ইসকন এর পরিচয়:
ISKON এর পূর্ণরূপ হলো— Internatinal Society For Krishna Consciousness। বাংলায় বলা হয়— আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ চেতনা সংঘ। ইসকন সাধারণভাবে ‘হরে কৃষ্ণ আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে ১৯৬৬ সালের জুলাইয়ে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী কৃষ্ণ চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মায়াপুরে অবস্থিত ইসকনের প্রধান কার্যালয় আজকের দিনে এর বিস্তৃত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের কেন্দ্রস্থল, যেখানে প্রায় এক মিলিয়ন অনুসারীর একটি বৃহৎ সংগঠন গড়ে উঠেছে।[1]
ইসকনের কার্যক্রম:
ইসকন হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন। এটি মূলত বৈষ্ণব ধর্মের একটি অংশ। কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কার্যক্রম যেমন সংকীর্তন, পূজা ও ধর্মীয় আলোচনা পরিচালিত হয়। ধ্যান ও বৈদিক শিক্ষার প্রচারেও গুরুত্ব দেয় সংগঠনটি। ইসকন প্রাথমিকভাবে ভক্তি যোগ প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ইসকন তার কার্য-পরিধিকে বিস্তৃত করেছে। ইসকনের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মন্দির নির্মাণ, মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ, ধর্মীয় উপদেশ প্রদান, শ্রীমদ্ভাগবতগীতা প্রচার, ভক্তি কার্যক্রম, অভাবীদের বিনামূল্যে নিরামিষ খাবার বিতরণ, যোগব্যায়াম এবং জীবনযাত্রার ওপর শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন ও দাতব্য সংস্থা পরিচালনা। ইসকনের মন্দিরগুলো এক ধরনের কমিউনিটি সেন্টার হিসেবেও কাজ করে। এছাড়াও, ইসকন বেশ কয়েকটি স্কুল, খামার ও আধ্যাত্মিক আশ্রম পরিচালনা করে, যা তাদের অনুসারীদের মধ্যে কৃষ্ণ চেতনা জাগ্রত করতে সহায়ক।
বাংলাদেশে ইসকনের অস্তিত্ব:
সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে ইসকনের কার্যক্রম শুরু হয়। সংগঠনটির প্রথম কেন্দ্রগুলোর অন্যতম হচ্ছে রাজধানী ঢাকার স্বামীবাগ মন্দির। ইসকনের বাংলাদেশ শাখা তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। যেমন- ধর্মপ্রচার, মন্দির পরিচালনা এবং বার্ষিক রথযাত্রা উৎসবের আয়োজন। ইসকন এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত একটি সংগঠন। বাংলাদেশে সংগঠনটি ব্যাপকভাবে সক্রিয়।[2]
ইসকন নিয়ে যত বিতর্ক:
ইসকন একটি ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম চালালেও সংগঠনটির বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বিভিন্ন সময়ে নানা কাজের মাধ্যমে অসংখ্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ইসকন। তার বিরুদ্ধে মোটাদাগে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো— হিন্দু ধর্মের শিক্ষার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া, হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থের মনগড়া অনুবাদ করা, ব্রেনওয়াশিং বা মানসিক প্রভাব তৈরি করার অভিযোগ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ সমস্যা সৃষ্টি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, শিশু বলাৎকার, জোরপূর্বক মন্দির দখল, নিরামিষ ভোজনে বাধ্যকরণ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নকরণ, জঙ্গি প্রশিক্ষণ, অস্ত্র প্রশিক্ষণ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা, উগ্র হিন্দুত্ববাদের চর্চা, সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দেওয়া, উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো, বিরুদ্ধবাদী বা সমালোচকদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন, দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। এসব অভিযোগ সংগঠনটির বিরুদ্ধে একটি জটিল এবং প্রায়শই বিতর্কিত জনমত তৈরি করছে। যদিও এসব অভিযোগ ইসকন বরাবরই অস্বীকার করে চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসকনের বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা:
ইসকন একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন হলেও বর্তমানে তা উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। তারা আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে অংশ নিচ্ছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, ইসকন ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আর্থিক সহায়তা পায়, যা দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। সমালোচকদের মতে, ইসকন বাংলাদেশবিরোধী ভারতীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বায়বীয়, বানোয়াট, কাল্পনিক ও অলিক চিত্র তুলে ধরছে। উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করা, ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে দেশটির উপর চাপ সৃষ্টি করা, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা, বাংলাদেশের বাণিজ্য, পর্যটন, কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করা, বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি করা, সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমালোচকদের প্রতিটি অভিযোগই প্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
ইসকন এবং মতলববাজ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র এবং স্পর্ধা সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য নিচের ঘটনাগুলোই যথেষ্ট—
(১) প্রিয়া সাহার দেশবিরোধী অপপ্রচার: ২০১৯ সালে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বেসরকারি সংস্থা ‘শারি’-এর নির্বাহী পরিচালক পিরোজপুরের মেয়ে প্রিয়া সাহা আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে থেকে ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ হওয়ার এবং মুসলিম মৌলবাদী কর্তৃক হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা এবং তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ করেছিল, যা বাংলাদেশের সকল মিডিয়ায় ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছিল।[3]
(২) পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক বিভিন্ন পত্রিকায় জঙ্গিবাদের নির্দেশক ছাপানো: ‘সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্য শনাক্তকরণের (রেডিক্যাল ইন্ডিকেটর) নিয়ামকসমূহ’ শিরোনামে ১২ মে, ২০১৯ তারিখে বাংলাদেশের প্রথম সারির সকল পত্রিকায় ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপনটিতে দাড়ি রাখা ও টাখনুর উপর কাপড় পরাসহ ইসলামী বেশ কিছু বিশ্বাস ও আচরণকে জঙ্গিবাদের নির্দেশক হিসেবে প্রচার করা হয়। দৈনিক সমকাল বিজ্ঞাপনটি প্রথম পাতায় এবং দৈনিক জনকণ্ঠ এবং দৈনিক কালের কণ্ঠসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকা শেষ পাতায় বিরাট আকারে বিজ্ঞাপনটি ছেপেছিল। এহেন জঘন্য অপকর্ম ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাওহীদবাদী ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়লে পত্রিকায় প্রকাশের চার দিন পর পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় তা অস্বীকার করেন। ইসকন এবং হিন্দুদের সহযোগী দালাল পত্রিকাগুলোও বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
(৩) ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে মসজিদের সামনে হত্যা করা: বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে ১৮ জুন, ২০২০ শুক্রবার রাত আটটার দিকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের সামনে নওমুসলিম ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যা করে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা। ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ঘটনাটি সকল প্রথম শ্রেণির দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। ঘটনাটির সাথে ইসকনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সন্দেহ করে সচেতন মহল।
(৪) মুসলিম শিক্ষার্থীদের খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ বলানো: রথযাত্রা উপলক্ষ্যে ইসকন ১১ জুলাই, ২০১৯ থেকে ‘ফুড ফর লাইফ’ কর্মসূচির আড়ালে চট্টগ্রামের প্রায় ৩০টি স্কুলে প্রসাদ বিতরণ করে। ইসকন কর্মীদের শেখানো মতে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ মন্ত্র পাঠ করে প্রসাদ গ্রহণ করে। মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের অনেক শিক্ষার্থী মন্ত্র পাঠ করে প্রসাদ গ্রহণ করে। আবার কিছু শিক্ষার্থী প্রসাদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হিন্দু ধর্মের মন্ত্র পাঠে উৎসাহিত করার বিরুদ্ধে সচেতন মুসলিম সমাজ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল, যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল।[4]
(৫) ফরিদপুরে দুই মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা: ২০২৪ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটার উদ্দেশ্যে মন্দিরে আগুন দেওয়ার সন্দেহে ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে ফরিদপুরের পঞ্চপল্লী গ্রামে দুই মুসলিম নির্মাণ শ্রমিক আশরাফুল এবং আসাদুলকে পিটিয়ে হত্যা করে উগ্রবাদী হিন্দুরা, যা বাংলাদেশের সমস্ত মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল।[5]
(৬) বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপর ইসকনের পতাকা টাঙানো: ২৫ অক্টোবর, ২০২৪ লালদীঘি মাঠে সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমাবেশের দিন চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট চত্বরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপর ইসকনের গেরুয়া রঙের পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়।[6]
(৭) চট্টগ্রামে সরকারি আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে এবং জবাই করে হত্যা: ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ সোমবার বিকেল ৫টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডিবি পুলিশ ইসকন সংগঠন (বহিষ্কৃত) চিন্ময় দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সনাতন জাগরণ মঞ্চ এবং সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের নতুন প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’-এর মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করা হয়।[7] তার গ্রেফতারের পর হিংস্র দানবের মতো ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে ইসকন অনুসারী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের উগ্রবাদী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি। তারা বিভিন্ন রকমের আল্টিমেটাম দেয় তাকে ছেড়ে দিতে। ২৬ নভেম্বর তাকে আদালতে তোলা হলে আদালত প্রাঙ্গণে হট্টগোল করে তার অনুসারী উগ্র হিন্দুরা। এক পর্যায়ে তারা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে পুলিশের উপর হামলা চালায়। এসময় উগ্রবাদী হিন্দুরা চিন্ময়কে বহনকারী প্রিজন ভ্যান দুপুর ১২টা থেকে ২টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত আটকে রাখে এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় ইসকনের অনুসারীরা সন্ত্রাসী কায়দায় পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সাংবাদিকদের অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করে। আদালত প্রাঙ্গণের মসজিদে মসজিদ এবং আদালতের আশেপাশের দোকানপাটে ভাঙচুর চালায়। এর প্রতিবাদ করলে আইনজীবীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় চিন্ময়ের অনুসারী সন্ত্রাসীরা। ঘটনার এক পর্যায়ে তারা সরকারি আইনজীবী (এপিপি) মো. সাইফুল ইসলাম আলিফকে তুলে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে।[8]
(৮) আইনজীবী আলিফের হত্যা বিষয়ে সাংবাদিক রুমা পালের নির্লজ্জ মিথ্যাচার: প্রকাশ্যে দিবালোকে সরকারি আইনজীবী আলিফকে কুপিয়ে এবং জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ন্যূনতম শোক প্রকাশ তো দূরে থাক, তারা দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মিডিয়া জঘন্যতম মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হিসেবে উল্লেখ করে অপপ্রচার চালাচ্ছে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম।[9] আইনজীবী আলিফ নিহতের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স এবং ভয়েস অব আমেরিকাতেও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে।
এভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উগ্রবাদী আস্ফালন চলতে থাকলে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিলীন হয়ে যাবে। রক্তের সাগরে ভাসবে পবিত্র জন্মভূমি। কারণ দেশের ৯৩ ভাগ মুসলিমরাও তো রক্ত-মাংসেরই মানুষ। হয়তো একসময় মুসলিমদেরও উদারতার সাগরে ভাটা পড়বে, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। দেশ, জাতি এবং উম্মাহর স্বার্থে একান্ত বাধ্য হয়েই ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে। যার পরিণাম কোনো পক্ষের জন্যই শুভকর হবে না।
বাংলাদেশে হিন্দুদের মর্যাদা ও অবস্থান:
বাংলাদেশ উদার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সহাবস্থানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে। এদেশের মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও বিপদে-আপদে পরস্পরের পাশে দাঁড়ায়। এদেশের প্রায় ৯০.৪% মানুষ মুসলিম হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবসময় সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ-সুবিধা মুসলিমদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ২০১১ সালের তথ্য মোতাবেক ভারতে মুসলিমের সংখ্যা ছিল ১৪.২%। বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ২২% এ উন্নীত হয়েছে। অথচ ভারতে মুসলিমরা সরকারি চাকরি পান মাত্র ১% বা তারও নিচে। বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮.৫%। অথচ বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৩৫-৪০%।
বাংলাদেশের দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে হিন্দু এমপির সংখ্যা ছিল ১৮ জন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ১৪ হিন্দু নির্বাচিত হয়েছিল।[10] ভারতে বর্তমান লোকসভার সদস্য ৫৪৫ জন। এর মধ্যে নির্বাচিত সদস্য ৫৪৩ জন। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে এবার ২৪ জন মুসলিম এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৯ সালে সংখ্যাটি ছিল ২৬। এবার পুরো ভারতে মাত্র ৭৮ জন মুসলিম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, যা গতবার ছিল ১১৫ জন।[11]
তাছাড়া বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আছে হিন্দুরা, যা ভারতের ক্ষেত্রে কোনোদিনই চিন্তা করা যায় না।
বাংলাদেশে বহু স্থানে মসজিদ এবং মন্দির পাশাপাশি আছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদরাসা। এ মাদরাসাটির পাশেই আছে মন্দির। মসজিদ কিংবা মাদরাসা এবং মন্দির পাশাপাশি থাকলেও কোনো দিন মুসলিম এবং হিন্দুদের মাঝে টুঁ শব্দ পর্যন্ত হয়নি। বাংলাদেশের হিন্দুরা যত নির্বিঘ্নে ধর্মকর্ম করতে পারে খোদ ভারতেও তা সম্ভব কিনা বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশে হিন্দুরা জামাই আদরেই আছেন। ভারতে প্রতিদিন যেভাবে মুসলিমদেরকে নিগৃহীত করা হয়, মুসলিমদের মসজিদ, মাদরাসা, দোকানপাট, বাড়িঘরে তাণ্ডব চালানো হয়, তার ১ লক্ষ ভাগের এক ভাগও বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হয় না। বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়ার পরও তারা সংখ্যাগুরু মুসলিমদের উপর যে পরিমাণ অত্যাচার-নির্যাতন আওয়ামী শাসনামলে চালিয়েছে, তার ১ হাজার ভাগের এক ভাগ নির্যাতনের শিকারও তারা হননি। বরং বলা যায়, ভারতে হিন্দুরা যতটুকু নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করে, বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করে। এটা সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে বাংলাদেশের মুসলিমদের উদারতা এবং তাদের ধর্মীয় শিক্ষার কারণে।
যেসময় ভারত, আওয়ামী লীগ, ইসকন এবং তাদের অনুসারীরা একজোট হয়ে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের ধুয়া তুলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর পাঁয়তারা করছে ঠিক সেই সময়েই ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপে দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতীর্কালীন সরকার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে বলে মনে করেছেন বাংলাদেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ। মাত্র ১৫.৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য আগের চেয়ে খারাপ নিরাপত্তা দিচ্ছে। ১৭.৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, পরিস্থিতি আগের মতোই আছে।[12]
বাংলাদেশের প্রতি ভারতে অযাচিত নগ্ন হস্তক্ষেপ:
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ও পরাজয়কে ভারত নিজের পতন এবং পরাজয় বলে মনে করেছে। সে কারণে বাংলাদেশের হিন্দুদের বিশেষ করে ইসকনের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে উসকানি দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর মহাপরিকল্পনা আটছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে তারা বেছে নিয়েছে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের মতো কাল্পনিক ও বায়বীয় কাহিনীকে। লক্ষ লক্ষ ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে লক্ষ লক্ষ ভুয়া আইডির মাধ্যমে তারা সেগুলোকে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছেড়েছে। এখানেই শেষ নয় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যত ধরনের প্রতিহিংসা ও জিঘাংসা বাস্তবায়ন করা যায় তার সবকটিই করেছে ভারত সরকার। বাংলাদেশে একটি সরকার পরিবর্তনে ভারতের আফসোস এবং ছটফটানি দেখে মনে হচ্ছে ভারত তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে।
উগ্রবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ইসকন নিষিদ্ধ করতে বিভিন্ন সংগঠনের দাবি:
বিভিন্ন বিতর্কিত কার্যক্রমের কারণে ইসকন একটি উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। ফলে সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়, ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ, সর্বোপরি আপামর জনসাধারণ উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী সংগঠনটিকে নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এবং ছাত্রসংগঠন উগ্র হিন্দুত্ববাদী এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধের জোর দাবি জানাচ্ছে। ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে বাংলাদেশের সমস্ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল হয়ে উঠেছে।
সময়ের অনিবার্য দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মনোভাবের প্রতি সম্মান জানিয়ে অবিলম্বে ইসকনের মতো সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে সরকার কতৃর্ক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
সহকারী শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া।
[1]. দৈনিক ইনকিলাব, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪।
[2]. দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪।
[3]. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ জুলাই, ২০১৯; দৈনিক যুগান্তর, ২০ জুলাই, ২০১৯; দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২০ জুলাই, ২০১৯।
[4]. দৈনিক ইনকিলাব, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪।
[5]. দৈনিক প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪।
[6]. দৈনিক মানবজমিন, ২ নভেম্বর, ২০২৪।
[7]. কতোয়ালি থানায় মামলা নং ৫২, তারিখ- ৩১-১০-২০২৪।
[8]. দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২ ডিসেম্বর, ২০২৪।
[9]. দৈনিক করতোয়া, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪।
[10]. দৈনিক প্রথম আলো, ৯ জানুয়ারি, ২০২৪।
[11]. দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৬ জুন, ২০২৪।
[12]. দৈনিক কালবেলা, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪।