বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রতিটি মানুষেরই হাতে হাতে রয়েছে স্মার্টফোন। প্রযুক্তির বিশ্বায়নের ফলে জীবন ও জীবিকার তাগিদে আমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও এই স্মার্টফোন এখন বিনোদনেরও একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম।
আধুনিক যান্ত্রিক বন্দিত্বের জীবনে একটুখানি স্বস্তির আশায় কিছুটা বিনোদন নিতে আমরা প্রতিনিয়তই ঢু মারি বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায়। তেমনই একটি জনপ্রিয় সোস্যাল মিডিয়া হলো ‘ফেসবুক’। যার জনপ্রিয়তা আজ পৃথিবীজুড়ে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও আজ ফেসবুকে জটিলভাবে আসক্ত। আজ আমরা জানার চেষ্টা করব এই আসক্তির কারণে ফেসবুকে আমরা কোন পথে যাচ্ছি।
সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনে যান্ত্রিকতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ফেসবুক হচ্ছে সেই একঘেয়েমি জীবনের একটি ভার্চুয়াল জানালা। যে জানালায় দাঁড়িয়ে আমরা পুরো দুনিয়া দেখার চেষ্টা করি। জানালায় দাঁড়িয়ে যেমন বাইরের ভালোমন্দ সবকিছু দেখা যায়, ঠিক তেমনি ভার্চুয়াল জানালা ফেসবুকেও ভালোমন্দ সবকিছুই আছে। মানুষের ভালোমন্দ নির্ভর করে তার নফসের উপর। যে নিজের নফসকে যত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে তত ভালো এবং আল্লাহর কাছে সফল।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষ নিজেদের নফসের কাছে হেরে গিয়ে ফেসবুকের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়। যা তাদেরকে জাহান্নামের গন্তব্যের দিকে নিয়ে যায়। তাই আমাদের জানা উচিত, ফেসবুকে আমরা কী করছি আর কী করা উচিত। কেননা অধিকাংশ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করলেও তারা এর ভালোমন্দ কিছুই জানে না। অথচ এই ফেসবুকই একজন মানুষের জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
কেননা ফেসবুক হচ্ছে একটি অনৈইসলামিক প্রতিষ্ঠান। যারা এর তত্ত্বাবধানে আছেন তারা দ্বীনের উদ্দেশ্যে এই অ্যাপস চালু করেনি। বরং মানুষকে বিভ্রান্ত করে টাকা উপার্জনই তাদের মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং তাদের প্রচেষ্টাই থাকে টাকা আয় করা। আর আমরা ভালোভাবেই জানি, সৎপথে টাকা উপার্জন খুবই কষ্টকর। তাই দুনিয়ার রীতি হচ্ছে অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করা। এই কারণে ফেসবুকও তার ব্যবহারকারীদের অনৈতিক পথে যেতে বাধ্য কিংবা উৎসাহিত করে।
বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের অনৈতিক এডাল্ট কন্টেন্টের মাধ্যমে তারা প্রলুব্ধ করে। একই সাথে বিভিন্ন এজেন্সি রয়েছে যারা এই জাতীয় অনৈতিক কাজে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাজে লাগায়। আমরা হাত বাড়ালেই ফেসবুকে অশ্লীল ভিডিও ছবি বা অশ্লীল কন্টেন্ট দেখতে পাই। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সাইট থেকে অশ্লীল এ্যাড আসে। যারা জেনে কিংবা না জেনে এসব অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে তারা সহজেই গুনাহগারে পরিণত হয়।
আমরা যারা শুধু বিনোদনের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করি, তাদের অধিকাংশই জানি না কীভাবে এসব খারাপ অশ্লীল সাইট বা এ্যাডগুলো বন্ধ করতে হয়। যার ফলে শুধু বিনোদনের জন্য ফেসবুকে ঢুকলেও, দুনিয়াবী বিভিন্ন অডিও-ভিডিও দেখার কারণে তার সাথে কিছু গুনাহ ফ্রি হিসেবে আমাদের আমলনামায় যুক্ত হয় প্রতিনিয়ত।
আমরা হাসি-ঠাট্টার ছলে অনেক অশালীন ছবি ভিডিও পোস্ট কিংবা শেয়ার করি, যা নৈতিকতা এবং ইসলামবিরোধী। এইসব ছবি ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে, নিজে যেমন গুনাহগার হচ্ছি, ঠিক তেমনি অন্যজনকেও গুনাহগার করার অপরাধে তার অপরাধও আমাদের কাঁধে নিচ্ছি। কেননা ইসলামে যে অপরাধ করে এবং তার কারণে অন্য কেউ গুনাহ করলে প্রথম ব্যক্তির শাস্তি দ্বিগুণ হয়ে যায়।
একইভাবে ফেসবুকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে অশালীন ও অনৈতিক কথাবার্তা বা ভিডিও-চ্যাট করার মাধ্যমেও যেমন গুনাহগার হচ্ছি, ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে অন্যান্য পাপেরও সন্ধান পাচ্ছি। এমন একটি পাপ হচ্ছে জুয়া। ফেসবুকের বদৌলতে আজ আমরা সহজেই অনলাইন জুয়ায় লিপ্ত হতে পারি। আর দ্বীন সম্পর্কে অধিকাংশ অবুঝ মানুষ এসব জুয়ার ফাঁদে পা দিয়ে আজ সর্বাশান্ত এবং পাপের সাগরে নিমজ্জিত।
ফেসবুক শুধুই খারাপ, এটা বললে অবশ্যই অবিচার করা হবে। অবশ্যই ফেসবুক ভালো- যদি আপনি তা ভালো পথে পরিচালিত করেন। বিশেষ করে দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে ফেসবুকের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ফেসবুককে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় বিনোদন হিসেবেই ব্যবহার করে।
এমনকি ফেসবুকে কোনো দ্বীনের দাঈ যদি কাউকে ভালো নছীহত করে, অধিকাংশ মানুষ এর বিরুদ্ধে চলে যায়। তাদের মতে যেখানে-সেখানে ইসলাম আনা যাবে না। ফেসবুক তো ফেসবুকই এখানে কেন ইসলাম আসবে ইত্যাদি অসার কথা, যা গোমরাহি বা পথভ্রষ্টতার কথা।
সুতরাং আমরা নিজেদের মুসলিম দাবি করলেও, ফেসবুকের কারণে যেমন গুনাহগার হচ্ছি, ঠিক তেমনি কেউ দ্বীনের নছীহত দিলে তার বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে ঈমানহারা হয়ে যাচ্ছি। যা আমাদের অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারীই জানে না। আমরা হাসি-তামাশার ছলে ফেসবুক ব্যবহার করি। আল্লাহ তাআলা বলেন,قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ - الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ - وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ ‘অবশ্যই মুমিনগণ সফল হয়েছে। যারা নিজেদের ছালাতে বিনয়, নম্র। যারা অসার ক্রিয়াকলাপ হতে বিরত থাকে’ (আল-মুমিনূন, ২৩/১-৩)। অর্থাৎ যারা অহেতুক অপ্রয়োজনীয় অনর্থক কাজে নিজেদের সময় ব্যয় করে না, তারা হচ্ছে আল্লাহর কাছে সফল। আর যারা সফল, তারাই আল্লাহর সান্নিধ্য পাবে।
সুতরাং শুধু বিনোদনের উদ্দেশ্যে অহেতুক ফেসবুক ব্যবহার করলে কখনোই সফলতা পাওয়া যাবে না। কেননা ইসলামে প্রতিটি কাজই নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। তাই ফেসবুককে কখনোই খারাপ উদ্দেশ্য ব্যবহার করা যাবে না। আমাদের চিন্তা করা উচিত, আমরা এই ফেসবুকের মাধ্যমে কোন পথে আছি এবং যাচ্ছি। একইসাথে এটাও চিন্তা করা উচিত, আসলেই আমাকে কোন পথে যাওয়া উচিত।
ফেসবুক ব্যবহারে ইসলামের সরাসরি কোনো বাধা নেই। তবে আপনি কী নিয়্যতে ফেসবুক ব্যবহার করছেন, সেটাই হচ্ছে মূল বিষয়। আমরা এর মাধ্যমে ভালো কিছু যেমন দ্বীন প্রচার বা দ্বীন ইসলামকে সকলের মাঝে তুলে ধরা এবং কিছু ভালো নছীহত করা যা মানুষের কল্যাণে আসবে।
সর্বোপরি ভালো নিয়্যতেই ফেসবুক ব্যবহার করছি কিনা দেখতে হবে। যদি আমাদের নিয়্যত হয় এর মাধ্যমে দুনিয়াবী তথা সকলের সাথে যোগাযোগ এবং নিজেদের তথ্য আদানপ্রদান, একইসাথে আখেরাত তথা দ্বীনী নছীহতসহ মানুষের কল্যাণে কাজ করা হলে তা অবশ্যই নেকীর কাজ হবে।
আর আমরা শুধু বিনোদন এবং দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে যদি ফেসবুক ব্যবহার করি, তাহলে তা আমাদের দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে জাহান্নামের রাস্তায় নিয়ে যাবে। কেননা ফেসবুকসহ অধিকাংশ সোস্যাল মিডিয়ায় আজ নগ্নতা এবং অনৈসলামিক কন্টেন্টের ছড়াছড়ি। যা প্রতিটি ব্যবহারকারীকেই পাপের সাগরের গা ভাসাতে প্রলুব্ধ করে। আর এভাবেই নিজেদের নফসের ডাকে সাড়া দিয়ে অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী শয়তানের সাথী হয়ে জাহান্নামের দিকে ধাবিত হয়।
তাই আমাদের আজ এই পরিস্থিতিতে চিন্তাভাবনা করা উচিত ফেসবুকে আমি কী করছি আর কী করা উচিত? আমরা কি ভালো নিয়্যতে ফেসবুক ব্যবহার করে দুনিয়া এবং আখেরাতের সন্ধান করব? নাকি দুনিয়ায় আনন্দ-উল্লাস অশ্লীল বিনোদনে জড়িত হয়ে জাহান্নামের পথে যাব? তাই আসুন! ফেসবুককে দ্বীন এবং দুনিয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে নিজেদের আখেরাতকে সমৃদ্ধ করি। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।