সম্প্রতি ঝালকাঠির*সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চে আগুন লেগে ৪৪ যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান। আরও অন্তত ১০০ দগ্ধ যাত্রীকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা এখনও জানা যায়নি। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, এ লঞ্চের ধারণক্ষমতা ছিল ৪২০ জন। ভুক্তভোগী যাত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী, লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা ছিল ৭০০-৮০০ জন। যাত্রার সময় সদরঘাটে রক্ষিত রেজিস্টারে উল্লেখ করা হয়েছে ৩১০ জন।
মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে ২০০৩ সালের ৮ জুলাই। ঢাকা থেকে লালমোহনগামী ‘এমভি নাসরিন-১’ চাঁদপুরের ডাকাতিয়া এলাকায় অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাইয়ের কারণে পানির তোড়ে তলা ফেটে যায়। তাতে দুই সহস্রাধিক যাত্রীসহ লঞ্চটি ডুবে যায়। ওই দুর্ঘটনায় সরকারি ভাষ্যমতে, উদ্ধারকৃত মৃতদেহ ৬৪১টি। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৮০০টি। ২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনল সংলগ্ন মেঘনায় ডুবে যায় ‘এমভি সালাউদ্দিন-২’ নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ। এতে ৩৬৩ যাত্রী মারা যান। ২০০৫ সালে ‘এমএল মিতালি’ ও ‘এমএল মজলিশ’ নামে দুটি ছোট লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর ডুবে গিয়ে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৮৬ সালে ‘অ্যাটলাস স্টার’ নামে একটি লঞ্চ ডুবে ২০০ যাত্রী মারা গিয়েছিল। লঞ্চটি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে ডুবে গিয়েছিল বলে জানিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ। ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আযহার রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ষাটনল এলাকায় মেঘনা নদীতে ‘এমভি জলকপোত’ এবং ‘এমভি রাজহংসী’ নামে দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ‘রাজহংসী’ লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়।
ওই দুর্ঘটনায় লঞ্চের ১৬২ যাত্রী নিহত হয়েছিল। এ ছাড়া ২০০৫ সালে একটি ফেরি ডুবে গিয়ে ১১৮ যাত্রী নিহত হয়।
লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, ঘূর্ণিঝড়, নির্মাণ ও যান্ত্রিক ত্রুটি, লঞ্চে লঞ্চে পাল্লা, মুখোমুখি সংঘর্ষ, মাস্টারের গাফিলতি, ডুবোচরে আটকানো ইত্যাদি। কিন্তু লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনা বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার ইতিহাসে এই প্রথম। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, লঞ্চের মালিক গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় কমিয়ে আনার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে নতুন রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন লাগিয়েছেন। তা ছাড়া ওই লঞ্চে কর্মরতদের গাফিলতি ছিল। আগুন লাগার পরও তারা লঞ্চটি তীরের দিকে না চালিয়ে গন্তব্যের দিকে চালাচ্ছিল। ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। জাতিকে ৪৪টি তাজা প্রাণ পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে হয়েছে। ৪৪টি পরিবারের যে ক্ষতি, তা কখনও পূরণীয় নয়।
যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য একটি লঞ্চে থাকা উচিত লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বয়া, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম। বাকেটে পানি বা বালি ইত্যাদি লঞ্চে থাকলেও সেটি এমনভাবে ছিল যে, আগুন লাগার সময় যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারেনি। এসব জননিরাপত্তামূলক বিষয় দেখার দায়িত্ব কার? নৌপরিবহন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা কোনোক্রমেই এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের দুঃখ-কষ্ট দেখলে হৃদয় ভেঙে যায়। পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে ঝালকাঠির আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে। কত লোক পোড়ার ক্ষত নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন! তাদের দুঃখ-কষ্টের মূল্য ধার্য হয়েছে সরকার ঘোষিত কিছু অর্থ। মালিক ও অন্যান্য কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছুদিন পর জামিনে তারা বেরিয়ে যাবে। বিচারের আশায় ভুক্তভোগী মানুষ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলবেন আজীবন। আর অনেক পরিবার তাদের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে রয়েছেন।
বাংলাদেশে বড় একটি সমস্যা হলো ওভারলোডিং। বাস, ট্রেন, লঞ্চ স্টেশন যেখানেই যাই না কেন, দেখা যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। এ দেশটি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন। কিছু দ্বীপ ও নগররাষ্ট্র বাদে জনসংখ্যার এই ঘনত্ব পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। ফলে বিভিন্ন যানবাহনে মানুষ চলছে গাদাগাদি করে। একারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে হতাহতের সংখ্যাও অধিক হয়।
কিন্তু কে শুনে কার কথা? হুড়াহুড়ি ও ঠেলাঠেলি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা উঠে পড়ে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক সময় র্যাব-পুলিশও ডাকা হয়। এটা কি যাত্রীসাধারণের অসচেতনতা, না-কি বিদ্যমান পরিচালনা ব্যবস্থার ত্রুটি? আসলে এখানে উভয় কারণই জড়িত। লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের পিছনে কিছু কৃত্রিম কারণও সক্রিয়, যে ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। যাত্রীদের সচেতন হতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু যে সকল নিয়মকানুন রয়েছে, তার ব্যত্যয় হবে কেন? লঞ্চের কেবিন, চেয়ার ও সাধারণ ডেকে যে সংখ্যক যাত্রী যেতে পারে, তার অতিরিক্ত যাত্রী যাতে উঠানো না হয়, তা দেখভাল করার জন্য বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শকগণ রয়েছেন। তারা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন? দেখা যায়, মূল ঘাট হতে লঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার পর মাঝপথে অন্যান্য ঘাটেও যত্রতত্র যাত্রী উঠানো হয়। পরিদর্শকরা হয়তো বলবেন, যাত্রীদের এত ভিড় যে, তা সামাল দেওয়া কঠিন। তা হলে দেখতে হবে কেন ভিড় হচ্ছে এবং সাপ্লাই ও ডিমান্ডের সূত্র কেন কাজ করছে না।
যদি যাত্রীদের চাহিদা অধিক থাকে, তা হলে নতুন নতুন লঞ্চ সরবরাহ করা হবে না কেন? নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে যাত্রীবাহী নৌযান (লঞ্চ) ও মালবাহী নৌযান রয়েছে যথাক্রমে ৮৩৯ ও ৪ হাজার ৮৮টি। শুধু সদরঘাট হতে ৪৪টি নৌ-রুটে চলছে ২২২টি লঞ্চ। কিন্তু গত এক দশকে চাহিদা অনুযায়ী কি লঞ্চ বেড়েছে? তা ছাড়া পৃথক পৃথক নৌ-রুটে যতগুলো লঞ্চ চলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে চলছে তারও কম। যেমন— ঢাকা-বরিশাল রুটে ১৭টি লঞ্চ চলার কথা, কিন্তু নিয়মিত চলছে ছয়-সাতটি। অনুরূপভাবে ঢাকা-ভোলায় ছয়টির মধ্যে চারটি এবং ঢাকা-ভাণ্ডারিয়ায় ৯টির স্থলে চারটি যাতায়াত করছে। রোটেশন পদ্ধতির মারপ্যাঁচে পড়ে প্রয়োজন ও সক্ষমতার তুলনায় কম লঞ্চ চলছে। ফলে যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা, নৌ-পথে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর না করা, লঞ্চ চালকদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করার ‘সুযোগ’ পাওয়াসহ লঞ্চে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই যে লঞ্চ দুর্ঘটনা বা লঞ্চডুবির অন্যতম প্রধান কারণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লঞ্চ দুর্ঘটনা বা লঞ্চ ডুবির ঘটনা এদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রায় প্রতি বছরই লঞ্চডুবিতে অনেক মানুষ আহত, নিহত বা নিখোঁজ হন। শুরু হয় স্বজন হারানো ব্যক্তিদের আহাজারি। এ নিয়ে কিছুদিন হৈ চৈ হয়। গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় এবং যথারীতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তখন সংশ্লিষ্টরা বলে থাকেন, ঘটনার সাথে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাস, হয়ে গেল। এর কিছুদিন পরেই দেশে যেই ঘটে অন্য একটি বড় ঘটনা, তখন চাপা পড়ে যায় লঞ্চডুবি বা নৌ-দুর্ঘটনার ঘটনা। ফলে তখন আর কেউ জানতেও পারে না আগের ওই লঞ্চডুবির পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আদৌ নেওয়া হয়েছে কি না, কিংবা লঞ্চ ডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আদৌ আলোর মুখ দেখেছে কি না? এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
উন্নয়নশীল দেশে হাজারো সমস্যা থাকবেই। কিন্তু সেই সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাও থাকতে হবে। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যে ফারাক সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে হবে।
খত্বীব, গছাহার বেগ পাড়া জামে মসজিদ (১২ নং আলোকডিহি ইউনিয়ন), গছাহার, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর; সহকারী শিক্ষক, চম্পাতলী জান্দিপাড়া ইসলামিক একাডেমি, চম্পাতলী বাজার, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর।