারারুদ্ধ হন। কারাবাসে তিনি এক কারারক্ষীর মেয়ের প্রেমে পড়েন। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মের একটি বিকৃত নীতি ছিল যে, ধর্মযাজকরা বিয়ে বা নারীদের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারবে না, সেহেতু ভ্যালেন্টাইন শেষমেশ এই প্রেম অস্বীকার করেন। খ্রিষ্টধর্মের প্রতি তার এই অনুরাগ দেখে সম্রাট তাকে একটি লোভ দেখান। তিনি প্রস্তাব দেন, তিনি ভ্যালেন্টাইনকে ক্ষমা করবেন এবং নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দেবেন এই শর্তে যে, তাকে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করতে হবে। ভ্যালেন্টাইন অস্বীকৃতি জানালে তাকে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একসময় গ্রিস খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করল। পৌত্তলিক বসন্ত উৎসবের নতুন নাম হলো ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। সাধু ভ্যালেন্টাইনের নতুন নতুন মহিমা শোনা যেতে লাগল যে, তিনি প্রেমের শহীদ, ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি’।
প্রকৃতপক্ষে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ নামে কোনো দিবস নেই। আমরা হুজুগে মাতালরা বেকুবের মতো ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’কে ‘বিশ্বভালোবাসা দিবস’ হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছি। এ দিবসটিতে ভালোবাসার নামে ‘মন্দবাসা’ও কম হয় না। তরুণ-তরুণীদের পরস্পরকে আহ্লাদিত করতে নির্দ্বিধায় চলে চুমোচুমি আর দেহপ্রদর্শনের নাটক। হাজার হাজার যুবক-যুবতী এ দিনে তার সতীত্ব ও চরিত্রকে বিসর্জন দিয়ে নিঃস্ব হয়ে ঘরে ফেরে। তাই অনেকে এ দিবসটিকে উল্লেখ করে থাকেন ‘বিশ্ব বেহায়া দিবস’, বিশ্ব নগ্নতা দিবস’, ‘বিশ্ব লুচ্চামি দিবস’ হিসেবে।
আবার, ঈমান ও ইসলামের অনুসরণ ও অনুকরণের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তিদের মধ্যেও ভালোবাসা নিয়ে মাতামাতি, বাড়াবাড়ির কমতি নেই। তাদের অনেকেই ভালোবাসাকে দল, মতবাদ, মাযহাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। তাদের অনেককেই বিভিন্ন ঠুনকো অজুহাতে কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের কারণে অথবা ফিক্বহী মাসআলার কারণে বা দলীয় ভিন্নতার কারণে মুমিনদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা-বিদ্বেষের বীজ ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সামান্য কারণে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং পরস্পরে শত্রুতে পরিণত হয়। অনেক সময় মুসলিম ভাইয়ের পরিবর্তে কোনো অমুসলিম বা শিরক ও বিদআতী আক্বীদাতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত লোককেও সাহায্য করে।
একজন ভালো বন্ধু হলেন রক্ষাকারী ছায়ার মতো। যে তা খুঁজে পেল সে যেনো একটি গুপ্তধন পেল। সুতরাং বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমাদেরকে ঈমান, ইসলাম, দ্বীনদারিতা, সুন্নাতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ, উদারতা, ন্যায়বোধ, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ, সৎকর্মশীলতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক সৌন্দর্য ও পবিত্রতা, রুচিশীলতা, আদর্শিক দৃঢ়তা, জ্ঞান ও বিচক্ষণতা, সততা, আখেরাতের কল্যাণ, স্থিরচিত্ততা, ধৈর্যশীলতা, ক্ষমাশীলতা, দৃঢ়তা, তাওয়াক্কুল, ওয়াদা পালন, আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়াসহ যাবতীয় নৈতিক উপযুক্ততার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, যার তাগিদ বিভিন্ন আয়াত ও হাদীছে উল্লেখ হয়েছে। তবে সর্বক্ষেত্রে এমন সব লোকদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে, যাদের সংশ্রব ও বন্ধুত্ব পরকালে আফসোসের কারণ হতে পারে। যেমন জাহান্নামীদের ভাষা উল্লেখ হয়েছে, ‘হায় আমার দুর্ভোগ! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/২৮)।
আল্লাহ তাআলা আমাদের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসাকে পরকালে নাজাতের অসীলা বানিয়ে দিন এবং প্রকৃত ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে স্রষ্টা, স্বজন, স্বদেশ, সংসার, সন্তান, স্বামী, স্ত্রীসহ সকল সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালনের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
মো. হাসিম আলী
সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৫২।
[2]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১২০১৩।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৫৭।
[4]. ছহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬৯০।
[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫৪।
[6]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৫৬।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/১৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৪৪।
[8]. তিরমিযী, হা/২৩৯২, হাদীছ ছহীহ।
[9]. শুআবুল ঈমান, হা/৫৪৪০।
[10]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৩১, হাসান।