কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইজরাঈল-ফিলিস্তীন যুদ্ধ যে কারণে শুরু হলো ও থামল!

পূর্বাভাষ : ইয়াহূদীদের বর্বরতা, পাশবিকতা ও হিংস্রতায় ফিলিস্তীনের মাযলূম মুসলিমদের রক্ত ফের ঝরছে। গত ২৯ মে ২০২১, সকাল ৮ ঘটিকা পর্যন্ত প্রাপ্ত সংবাদে এই সংঘর্ষে ২৪৮ জন ফিলিস্তীনী এবং ১২ জন ইজরাঈলী নিহত হয়েছে। ফিলিস্তীনী আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শত শত বাড়িঘর ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে, গত ২১ মে ২০২১, শুক্রবার থেকে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হবার পর এ পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে সেই সমঝোতা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠেনি।

হায়! ফিলিস্তীনীরা আজ নিজ দেশে প্রবাসী। বহু বছর যাবৎ নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা পথেপ্রান্তরে দেশ হতে দেশান্তরে উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আর তাদের যারা দেশের মাটি কামড়ে রয়েছে, তাদের উপরে চলছে ইয়াহূদীদের বর্বর নির্যাতন আর পাশবিক অত্যাচার। হত্যা-ধর্ষণ-অপহরণসহ এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা তাদের উপরে চলছে না। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয়— কবে শেষ হবে ফিলিস্তীনীদের ওপর এই নিষ্ঠুরতম অত্যাচার! কবে থামবে এই হত্যাযজ্ঞ! ওদের গগণবিদারী আহাজারি শোনার কি কেউ নেই? তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ কি নেই? কী ওদের অপরাধ, কী কারণে আজ ওদের এ করুণ অবস্থা? হ্যাঁ, কারণ একটাই— ওরা মুসলিম, ওরা ফিলিস্তীনী! মুসলিম না হয়ে অন্য কোনো জাতি হলে আজ হয়তো ওদেরকে এই জ্বলন্ত হুতাশনে জ্বলতে হত না। তখন ওদের উদ্ধারে এগিয়ে আসত ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান ও তাদের দোসররা।
ইয়াহূদী জাতির কলঙ্কময় ইতিহাস : ইয়াহূদীদের জাতীয় ইতিহাস হীনতা ও নীচতায় পরিপূর্ণ এক কলঙ্কময় ইতিহাস। একসময় এ জাতি ছিল আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অনুগ্রহধন্য। সমসাময়িক জাতিগোষ্ঠির উপর আল্লাহ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। অনেক নবী ও রাসূল তাদের মধ্যে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে এরা হয়ে উঠেছিল নাফরমান ও না-শোকর। কুরআন মাজীদে তাদের জাতীয় ইতিহাসের এই দুই ধারা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। একপর্যায়ে এরা এতই উদ্ধত হয়ে উঠল যে, আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করল। আল্লাহর বিধানসমূহ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করল, এমনকি আল্লাহর রাসূলগণকে হত্যা করল! এই চরম না-শোকরী ও নাফরমানীর কারণে এ জাতি হয়ে গেল ‘মাগযূব’— আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত। আর এরই প্রকাশ ঘটল এদের কর্ম, বিশ্বাস ও জাতীয় চরিত্রে। সংশয় ও কপটতা এদের বিশ্বাসের, শঠতা ও প্রতারণা এদের কর্মের এবং হীনতা ও হিংস্রতা এদের চরিত্রের শিরোনাম হয়ে দাঁড়ালো। আর সময় সময় এদের উপর নেমে এলো চরম শাস্তির খড়গ। এই ধারা অতি প্রাচীন। সূরা বনী ইসরাঈলের শুরুতে এর বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে। শেষ নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে এদের আচরণ তো সর্বজনবিদিত। অল্প কিছু মহাপ্রাণ ছাড়া যাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন, এরা সর্বদা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। একাধিকবার নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার অপচেষ্টাও তারা করেছে। কিন্তু আল্লাহ অলৌকিকভাবে তাঁর নবীকে রক্ষা করেছেন। এরপর হাজার বছর যাবৎ লাঞ্ছনা ও ভাসমান জীবনই ছিল এদের ভাগ্যলিপি। তবু এদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। সুযোগ পেলেই এরা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে পশ্চিমাদের যোগসাজশে ফিলিস্তীনীদের মাতৃভূমিতে ইজরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এরা আবার নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এরা আরব মুসলিমের রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। অথচ এরা দু’দিনও টিকতে পারত না যদি না পশ্চিমা সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা এরা পেত এবং যদি না মুসলিম বিশ্বের, বিশেষকরে মধ্য প্রাচ্যের ‘মুসলিম-নেতৃত্বে’র ভীরুতা ও নতজানুতা এবং স্বার্থ ও ক্ষমতার লিপ্সা এদের পথকে মসৃণ করত।
ফিলিস্তীন প্রকৃত অর্থে মুসলিমদেরই : ফিলিস্তীন কোনো অর্থেই ইয়াহূদীদের নয়; বরং ন্যায়সংগতভাবে মুসলিমদেরই যা উৎপত্তিগত ও ঐতিহাসিক-দলীল সূত্রে প্রমাণিত। ফিলিস্তীনের পূর্ব নাম ‘কেনআন’। নূহ আলাইহিস সালাম-এর পঞ্চম অধস্তন পুরুষের নাম ‘ফিলিস্তীন’। ‘ক্রিট’ ও ‘এজিয়ান’ সাগরের দ্বীপপুঞ্জ থেকে আগত ফিলিস্তীনীদের নামানুসারে এই অঞ্চল ‘ফিলিস্তীন’ নামে পরিচিত হয়। খ্রিষ্টানদের আগমনের বহু পূর্বেই এরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ফিলিস্তীনীরা ‘আগনন’ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং আরব বংশোদ্ভূত। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের অভ্যুদয়ের সাথে সাথে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আবূ বকর ও উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর সময়ে ১৩-১৭ হিজরী সনে ফিলিস্তীন সম্পূর্ণরূপে ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হয়।
উৎপত্তিগত দিক থেকে ফিলিস্তীন মুসলিমদের বলেই প্রতীয়মান হয়। একইভাবে আল্লাহ প্রেরিত বিভিন্ন বাণী, নবী প্রেরণ ও মাসজিদুল আক্বছা ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের কারণে এটা মুসলমানের নিকট অত্যন্ত সম্মানিত ও পবিত্র স্থান, যা রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। উল্লেখ্য, এই জেরুজালেম সমস্যার সমাধান যদি সেই ১৯৪৮ সালেই করা হতো তাহলে আজকের ফিলিস্তীনের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। মূলত এই দুর্দশার জন্য জাতিসংঘের বিলম্বিত, দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতিই দায়ী।
ইসলাম বৈরী শক্তির নীল নকশা : ইসলাম বৈরী শক্তি আজ শুধু ফিলিস্তীনী মুসলিম নয়, বরং সারা বিশ্বের মুসলিমদের কীভাবে নিধন করা যায় তার নীল নকশা বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে। এজন্য তারা এক মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে অপর মুসলিম রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখছে, এক মুসলিমকে অপর মুসলিমের বিরুদ্ধে লাগানোর ছক তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অতঃপর সংঘাত-যুদ্ধ বাধিয়ে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে এবং ঐ গোষ্ঠীগুলোর কাছে আবার অস্ত্র বিক্রি করছে। কখনো নির্যাতিত মুসলিমদের প্রতি কিছু লোক দেখানো মানবিক সাহায্য ও পরামর্শ দিয়ে তাদের নিকটতম বন্ধু হিসাবে নিজেদের উপস্থাপন করছে। ফিলিস্তীনী মুসলিমগণ আজ তাদের নিজ ভূমিতেই ‘সন্ত্রাসী’! কারণ তাঁরা আপন ভূমির অধিকার ছাড়তে প্রস্তুত নন! পক্ষান্তরে জবরদখলকারী ইয়াহূদী জাতিই হচ্ছে ‘সন্ত্রাস’ দমনকারী!
ব্রিটিশ ও আমেরিকাসহ খ্রিষ্টান বিশ্বের প্রত্যক্ষ মদদ : ইজরাঈল শুরু থেকেই ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের প্রত্যক্ষ মদদ পেয়ে আসছে। আরব-ইজরাঈল যুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যরা ইজরাঈলের পক্ষে যুদ্ধ করেছে বলেও জানা গেছে। এখনো যখন ইজরাঈল ফিলিস্তীনীদেরকে হত্যা করে, নারী-শিশুদেরও হত্যা করে, ধরে নিয়ে যায় এ নিয়ে জাতিসংঘ ইজরাঈলের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব আনলে আমেরিকা ভেটো দেয়। আত্মরক্ষার অধিকারের ধোঁয়া তুলে সরাসরি ইজরাঈলকে রক্ষা করে। জাতিসংঘের আইন, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ আইন সব কিছুই তারা নিয়মিত লঙ্ঘন করে। কিন্তু তাতে তাদের কোনো কিছুই হয় না। কারণ তাদের আমেরিকা আছে। তারা প্রকাশ্যেই ইজরাঈলকে রক্ষা করে চলেছে, একদম নগ্নভাবে।
বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশে ইজরাঈলীদের জন্য ভিসা ফ্রি। নামিদামি ইউনিভার্সিটিগুলোতে তারা স্কলারশিপ পায়। এর বাইরে আবার প্রায় সব বড় বড় কোম্পানির বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট আছে ইজরাঈলে। তারা তাদের শিক্ষা, গবেষণা, ট্যুরিজম ইত্যাদি খাতে ইনভেস্ট করে। অন্যদিকে ফিলিস্তীনীরা আগামীকাল পর্যন্ত তাদের বাড়িটা সংরক্ষিত থাকবে কিনা জানে না। প্রাণ থাকবে কিনা সেটাও জানে না। স্কুলটা থাকবে কিনা তাও জানে না। রাতবিরাতে এসে তল্লাশী চালিয়ে ইজরাঈলী পুলিশ যাকে তাকে ধরে নিয়ে যায় তার আর রক্ষা নেই, সে অল্পবয়সী শিশু হলেও।
ফিলিস্তীনীদের সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশ ফোর্স রাখারও অনুমতি নেই। ফিলিস্তীনী সিকিউরিটি ফোর্স নামে একটা বাহিনী আছে, তাদের ভারী কোনো অস্ত্র রাখার অনুমতি নেই। ইজরাঈলের সাথে এক চুক্তিতে এটা মেনে নেয় ইয়াসির আরাফাতের পিএলও। ফলে মাহমূদ আব্বাস প্রেসিডেন্ট পদের পদাধিকারী হলেও কার্যত তার কোনো ক্ষমতা নেই। ধর্ম-বর্ণ এবং ভাষা-ভূখণ্ড নির্বিশেষে সকল কুফরী শক্তি যে এক জোট ও এক মিল্লাত, তার বড় সুস্পষ্ট উদাহরণ এসকল ঘটনা।
ইজরাঈল দখল করতে করতে ফিলিস্তীনকে এমনভাবে দখল করেছে— একপাশে গাযা উপত্যকা, অন্যপাশে পশ্চিমতীর। মাঝখানে ইজরাঈল। ব্যাপারটা অনেকটা পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পশ্চিম তীর আর গাযা, মাঝখানে ভারতের মতো ইজরাঈল। মনে করার সুবিধার্তে, গাযা হচ্ছে বাংলাদেশ, পশ্চিম তীর পাকিস্তান। মাঝখানে ভারত হচ্ছে ইজরাঈল (ভৌগোলিক অবস্থান বা ম্যাপ বুঝার সুবিধার্তে বলা)।
গাযা উপত্যকায় খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ওষুধসহ সবকিছুই চোরাই পথে আনতে হয়। ইরান চোরাইপথে অস্ত্র আর কাতার টাকা দেয়। এর বাইরে তুরস্ক সমুদ্রসীমা আর ইজরাঈলী সীমা ব্যবহার করে জাহাজভর্তি খাবার, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য গাযায় পৌঁছে দেয়। একবার তুরস্কের একটা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল ইজরাঈল। সঊদী আরবসহ অন্যান্য আরব দেশ তাদের দানের একটা বড় অংশ ফিলিস্তীনে পাঠায়। তবে সেটা গাযায় নয়, বরং পশ্চিম তীরে যায়।
ইজরাঈল হামাসকে বারবার বলছে— তোমরা যদি আমাদের শর্ত মেনে নাও, সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করো, অস্ত্র সমর্পণ করো, নিরস্ত্র হও, তাহলে তোমাদের অবরোধ আমরা তুলে নেব। তোমরা যেখানে চাও, যেতে পারবে। আমাদের এখানে চাকরি করতে পারবে। যা কিনতে চাও, তা কিনতে পারবে। মাহমূদ আব্বাসের পিএলও পশ্চিম তীরে এই শর্ত মেনে নিলেও ইসমাঈল হানিয়া আর খালিদ মিশালের গাযা উপত্যকার হামাস সেটা মেনে নেয়নি। যার কারণে তারা অবরুদ্ধ। এই কারণে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তীনীরা ইজরাঈলের দিকে ঢিল আর পাথর ছুঁড়লেও গাযা উপত্যকার ফিলিস্তীনীরা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে, ইজরাঈলের দিকে মিসাইল ছুঁড়ে।
যদিও ইজরাঈলী অত্যাধুনিক ডিফেন্স সিস্টেম আইরন ডোম ফিলিস্তীনীদের এই মিসাইল আকাশে থাকতেই ধ্বংস করে। তবে এবার ইজরাঈলের আইরন ডোম হামাসের সব মিসাইল আটকে দিতে সক্ষম হয়নি। অনেকগুলো মিসাইল ইজরাঈলের বিভিন্ন শহরের রাস্তা এবং ভবনে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এতে ইজরাঈলসহ তাদের মিত্ররা বেশ অবাক হয়েছে। আইরন ডোম কতটা আঘাত ঠেকাতে সক্ষম সেটা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। কারণ হামাসের মিসাইলগুলো কোনো অত্যাধুনিক মিসাইল নয়। এগুলো তারা পাইপ এবং অন্যান্য পরিত্যক্ত জিনিসপত্র থেকে বানায়। এই হ্যান্ডমেইড রকেটগুলোর আঘাত হানার পর আইরন ডোম নিরাপত্তাদানে কতটা সক্ষম, সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ জানায়, গাযায় ইয়াহূদীদের তাণ্ডব চলাকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইজরাঈলের কাছে ৭৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে বারবার ভেটোক্ষমতা প্রয়োগ করে ইজরাঈলকে উদ্ধত বানিয়েছে এবং ফিলিস্তীনীদের রাখতে চায় দমিয়ে। শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদদে ইজরাঈল বেপরোয়াভাবে ফিলিস্তীনে গণহত্যা চালানোর সাহস পাচ্ছে, এ সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
গাযার বড় বড় ভবন ধ্বংস ও মানবতার সবক : গত ১০ মে, ২০২১ বোমা বর্ষণের পর থেকে গাযার ছয়টি হাই রেইজ ভবনের সবগুলোই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হামলায় অন্তত ১৮৪টি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন ধ্বংস করা হয়েছে। আর মিডিয়ার ৩৩টি অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইজরাঈলী বিমান হামলায় আল-জাযিরা ও এপির অফিস-সংবলিত ভবন আল-জালা টাওয়ারও ধ্বংস হয়ে গেছে। ইজরাঈল সাফাই হিসাবে বলছে, এখান থেকে হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহসেন আবূ রামাদান বলেন, বেসামরিক এলাকা ও অবকাঠামো ধ্বংস করা ইজরাঈলের নতুন কোনো কৌশল নয়। আগের হামলাগুলোতেও তারা কাজটি করেছে। তিনি বলেন, তবে এবার করা হয়েছে অনেক বেশি। আবূ রামাদান আরও বলেন, এসব টার্গেট সাধারণ মানুষের ওপর ভয়াবহ প্রভাব সৃষ্টি করে। ইজরাঈল মনে করছে, এই ক্ষতির ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা হামাসকে ইজরাঈলে রকেট হামলা বন্ধ করতে চাপ দেবে, হামাসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে। আর তাতেই লাভবান হবে ইজরাঈল। তবে, গাযা সিটির মেয়র ইয়াহইয়া আল-সারাজ বলেন, গাযার ভয়াবহ ক্ষতি করে ইজরাঈল চাচ্ছে আমাদের জনগণের মনোবল, দৃঢ়প্রত্যয় গুঁড়িয়ে দিতে।
এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটল, যখন গাযা সীমান্তের চেকপোস্টগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং বিদেশি সাংবাদিকদের গাযায় ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও ইজরাঈল বলছে, ঐ ভবনে হামাসের গোয়েন্দা শাখার একটি অফিস ছিল। কিন্তু এপি’র নির্বাহি সম্পাদক এই অভিযোগের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তবে, বুঝতে বাকি নেই— সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতেই ইজরাঈলের এই নগ্ন হামলা।
আপনি চিন্তা করুন— বাক-স্বাধীনতা, মত-প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলতে বলতে যারা সর্বক্ষণ বুলি আওড়ায়, তাদেরই এক অন্তরঙ্গ রাষ্ট্র বিশ্ব-মিডিয়ার একটা অফিস গুঁড়িয়ে দিয়েছে ঘোষণা দিয়ে! কিন্তু তবুও, আপনি সেই ইজরাঈলের পক্ষেই সাফাই গাওয়া দেখবেন। তাদেরকে বিজ্ঞান-বান্ধব, উদার, গণতন্ত্রমনা, আধুনিকসহ নানান তকমা দিয়ে মহান আর গরীয়ান করে না তুললে আপনার চারপাশে থাকা সেক্যুলার-আধা সেক্যুলার-নাস্তিকদের জাত চলে যায়। এরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু ইজরাঈল-আমেরিকার পারমাণবিক শক্তিকে পূঁজো দিতে এরা সদাসর্বদা প্রস্তুত।
কথাটা সুন্দর, উপদেশটা যথার্থ নয় : কেউ কেউ বলছেন, ‘মুসলিমদের জ্ঞানে-বিজ্ঞান চর্চা বাড়াতে হবে, নচেৎ কেবল পাথর ছুঁড়ে আর দু‘আ করে আমেরিকা-ইজরাঈলকে ঘায়েল করা সম্ভব না’। কথাটা সুন্দর, কিন্তু উপদেশটা যথার্থ নয়। কারণ, মুসলিমরা বিজ্ঞান চর্চা বাড়াতে না পারার পেছনে কি কেবল ‘মুসলিমরাই’ এককভাবে দায়ী? একটা গোষ্ঠীকে ‘ওয়ার অন টেরর’ তকমার আওতায় এনে কোণঠাসা করে রাখবেন, আতশবাজির মতো করে দিনরাত তাদের ঘরবাড়ির ওপরে বোমা ফেলবেন আর আশা করে থাকবেন যে তারা তাদের চোখ-মুখ ল্যাবরেটরির অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ডুবিয়ে রাখবে? সম্ভবত, জীবন এতটা সহজ আর সাবলীল নয়। আপনি বলতে পারেন, ওয়ার অন টেরর তো সেদিনের ইস্যু, এর আগে কি তবে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বজয় করেছিল? ওয়ার অন টেরর ইস্যু না হয় কাল-পরশুর, কিন্তু বিজ্ঞান, ক্ষেত্রবিশেষে শত্রুকে জবাব দেওয়ার জন্য যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সক্ষমতা দরকার, সেই সক্ষমতা অর্জনে মুসলিমদের দমিয়ে রাখার চক্রান্তটা সম্ভবত আজ-কালকের নয়, বহু পুরনো। মোসাদ কর্তৃক ফিলিস্তীন, সিরিয়া, ইরান-আফগানিস্তানের বিজ্ঞানীদের হত্যার অভিযোগটাও অনেকটা প্রতিষ্ঠিত বিষয়।
স্বীকার করছি মুসলিমদের নিজেদের উদাসীনতা, নিজেদের মধ্যকার দলাদলি-কোন্দল বিজ্ঞান চর্চায় তাদের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ, কিন্তু বিশ্ব-মোড়লদের পরোক্ষ দায়টাকেও এখানে ছোট হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশে দেশে যে অস্থিরতা, সেই অস্থিরতা টিকিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাছিল করে নেওয়া গোষ্ঠীটা কীভাবে চাইবে যে, শত্রুপক্ষ তার সমান সক্ষমতা লাভ করুক?
প্রায় চার বিলিয়ন ডলার বার্ষিক সামরিক সহায়তা, বিলিয়ন ডলারের শিক্ষা এবং রিসার্চের ইনভেস্টমেন্ট, প্রায় ভিসা ফ্রি ট্রাভেল, নামি ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের একনিষ্ঠ মদদ এত কিছু পাওয়া ইজরাঈলের সাথে অবরুদ্ধ ফিলিস্তীনের তুলনা করার সময় আপনারা যারা ‘ইজরায়েল জ্ঞান বিজ্ঞানে কত এগিয়েছে অথচ ফিলিস্তীন জ্ঞান বিজ্ঞানে আগায় নাই কেন?’ বলেন, আপনাদের লজ্জা করে না?
হামাসের পাল্টা আক্রমণ ও মুসলিমদের চিন্তার দৈন্যতা : ইজরাঈলের আক্রমণের বিপরীতে হামাস এবার অন্তত কিছুটা হলেও পাল্টা আক্রমণের দিকে ঝুঁকেছে। দিন কয়েক আগে ফিলিস্তীনের রকেট হামলায় তেলআবিবসহ ইজরাঈলের অনেক শহর বেশ ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়ে। আমাদের কিছু সুশীল শ্রেণির মানুষ বলছেন, এমন ধারার আক্রমণ করে ফিলিস্তীন নিজের বিপদ বড় করা ছাড়া আর কিছুই করছে না। ইজরাঈল যদি পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিলিস্তীন আক্রমণ করে, রাতারাতি তারা ফিলিস্তীনকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। যেহেতু ইজরাঈলের সাথে লড়বার সক্ষমতা নেই, ফিলিস্তীনের উচিত নয়, এ ধরনের আক্রমণগুলোতে যাওয়া। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, ইজরাঈলের আর্মিরা এতদিন গোলাপ ফুল, চকোলেট আর নীল খামে ভরা প্রেমপত্র নিয়ে ফিলিস্তীন সীমান্তে মধুর অপেক্ষায় থাকত আর ফিলিস্তীনীদের দেখামাত্রই ভালোবাসা নিবেদনে ব্যাকুল হয়ে পড়ত। এই প্রথম ফিলিস্তীনীদের কোনো আচরণে ইজরাঈল মনে অনেক কষ্ট পেয়ে ছে এবং প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভালোবাসার মানুষটিকে কুসুম কুসুম আঘাত করছে! ইনছাফের লড়াইয়ে সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরী সেটা হলো সাহস। রাত্রিবেলায় মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া একটা জাতিকে আপনি উপদেশ দিচ্ছেন শত্রুর দিকে পাথর না ছুঁড়ে, তার গুলিকে বুকে পেতে নিতে? এটাই আপনাদের সাম্যবাদী লড়াই আর মানবতার মূল সবক?
মন্তব্য : ফিলিস্তীনে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনের রক্তক্ষরণে আমাদের হৃদয়ে কতটুকু বেদনা জাগছে তা তিনিই জানেন যিনি অন্তর্যামী। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ঘটনা-ধারা কুরআনের বর্ণনাকেই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ঈমানী চেতনায় জাগরণ, দ্বীনী পরিচয়ে ও ভ্রাতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ আমাদের সামনে নেই।
ইজরাঈলের সাথে দীর্ঘ ১১ দিনের সংঘর্ষের পর গাযায় মানবিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে— বলেছেন খোদ জাতিসংঘের কর্মকর্তারাই। ফিলিস্তীনে যুদ্ধ বিরতি (?)। অনেকে খুশী হয়েছেন। আমিও খুশী হয়েছি। কিন্তু যে ক্ষতিটা হলো জানমালের, সেটা কি ইজরাঈল ফেরত দিবে? দিতে পারবে? আর যুদ্ধ বিরতিই কি ইজরাঈল-ফিলিস্তীন সমস্যার শেষ সমাধান? না, কখনোই না।
স্মর্তব্য যে, মুসলিমদের ন্যায্য অধিকার অন্য কেউ আদায় করে দিবে না। মুসলিমদেরকেই তা আদায় করতে হবে। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করাও এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরী। আল্লাহ আমাদের মাযলূম ফিলিস্তীনী ভাই-বোনদের রক্ষা করুন এবং মাসজিদুল আক্বছাকে হেফাযত করুন— আমীন!
হে আল্লাহ! আমাদের মাযলূম ভাই-বোনদের সাহায্য করুন। যালিমের যুলুম থেকে তাদের রক্ষা করুন এবং আবার আমাদের জাগিয়ে দিন। ঈমান ও আমলের যে সম্পদে ও হাতিয়ারে আমাদের পূর্বসূরীগণ সমৃদ্ধ ছিলেন, সেই সম্পদ ও হাতিয়ার আবার আমাদের দান করুন— আমীন!

Magazine