ককেশাস অঞ্চল : মুসলিমদের উপর যুলুমের দাস্তান
ককেশাস মূলত একটি পাহাড়ের নাম। যাকে আরবীতে কোকায (القوقاز) বলা হয়। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে পার্থক্য সৃষ্টিকারী একটি সিরিয়াল পর্বতমালার নাম ককেশাস। এই পর্বতমালাকে ঘিরেই আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, চেচনিয়া ও দাগিস্তান নামক দেশগুলোতে বহু দিন ধরে মুসলিমরা বসবাস করে আসছে। গত দীর্ঘ ৪০০ বছর যাবৎ জার, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়া নিজ নিজ শাসন আমলে এই অঞ্চলের মুসলিমদের উপর যুলুম-অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলের মুসলিমদের উপর এমন অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে বলে ইতিহাসের পাতায় আমাদের দেখা নেই। এই অঞ্চলের মুসলিমদের আলোচনা ছাড়া রাশিয়ার আলোচনা অপূর্ণাঙ্গ। নিম্নে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করছি।
ককেশাস স্বাধীনতার শুরু :
আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, চেচনিয়া অঞ্চলের হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মুসলিমের বহু দিন থেকে অন্তরের স্বপ্ন যে, তারা একটি স্বাধীন দেশে বসবাস করবে। সর্বপ্রথম যিনি এই অঞ্চলের মুসলিমদের নিয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার নাম শেখ আল-মানছূর। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি এসব অঞ্চলের মানুষদেরকে একত্রিত করে তৎকালীন রুশ জার সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এর বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করেন। তৎকালীন জার সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট এই মহান মুজাহিদকে বন্দি করে নিয়ে গিয়ে ক্রেমলিনে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেন এবং মুসলিমদের জিহাদ আন্দোলনকে দমানোর কঠোর ও ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালান। তবে যখন নেপোলিয়ান রাশিয়া আক্রমণ করে তখন কিছুদিনের জন্য মুসলিমদের উপর অত্যাচার বন্ধ থাকে।
১৮০০ শতাব্দীর দিকে এই অঞ্চলের মুসলিমদেরকে নিয়ে পুনরায় স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য জিহাদ আন্দোলন শুরু করেন ইমাম শামিল। তাকে চেচনিয়া অঞ্চলের মুসলিমদের সিংহ বলা হয়। তিনি তার সফলতার স্বীকৃতির জন্য তৎকালীন উছমানীয় খেলাফতের সহযোগিতা চেয়েছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সেই সময় তাকে স্থানীয় খেলাফত সহযোগিতা করেনি। উছমানীয় খেলাফতের সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে ইমাম শামিল রহিমাহুল্লাহ নিশ্চিত বিজয় হাতছাড়া করেন। দ্বিতীয়বারের মতো ককেশাস অঞ্চলের মুসলিমদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সফল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রাশিয়া ইমাম শামিলকে বন্দি করে নিয়ে যায়। ইমাম শামিলের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার শেষ ইচ্ছা পূরণে তাকে সঊদী আরবের হিজাযে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উল্লেখ্য, জার শাসনামল পতনের সময় এবং কমিউনিজমের উত্থানের সময় এ অঞ্চলের মুসলিমরা কিছুটা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন হওয়ার পর বাধ্যতামূলকভাবে এই অঞ্চলগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জোসেফ স্ট্যালিন মুসলিমদেরকে সন্দেহ করে এবং সে মনে করে মুসলিমরা তার বিরুদ্ধে গোপনে সহযোগিতা করছে। রাশিয়ার বিরোধীদের সহযোগিতা করার অভিযোগে লক্ষ লক্ষ চেচেন দাগিস্তানী ও ইঙ্গুশ মুসলিমদের নির্বাসন দেওয়া হয়। শীতের বরফঢাকা রাস্তায় হাজারো মুসলিম মারা যায় এবং গৃহহীন হয়ে পড়ে।
প্রথম চেচেন যুদ্ধ :
জোসেফ স্ট্যালিন মৃত্যুপরবর্তী শাসকগণ চেচেনদের ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন। নব্বইয়ের দশকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে, তখন পেছনের মুসলিমরা পুনরায় স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়ার জন্য রাশিয়ার বাইরে গিয়ে গণভোটের আয়োজন করে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা আসার পর রাশিয়া এই স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা মানতে পারেনি। তারা তখন এই স্বাধীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে। ইতিহাসের পাতায় যাকে প্রথম চেচেন যুদ্ধ বলা হয়।
এই প্রথম যুদ্ধে রাশিয়া ভয়ংকরভাবে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতে আক্রমণ করে এবং এক সপ্তাহব্যাপী চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতে লুটতরাজ, মারপিট ও ধর্ষণ-গণহত্যা চালায়। যা পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম জঘন্যতম ঘটনা বলে পরিচিত। কিন্তু রাশিয়া কখনও কল্পনা করেনি যে, চেচনিয়ার মুজাহিদগণ সাহসিকতার সাথে এত শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। সেই যুদ্ধে চেচেন মুজাহিদগণ এতটাই ভয়ংকর প্রতিরোধ গড়ে তুলে, যা রাশিয়ার মতো সুপার পাওয়ার এর জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আরব মুজাহিদ ইবনুল খাত্ত্বাব স্থানীয় মুজাহিদ শামিল বাসায়েভ এবং আফগান মুজাহিদদের সহযোগিতায় রাশিয়ার মতো সুপার পাওয়ারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। রাশিয়া চেচেনের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। সৈন্য প্রত্যাহারসহ চেচেনদের সকল শর্ত মেনে নেয়। তখন চেচেনের প্রধানমন্ত্রী হন সালিম খান ইন্দারায়েভ।
দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ ও ভ্লাদিমির পুতিন :
শাসনক্ষমতা গ্রহণ করার পর সালিম খান ইন্দারায়েভ জানান, তিনি আশেপাশের মুসলিম এলাকাগুলোকে বিশেষ করে দাগিস্তান অঞ্চলকে চেচেনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। তার এই চিন্তা রাশিয়ার পছন্দ হয়নি। তার এই চিন্তাকে রাশিয়া তার নিজের জন্য হুমকি মনে করে। ফলে পুনরায় রাশিয়া চেচেনে হামলা করে। এবার যুদ্ধের দায়িত্ব প্রদান করা হয় বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। তিনি ইতিহাসের ভয়ংকরতম আক্রমণ চালান চেচেনে। নৃশংসভাবে বিমান হামলা চালিয়ে অসংখ্য বেসামরিক লোককে হত্যা করেন। কূটনীতি ও সমরনীতি উভয়দিক থেকে চেচেনকে পরাস্ত করার জন্য বদ্ধপরিকার ছিলেন তিনি। কূটনীতির জন্য রমজান কাদিরভের বাবা আহমাদ কাদিরভকে বাছাই করেন। তাকে কাঠপুতলি হিসেবে ক্ষমতায় বসিয়ে স্বাধীনচেতা নেতাদেরকে গুপ্ত হত্যা শুরু করে রুশ।
যেমন আহমাদ কাদিরভ নেতৃত্ব লাভের পর সালিম খান ইন্দারয়েভে পাকিস্তান হয়ে আরব আমিরাত হয়ে কাতারে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে পুতিনের গোয়েন্দাবাহিনী গুপ্ত হামলায় সালিম খানকে হত্যা করে। এছাড়া চেচেন স্বাধীনচেতা মুজাহিদগণের মধ্যে অন্যতম সাহসিনী বোন আমিনা উকুয়োভাকেও পুতিনের গোপনবাহিনী গুপ্ত হামলায় হত্যা করে।
উপসংহার :
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা এটাই বুঝাতে চেয়েছি যে, রাশিয়ার একচেটিয়ে সমর্থন কোনো মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। যেখানে রাশিয়ার হাতে চেচেন নিরপরাধ বেসামরিক মুসলিমদের রক্ত লেগে আছে। যদিও বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়া যাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সেই আমেরিকা-ইউরোপ-ইসরাঈলই বর্তমানে মুসলিমদের সাথে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করে আসছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো সুপার পাওয়ার আমাদের বন্ধু নয়। সেই যুগে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন রোমান বা পারস্য কাউকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করেননি, বরং তাদের বিজয় করার স্বপ্ন দেখেছেন। মুসলিমদেরকেও সুপার পাওয়ারের সহযোগিতা নেওয়ার হীনম্মন্যতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে সকল সুপার পাওয়ারকে বিজয় করার। আর এটাই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক