কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : একটি পর্যালোচনা (পর্ব-২)

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অন্যান্য কারণ :

প্রথমত, ঐতিহাসিকভাবে গত কয়েকশ বছর থেকে কৃষ্ণসাগর রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণসাগরের উত্তর পাশেই অবস্থান করে ইউক্রেন। সুতরাং রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেন অনেক জরুরী। অতীতেও যারা রাশিয়াতে হামলা করেছে তারাই কৃষ্ণসাগর ব্যবহার করে ইউক্রেনের দরজা দিয়ে রাশিয়াতে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে। ইউক্রেনকে আমরা বাফার জোন বলতে পারি। রাশিয়া তার নিরাপত্তার জন্য আগাম প্রস্তুতিস্বরূপ তার বাফার জোনকে নিজের কন্ট্রোলে রাখতে চায়।

দ্বিতীয়ত, আমরা জানি যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে সঊদী আরব এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে রাশিয়া। আর গ্যাস উৎপাদনের দিক থেকে সারা পৃথিবীতে শীর্ষস্থানে অবস্থান করে রাশিয়া। পাশাপাশি পৃথিবীতে গম উৎপাদনের দিক থেকে ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশাল একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে গ্যাস নির্ভরতা সেই গ্যাসের প্রায় অর্ধেক চাহিদা পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া পূরণ করে। আর জ্বালানি তেলের প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি জ্বালানি পূরণ করে রাশিয়া। আর রাশিয়ার ব্যবসার ক্ষেত্রেও এই পাইপলাইন ধরে রাখা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে তার ওপর নির্ভরশীল করে রাখা জরুরী। এটিও রাশিয়ার রাজনীতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সমস্যা হচ্ছে এই গ্যাসের পাইপলাইনের সবগুলো ইউক্রেনের উপর দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে প্রবেশ করেছে। আর এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ইউক্রেন একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার ইউরোপীয় ইউনিয়নকেন্দ্রিক যত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল তার প্রায় সবগুলোই ইউক্রেনে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ইউক্রেন তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করে। ঠিক তেমনি রাশিয়ার পারমাণবিক চুল্লিগুলোরও একটা বিরাট অংশ ইউক্রেনে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন ইউক্রেন স্বাধীনতা লাভ করে তখন গ্যাস পাইপলাইনের জন্য রাশিয়াকে ট্রানজিট বিল পে করতে হয়। ট্রানজিট বিল নেওয়ার ক্ষেত্রে আর্ন্তজাতিক বাজারের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিল গ্রহণ করে ইউক্রেন।

পাশাপাশি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে রাশিয়ার অগোচরে পাইপলাইন থেকে গ্যাস ও জ্বালানি তেল চুরি করার। এই কারণেই রাশিয়া ইউক্রেনকে নিজের দখলে নিতে চায় যাতে তার গ্যাস ও জ্বালানি সাপ্লাই নির্বিঘ্নে ইউরোপে পৌঁছতে পারে এবং তাকে কেউ ব্লাকমেইল করতে না পারে।

তৃতীয়ত, আমরা জানি যে ইউরোপের দেশগুলো শীতপ্রধান দেশ এবং শীতকালে ইউরোপের দেশগুলোর সমুদ্রবন্দরগুলোতে বরফ জমে থাকার কারণে বড় বড় জাহাজ আমদানি-রপ্তানি হতে বাধাগ্রস্ত হয়। একমাত্র ক্রিমিয়াতে কিছু সমুদ্রবন্দর আছে যেখানে বরফ জমে না। বরফ না জমার কারণে এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের উপর ইউরোপের আমদানি-রপ্তানির বড় অংশ শীতকালে নির্ভর করে। এই কারণে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলে নেয়। কিন্তু ক্রিমিয়া দখল করার পর রাশিয়া যে বিপদে পড়ে সেটা হচ্ছে, ক্রিমিয়ার নিজস্ব কোনো মিঠা পানির উৎস নেই। নিজস্ব খাদ্যের উৎসও খুবই কম। ক্রিমিয়া সম্পূর্ণরূপে ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং ক্রিমিয়ার দখল টিকিয়ে রাখার জন্য রাশিয়া একপ্রকার বাধ্য হয়ে ইউক্রেনে অভিযান চালায়।

চতুর্থত, এই যুদ্ধের একটি পরোক্ষ কারণ হিসেবে বিশ্লেষকগণ পরিকল্পিত উস্কানিতে পা দেওয়াকে উল্লেখ করেছেন। অনেক গবেষকের ধারণা অনুযায়ী আমেরিকা-ইসরাঈলকেন্দ্রিক যে অন ওয়ার্ল্ড অর্ডার আছে যা কন্ট্রোল করে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক তারাই চাচ্ছে রাশিয়ার এই নতুন উত্থানকে যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে ফেলে ধ্বংস করে দিতে। যেমনভাবে হিটলারকে উস্কে দিয়ে পোল্যান্ড আক্রমণ করে হিটলারকে যুদ্ধে জড়িয়ে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক তেমনি রাশিয়ার নতুন উত্থানকে যদি তারা বড় একটা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে পারে এবং রাশিয়া মাথা গরম করে উত্তেজিত হয়ে যদি যুদ্ধকে আরও সম্প্রসারিত করে আরও দীর্ঘস্থায়ী করে তাহলে যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে করতে এক সময় রাশিয়া একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যেমন আজকে আফগানিস্তানে আমেরিকার অবস্থা।

এই জন্যই হয়তো আমেরিকা ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি সৈন্য পাঠাচ্ছে না, বরং বিভিন্ন অবরোধ দিয়ে রাশিয়াকে উস্কাচ্ছে। যাতে রাশিয়া নিজেই তাদের উস্কানিতে পা দিয়ে যুদ্ধকে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং আরও অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে ফেলে এবং এমনভাবে যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে যে, রাশিয়া যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে করতে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

রাশিয়ার গ্যাস পাইপলাইনের বলি যখন সিরিয়া :

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে অনেকটা স্পষ্ট হয় যে, পৃথিবীর যুদ্ধ-বিগ্রহের অনেকটা নির্ভর করে অর্থনীতির উপর। ঠিক সিরিয়ার বিষয়টিও যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে তার মূলে দেখা যাবে অর্থনীতি। রাশিয়ার গ্যাসের উপর থেকে ইউরোপের নির্ভরশীলতা কমানোর একটা রাস্তা হচ্ছে কাতার থেকে গ্যাস সংগ্রহ করা।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জ্বালানি এবং কাতারের গ্যাস ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরাসরি গ্রহণ করতে হলে তাকে অবশ্যই সিরিয়া হয়েই গ্রহণ করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে সিরিয়াতে যিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং এখনো আছেন বাশার আল-আসাদ তিনি সম্পূর্ণরূপে রাশিয়াপন্থি। আর রাশিয়া কোনোসময় চাইবে না যে, তার গ্রাহক হাতছাড়া হয়ে যাক। এই জন্য রাশিয়া বাশার আল-আসাদ সরকারকে টিকানোর জন্য সর্বতভাবে চেষ্টা করে। অন্যদিকে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো চেষ্টা করে বাশার আল-আসাদকে সরানোর জন্য। আরবের দেশগুলোও তাদের নিজস্ব অর্থনীতির স্বার্থে বিশাল ইউরোপের বাজার ধরার জন্য বাশারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

তথা সিরিয়ার যুদ্ধ আর ইউক্রেনের যুদ্ধ এই দুই যুদ্ধ প্রায় একই সূত্রে গাঁথা আর সেটা হচ্ছে রাশিয়ার গ্যাস নির্ভরতা।

এই দিকে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর উৎপাদন বাড়ানোর চাপ দিচ্ছে আমেরিকা। যদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো উৎপাদন না বাড়ায় তাহলে যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে সেটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। ফলত, তাদেরকে বাধ্যতামূলক রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। এই জন্য অনেক ইউরোপের দেশ রাশিয়া থেকে গোপনে তেল ক্রয় করছে মর্মে রিপোর্ট এসেছে।

যুদ্ধের ফলাফল কী হতে পারে?

যদি যুদ্ধে রাশিয়ার স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে ভালো কোনো সফলতার মুখ দেখে তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে চায়না-রাশিয়া জোটের উত্থান সুনিশ্চিত। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো রুবল বা ইয়ানে পৃথিবীর লেনদেন হতে পারে। ইতোমধ্যেই সঊদী আরবের যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান তাঁর নতুন তেল শোধনাগার চীনে স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে উদ্বোধন হবে এবং এই তেল শোধনাগার থেকে চায়না মুদ্রায় তেল বিক্রি হবে। এদিকে ভারতও রাশিয়া থেকে রুবলের বিনিময়ে তেল ক্রয় করছে। ইমরান খানও একই পদক্ষেপ নিলে আমেরিকার কোপানলে পড়ে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।

অন্যদিকে রাশিয়াকে সুইফট ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে বের করে দেওয়ার পরে সে চায়নার সি.আই.পি.এস সিস্টেমে প্রবেশ করেছে। তথা রাশিয়ার সাথে যারা লেনদেন করতে চাইবে তাদেরকেও এই সিস্টেমে আসতে হবে। এইভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়া-চায়নার প্রভাব বাড়বে।

তবে এখানে ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এই যুদ্ধ। তবে সেক্ষেত্রে চীনের একক উত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পতনের মাধ্যমে আমেরিকার উত্থান ঘটেছিল। কিন্তু যুদ্ধের বলি হিসেবে যুক্তরাজ্যের পৃথিবীব্যাপী রাজত্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখানেও রাশিয়া যুদ্ধের বলি হতে পারে। আর আমেরিকার পতনের মাধ্যমে চীনের উত্থান ঘটবে।

(চলবে)


আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; এম. এ. (অধ্যয়নরত), উলূমুল হাদীছ বিভাগ,
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

Magazine