কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

শিক্ষাব্যবস্থায় ধস : জাতির গন্তব্য কোথায়?

বলা হয়, ‘Education is the backbone of a nation’ অর্থাৎ ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। সত্যিই কি শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড? তা বিবেকের কাছে প্রশ্ন! বিজ্ঞজন বলছেন, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ নয়; বরং ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। তা যাই হোক‌। শিক্ষা নিয়ে আমাদের চিন্তার গভীরতা ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা বিবেচনা করা সময়ের যথার্থ দাবি। শিক্ষা নিয়ে বড় বড় পণ্ডিতদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল তা খতিয়ে দেখা দরকার।

কেবল সুশিক্ষাই মানুষকে সকল সৃষ্টি থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও মহীয়ান করে তোলে। নিকষ আঁধার চিরে ‘পড়ো’-এর উজ্জ্বল আলোর ফিনকিতে মানুষ গড়ে ওঠে আলোর, সত্যের ও সোনার মানব হয়ে। কবি ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, ‘সূর্যের আলোতে যেরূপ পৃথিবীর সবকিছু পরিস্ফুটিত হয়ে ভাস্বর হয়, ঠিক তেমনি জ্ঞানের আলোতে জীবনের সকল অন্ধকার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে’।
শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই বল। উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণের একমাত্র পথ ও পন্থা হলো শিক্ষা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নির্বিশেষে শিক্ষাই মানব জীবনকে পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও সমাজ পরিবর্তনের এক নির্ভীক চির জাগ্রত রাহবার তৈরি করে। শিক্ষাবিহীন জাতি বিকলাঙ্গ, অধম, মৃতপ্রায়। শিক্ষাবিহীন জাতি হলো বর্বর, অবিবেচক। শিক্ষাবিহীন মানুষের রূহ তথা আত্মা অসাড় দেহ‌‌। মানুষের রূহ ছাড়া যেমন শরীরকে মানুষ বলা যায় না, ঠিক তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জীবনকে সার্থক, সফল ও পরিপূর্ণ জীবন বলা যায় না।

এজন্য শিক্ষা নিয়ে ভাবা এবং যথার্থ ভূমিকা পালন করা মানে আদর্শ সমাজ ও জাতি গঠনের মূল হাতিয়ার গ্ৰহণ করা। শিক্ষার ভিত্তি শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবার শিক্ষিত হলে জাতির সন্তান যারা অনাগত ভবিষ্যতের রূপকার, কাণ্ডারি তারা শিক্ষিত, পরিমার্জিত ও সুশাসনের দেশ ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র উপহার দিতে সক্ষম হবে। যেখানে নীতি-নৈতিকতা, ইনছাফ প্রতিষ্ঠা থাকবে। যেখানে দুর্নীতির কালো হাত ভাঙা হবে। যেখানে শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার পাবে। এজন্য পরিবার শিক্ষার বুনিয়াদি ও প্রতিষ্ঠিত শক্তি ও সামনে চলার সর্বোত্তম যোগান, অনুপ্রেরণা। শিক্ষাবিদগণ পরিবারকেই শিক্ষার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান বলে আখ্যায়িত করেছেন। পরিবারের সকল সদস্য শিক্ষিত হ‌লে তো কোনো কথাই নেই। কল্যাণে ভরপুর। তবে সবাই শিক্ষিত হোক বা না হোক ‘মা’ শিক্ষিত হ‌ওয়া মানে শিক্ষিত জাতি পাওয়া। শিশুর শিক্ষার বুনিয়াদি ভিত্তি ও হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছেই। এজন্য শিক্ষিত মা একটা পরিবারের জন্য অতীব জরুরী।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আজকে শিক্ষিত মা যারা তাদের সন্তানকে শিক্ষিত করার ইচ্ছায় দিন-রাত ছুটছে, পড়াচ্ছে অথচ সেই আদরের সন্তানকে সুশিক্ষিত করতে পারছে না। কারণ আজকের তথাকথিত আধুনিক অভিভাবকবৃন্দ, যারা সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়- সন্তানকে শিশু অবস্থায় নৈতিক শিক্ষা তথা রূহের খোরাক দিতে সক্ষম হয়নি। একজন আদর্শ মা-বাবার জন্য অবশ্যকরণীয় হলো, সন্তানকে শিশু অবস্থা থেকেই রূহের উন্নতি সাধনের শিক্ষার সবক দেওয়া। অতঃপর সেই বুনিয়াদি শিক্ষা শিশুমনে ভিত্তি করে আগামীর জীবনে চলবে অনায়াসে, সৎ, নিষ্ঠাবান ও নির্ভীক আদর্শ নাগরিক হিসেবে। শিক্ষার তথা পরিবারের প্রাথমিক পর্যায়ে এটাই বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সুধী পাঠক! আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার চারটি স্তর বিদ্যমান— (১) প্রাথমিক, (২) মাধ্যমিক, (৩) উচ্চ মাধ্যমিক, ও (৪) উচ্চ শিক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েই শুরু হয় আমাদের শিক্ষা জীবনের যাত্রা‌। একটা শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো হার্ট। হার্ট ছাড়া দেহের যেমন মূল্য থাকে না, ঠিক প্রাথমিক শিক্ষা হার্ট সমতুল্য স্পর্শকাতর। প্রাথমিক শিক্ষাই হলো শিক্ষার ভিত্তি। তাই শিক্ষার এই গোঁড়ায় পানি ঢালা উচিত। এর উন্নতি সাধন ও উত্তরোত্তর কল্যাণকল্পে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করা উচিত।

মনীষীদের বক্তব্য হলো, শৈশবের শিক্ষা পাথরে খোদাই করা ছবি অঙ্কনের মতো স্থায়ী হয়। শিশুমনের নরম যমীনে সুশিক্ষার বীজ রোপণ করা মানে ভবিষ্যতে সৎ ও সাহসী জাতি গঠনের মূল দায়িত্ব পালন করা। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান যে করুণ পরিস্থিতি তা ভাবলেই গা শিউরে উঠে। তথাকথিত সুশীল বুদ্ধিজীবীরা ছাড়াও ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান আর হিন্দুত্ববাদীর আধিপত্যের কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মূলত ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার এই ধারা চলমান থাকলে বেশি দিন লাগবে না, এ দেশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে চলে যাবে। এতে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা চরম হুমকির সম্মুখীন হবে। ভবিষ্যতে জাতি অকর্মা, অদক্ষ, অযোগ্য ও প্রায় বিকলাঙ্গ জাতি উপহার পাবে। যাদের কোনো উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল শক্তি সঞ্চার করবে না। সব মেধাবীকে চালান করে নিয়ে দেশকে করবে মেধাশূন্য। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষার নামে মেধা চালান চালু করেই রেখেছে। প্রাথমিক শিক্ষাসহ দেশের উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত চলছে ছিনিমিনি খেলা। এই দুরভিসন্ধির সূচনা করেছে খ্রিষ্টান মহল। তারা তাদের ক্ষমতা ও সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য এই ষড়যন্ত্র করেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় কলকাঠি নেড়ে শিক্ষাকে বিকলাঙ্গ শিক্ষায় পরিণত করে বহুকাল গোলাম বানিয়ে রাখবে বলে তারা গভীর ষড়যন্ত্রের নগ্ন পাঁয়তারা চালায়। ফলে বাংলাদেশের মানুষ নামমাত্র স্বাধীন ভূখণ্ডের মালিক হলেও সর্বক্ষেত্রে তারা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ— চাই তা রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা লেজ গুটিয়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তে লর্ড ম্যাকলের ভাষ্য ছিল, We must at present do our best to from a class who maybe interpreters between us and millions whom we govern a class of person Indian in blood and colour but English in taste in openion in moral and intellect. অর্থাৎ ‘বর্তমানে আমাদের সর্বাধিক প্রচেষ্টা করতে হবে এমন এক জাতি সৃষ্টির লক্ষ্যে, যারা আমাদের ও আমাদের শাসিত লক্ষ লক্ষ জনগণের মাঝে দূত হিসেবে কাজ করবে। যারা রক্ত, বর্ণে হবে ভারতীয়। কিন্তু রুচিতে, চিন্তা-চেতনায়, নৈতিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ’।

যার ফলশ্রুতিতে আমাদের বাঙালি সমাজ ইংরেজদের গোলামীর শিকার। ইংরেজরা মূলত শিকলে, শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে গোলামী করাতে চায়নি। কারণ এই পদ্ধতিতে যে কেউ গোলামী করতে বাধ্য। তাই তারা বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করে ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় গোলামী জীবনযাপন করাতে বাধ্য করে। যা আমাদের বাঙালি সমাজ একটুও অনুধাবন করে না।
বৃটিশ মন্ত্রী গ্লাডস্টোন বলেছিল, So long as the Muslim have the Qur'an we shall be unable to dominate them. We must either take it from them or make them lose their love at it. অর্থাৎ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিমরা কুরআন আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদেরকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না। তাই তাদের থেকে কুরআন কেড়ে নিতে হবে নতুবা তাদের হৃদয় থেকে কুরআনের ভালোবাসা মুছে দিতে হবে’।

এজন্য তারা বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেছে। উদ্দেশ্য ইসলাম শিক্ষাকে মাইনাস করে ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করে জাতির বুনিয়াদি শিক্ষাকে বিপর্যস্ত করা।
দেশের শিক্ষার মূলধারা হলো প্রাথমিক শিক্ষা। অতঃপর পর্যায়ক্রমে উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা ভাবনা সুদৃঢ় হয়। কিন্তু এই মূলধারার শিক্ষাকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নাস্তিক্যবাদী ও ছবি-মূর্তি আর অশ্লীলতার সুড়সুড়ি দেওয়ার মতো সিলেবাস প্রণয়ন করেছে। যা সত্যিই এই মুসলিম অধ্যুষিত দেশে বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য।

বাংলাদেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে বেশ কয়েকবার। যেমন- (১) ড. কুদরত এ খোদা শিক্ষা কমিটি ১৯৭২-১৯৭৪ সাল। (২) কাজী জাফর আহমেদ শিক্ষা প্রণয়ন কমিটি ১৯৭৮ সাল। (৩) ড. মজিদ খান শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৮৩ সাল। (৪) ড. মফিজ উদ্দিন শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৮৭ সাল। (৫) ড. শামসুল হক শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৬ সাল। (৬) অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি। (৭) অধ্যাপক কবীর চৌধুরী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০১০ সাল।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে বটে কিন্তু মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনের সমাধান আজ অবধি হয়নি। শিক্ষানীতির উপর নির্ভর করে দেশের হালচাল, সততা, উন্নতি, নীতি-নৈতিকতার উজ্জীবিত শক্তি ও সমাজ সংস্কার। অথচ দেশের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে; প্রণয়ন একবার নয়, একাধিকবার হয়েছে। যেখানে সুশিক্ষার সবক বা নীতিমালা প্রণীত হয়নি, বরং তার জায়গা দখল করেছে কুশিক্ষা। যে শিক্ষা নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, যে শিক্ষা দেশ ও জাতির দুর্নীতির পথকে উন্মুক্ত করে দেয়, যে শিক্ষা অশ্লীলতার সুড়সুড়ি দেয়, সে শিক্ষা আদৌ কোনো জাতির জাতীয় শিক্ষানীতি হতে পারে? তা বিবেকবানের বিবেচনা করা সময়ের দাবি।

শিক্ষা কারিকুলামের ভিত্তি যত শক্তিশালী হবে জাতির অনাগত ভবিষ্যৎ তত বেশি উন্নতি-অগ্রগতির ভিত্তি মযবূত ও সুদৃঢ় হবে। জাতির শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় চাহিদা পূরণের দাবি রাখে ও তা পূরণে যথার্থ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সেই শিক্ষাব্যবস্থা যদি কোনো সাম্রাজ্যবাদী কিংবা ভিন দেশীয় শিক্ষা কারিকুলামের সাজে সজ্জিত করা হয়, তাহলে তা দ্বারা জাতি সত্যিকার‌ার্থে কখনোই সাফল্য ও উন্নতি এবং জাতীয় জীবনে সমাজ সংস্কারের আদৌ কোনো অবদান রাখতে সচেষ্ট হতে পারবে না।

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মূল উৎস ‘অহী’। জাতীয় জীবনের উন্নতিতে একটি সফল ও সার্থক সমাজ জাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য ইসলামী শিক্ষা প্রথমেই আত্মা ও রূহের উন্নতি সাধনের জন্য ‘পড়ো’ শব্দের উপর ভিত্তি করে তাওহীদের গুরুত্ব, পরকালমুখী জাতি ও এই ঠুনকো দুনিয়ার তুচ্ছতার উপর আখেরাতকে পেশ করে সৎ-নির্ভীক জাতির প্রত্যাশা করে মূলত ইসলাম শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন। মহান আল্লাহ বলেছেন, ﴿مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ﴾ ‘কোনো ব্যক্তির জন্য সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হেকমত ও নবুঅত দান করার পর তিনি মানুষকে বলবেন, আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা আমার দাস হয়ে যাও; বরং তিনি বলবেন, তোমরা রব্বানী হয়ে যাও, যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দাও এবং যেহেতু তোমরা অধ্যয়ন কর’ (আলে ইমরান, ৩/৭৯)

আজকের শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্র— ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করে জাতিকে সীমাহীন ক্ষতির দিকে ঠেলা দেওয়া হচ্ছে, যা সময়েই সকলে বুঝতে পারবে। আল্লাহ, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আখেরাতের কথা ভুলিয়ে বস্তুবাদী, ভোগবাদী শিক্ষার প্রতি লোভনীয় করে তোলা হচ্ছে আজকের তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায়। সন্তানকে শিশু বয়স থেকেই পুঁজিবাদী অর্থনীতির দৃষ্টান্ত পেশ করছে সূদী, মুনাফাভিত্তিক গণিতের মাধ্যমে। প্রবন্ধ, ছড়া আর গল্পে মিথ্যার জগাখিচুড়ি নিয়ে কচি বয়সের ছাত্র-ছাত্রীর ফ্রেস মস্তিষ্ককে ধোলাই দিচ্ছে আজকের তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা।

মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি (Theory of evolution) তথা ‘বিবর্তনবাদ মতবাদ’ বর্তমান শিক্ষা সিলেবাসের অন্যতম অংশ। চিন্তা করুন, মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি। মানুষের আদি পিতা বলতে বানর। আমরা বানরের সন্তান! ভাবতে অবাক লাগে ‘ডার‌উনের’ এই পচা মতবাদ খোদ ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান মহলেই মানতে পারেনি, বরং এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। অথচ আমরা শিক্ষা সিলেবাসে এমন পচা মতবাদ অন্তর্ভুক্ত করছি, কোন বিবেকে? সত্যিই লজ্জার বিষয়!
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এমন ষড়যন্ত্র সেটাও সবার জানা। শিক্ষাব্যবস্থায় ধস কি এমনিতেই হবে? যদি তার যথেষ্ট কারণ না থাকে তাহলে তো আর এমনি এমনি ধস নামবে না। জি, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সিলেবাস নির্ধারণে প্রায় সব সদস্য হিন্দু নিযুক্ত হ‌ওয়ায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র-ছাত্রীর চাহিদা ও আবদার পূরণে যথেষ্ট অভাব, ঘাটতি থেকে যায়। প্রবন্ধ, গল্প, ছড়া ছাড়াও প্রায় সকল পড়াতেই হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি ঐতিহ্যের ছাপ থাকে, ফলে মুসলিম ঘরের ছেলে-মেয়ে নামমাত্র মুসলিম পরিচয় দেয়। আর তার মাথায় ভর করে পাঠ্যবইয়ের সেই হিন্দুয়ানী রসম-রেওয়াজ, দেবী-প্রতিমার। মুসলিম কবি-সাহিত্যিকের প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প আজ আর সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলার বিদ্রোহী কবির উপাধি পেয়েই ক্ষান্ত হতে হলো দেশের জাতীয় শিক্ষানীতির সিলেবাসের সীমানায় আসার সুযোগটা তাই বুঝি হারিয়েছে! যেহেতু তিনি কারো তেলবাজি করতে পারেনি তাই পিছনেই থাকতে হয়েছে।

ঈমানবিধ্বংসী বহু ছড়া, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধে ভরপুর আজকের শিক্ষা সিলেবাস। ফলে একদিকে যেমনিভাবে ঈমান নষ্ট হয়ে কুফরীতে নিমজ্জিত হচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে চারিত্রিক গুণাবলি ও নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য যৌন সুড়সুড়ি দেওয়ার মতো গল্প, কবিতা ও উপন্যাস‌ও সিলেবাসে নতুন মাত্রায় যুক্ত আছে। ক্লাসে তো ফ্রি-মিক্সিং আছেই। এমনকি বয়ঃসন্ধিকাল, মাসিক পিরিয়ডসহ অপ্রীতিকর লজ্জাজনক বিষয়গুলোর স্পেশালভাবে সবাই ফ্রি-মাইন্ডে পাঠদান করার জন্য উৎসাহিত করছে। ছেলে-মেয়ের একসাথে শিক্ষায় তরুণ প্রজন্মের বর্তমান জীবনকে উচ্ছৃঙ্খল করে তুলছে। ফলে যৌনচর্চা ও যৌন পরিতৃপ্তির এক অশ্লীল প্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে নৈতিকতার সব বাঁধন ধুয়ে-মুছে শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ইংরেজদের এই শিক্ষাধারায় নীতিহীন ও চরিত্রহীন জাতি গঠনের যে শিক্ষা প্রণয়ন করে দিয়েছে তার গোলামী এখন পর্যন্ত চলছে। এই গোলামীর দিন কবে শেষ হবে তা বলা মুশকিল। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ ছাড়া আর কিছু নয়। দেশের শিক্ষা সমস্যা সম্পর্কে বিজ্ঞজনরা ভালো করেই অবগত আছেন।

বস্তুবাদী, ভোগবাদী শিক্ষা মানুষকে শুধু উদরপূর্তি করতেই বলে। ‘খাও দাও, ফূর্তি করো!’ সবক দেয়। আর এই সবক পেয়ে দুনিয়াপূজারিরা ন্যায়-অন্যায়ের পথ বাছবিচার না করে দুনিয়া, দুনিয়া বলে ছুটছে। নিজের হাতে সন্তান বাবা-মাকে হত্যা করছে, আগুনে পুড়াচ্ছে, মৃত্যুর সময় জানাযায়‌ও সন্তানকে পাচ্ছে না। অথচ সেই সন্তানের শিক্ষার জন্য ঐ অভিভাবক কত টাকা-পয়সা আর ত্যাগ বিসর্জন দিয়েছে। পরিশেষে ফলাফল জিরো। কারণ বস্তুবাদী শিক্ষা।

অথচ ধর্মীয় শিক্ষা কখনোই কাউকে অমানুষ বানায় না। বরং অমানুষকে মানুষ বানায়। বাংলাদেশের মানবাধিকার ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালে এক জরিপে জানা যায়, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কী নাজুক পরিস্থিতি! ঢাকার এক স্কুলের ৯ম শ্রেণির মোট ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাস রুমে বসে পর্ণোগ্ৰাফি দেখার সংখ্যা ২৫ জন পাওয়া যায়। পরে প্রধান শিক্ষক মোবাইলগুলো ভেঙে দেন। এই হলো চলমান শিক্ষার অশুভ দর্শন। পাশ্চাত্য সভ্যতা, সংস্কৃতির রঙে রঙিন করতে ব্রিটিশরা এই শিক্ষা দিয়ে গেছে। যেন এই স্বাধীন জাতি স্বাধীনভাবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। তাঁরা যেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে যুগের পর যুগ। এই মানসে শিক্ষাব্যবস্থায় ছুরি চালিয়েছে। আর তার গোলামী করতে হচ্ছে আজও। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে চাইলে প্রয়োজন আজকে বাংলা সাংবাদিকতার জনক খ্যাত ‘মাওলানা আকরাম খাঁ’-এর দৃষ্টি দর্শন।

ইতিহাস বলছে স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম শিক্ষামন্ত্রী হন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ রহিমাহুল্লাহ। পরে ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান শাসনামলে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় মাওলানা আকরাম খাঁর হাতে। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সাক্ষী! পাকিস্তান আমলে এটাই ছিল প্রথম শিক্ষা কমিশন।
তাই শিক্ষার এই মূল ধারায় ফিরে না আসা ও যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আশা করা মানে উলুবনে মুক্তো ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই না।

আমরা চাই এক উন্নত, মানসম্মত, যোগ্য, সৎ ও দক্ষ, কর্মঠ জাতি গঠনের শিক্ষা সিলেবাস। যার আদলে জাতি ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার মানদণ্ড নিরূপণ করতে পারবে। সমাজে ইনছাফ প্রতিষ্ঠা হবে। সোনালী আলোর আলোয় উদ্ভাসিত হবে মানবমন। সেদিন বেশি দূরে নয় ইনশাআল্লাহ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঐ স্বার্থান্বেষী মহল থেকে মুক্ত হয়ে আবার সকলে স্বাধীন হবে চিন্তার, বুদ্ধির জগতেও। গোলামের দাসত্ব ছিন্ন হয়ে তাওহীদের শিক্ষায় বলিয়ান হয়ে ইসলাম শিক্ষাই হবে বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনের উন্নতির সোপান ইনশাআল্লাহ!

মাযহারুল ইসলাম

অধ্যয়নরত, দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।

Magazine