প্রারম্ভিকা :
পেঁয়াজ নেই, এমন কোনো রান্না ঘর হয়তোবা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, কোনো রান্না শুরু করার আগে কড়াইতে তেল দেওয়ার পরপরই সাধারণত যে উপাদানটি ব্যবহার করা হয় সেটি হলো পেঁয়াজ। শুধু রান্নার অনুষঙ্গই নয়; কাঁচা পেঁয়াজ খেতে বেশ সুস্বাদু। এ ছাড়াও সরাসরি কাঁচা পেঁয়াজ, ভর্তা, আচার এবং সালাদ হিসেবেও পেঁয়াজের কদর কম নয়। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। পেঁয়াজ আসলে কোনো সবজি নয়। এটি মূলত একটি মশলা জাতীয় উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম এলিয়াম সেপা।
পেঁয়াজের চাহিদা :
সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে সারা বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান (বিবিএস-২০১৮)-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৩৮ লাখ টন, যা বিগত বছরে ছিল ১৮ দশমিক ৬৭ লাখ টন। আর আমদানী করা হয় প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ।
হঠাৎ পেঁয়াজের বাজারদরে আগুন :
বেশ কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজারে ঝাঁজ বেড়েছে। গত বছর এপ্রিলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় কৃষকের নিজস্ব পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা পেঁয়াজ পচে যায়। বাজারে দেশীয় পেঁয়াজ ঘাটতির মূল কারণ এটি। আর দ্বিতীয় কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে অতিমাত্রায় আমদানী নির্ভরতা। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেই সিংহভাগ পেঁয়াজ আমদানী করা হয়ে থাকে। মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক থেকেও কিছু পেঁয়াজ আমদানী করা হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশের বাজারেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কয়েকদিনের ব্যবধানেই কেজি প্রতি দাম ৪০-৪৫ থেকে ৫৫-৬০ টাকা হয়ে যায়। হঠাৎ করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অব ট্রেড (ডিজিএফটি) ঘোষণা করেন যে, ভারত থেকে রফতানি করা পেঁয়াজের দাম টন প্রতি সর্বনিমণ মূল্য হবে ৮৫০ ডলার, যা আগে ছিল ৩৫০ ডলার। ভারত সরকার তাদের অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রথমে রফতানি নিয়ন্ত্রণের কৌশল নেয় এবং পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার তাদের ভোক্তাদের চাহিদা অটুট রাখার স্বার্থে গত ২৯ সেপ্টম্বর, ২০১৯ হঠাৎ করে পেঁয়াজ আর রফতানি করা হবে না বলে জানিয়ে দেয়। এমনকি আগের অর্ডারও বাতিল করে দেয়। এর সঙ্গে যোগ হয় কিছু সংখ্যক অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর অসাধু আচরণ। ফলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। এমনকি কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হতে থাকে। এতে বিপাকে পড়েন লাখ লাখ ভোক্তা।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস-এর বরাতে জানা গেছে, এবার খোদ ভারতই তুরস্কের কাছ থেকে ১১ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানী করেছে। এর আগে মিসর থেকে ৬ হাজার ৯০ টন পেঁয়াজ আমদানীর আদেশ দিয়েছে ভারত। চলতি জানুয়ারীতে এই চালান এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। তবে নতুন উৎপাদিত দেশী পেঁয়াজ বাজারে আসায় এবং পেঁয়াজ আমদানী হওয়ায় বর্তমানে পেঁয়াজের দর সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে কোনো চক্রান্ত আছে কিনা সরকার খুঁজে দেখবে’। এগুলো আমাদের কাছে নিছক রাজনৈতিক বক্তব্য বলেই মনে হয়। কেননা, আমরা আসলে ‘সিন্ডিকেটের অর্থনীতি’র কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। এখান থেকে যে নিরেট সত্যটি আমাদের সামনে চলে আসে, তা হলো আমাদের গোটা বাজার ব্যবস্থা গুটি কয়েক ব্যক্তির (যারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে) হাতে জিম্মি। আর এটা পশ্চিমা কর্পোরেট কালচারেরই অংশ।
লবণ গুজবের কথকতা :
লবণ নিয়ে গত বছরের নভেম্বর মাসে ব্যাপক হৈচৈ ও গুজব রটে গিয়েছিল। দেশে লবণের সঙ্কট চলছে....। আর যায় কোথায়? মুঠোফোন ও ফেসবুকে মুহূর্তে চাউর হয়ে যায় সেই রটনা। ফলে লবণের দর হু হু করে বেড়ে যায়। কারণ ছাড়া হঠাৎ করে লবণের দাম এতো বেড়ে যাওয়ার খবর শুনে সবার চোখ চড়ক গাছ। এমনিতেই পেঁয়াজের দাম আকাশে ওঠায় নাভিশ্বাস। তার ওপর লবণের এমন বাজার দর! এই খবরে সবাই দিশেহারা হয়ে ছুটলেন লবণ কিনতে। হুমড়ি খেয়ে ভিড় জমালেন মুদি দোকানে। একসাথে এতো লবণের চাহিদা জোগান দিতে কোনো কোনো ছোট দোকানিকে হিমশিম খেতে হলো। আবার অনেকেই বেশি মুনাফার আশায় অপকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকলো। হঠাৎ এমন কা-- হুলস্থুল পড়ে যায়। লবণ নিয়ে সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে অস্থিরতা।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ‘দেশে পর্যাপ্ত লবণ মওজূদ রয়েছে। গুজবে কান না দিয়ে প্রয়োজনের বেশি লবণ কিনবেন না’।
খবরে জানা গেছে, অনেক স্থানে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে লবণ বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে দোকানি দোকান বন্ধ করে পালিয়ে গেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ভয়ে।
গুজবের জন্ম ও বেড়ে ওঠা :
সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণে গুজবের জন্ম হয়। সত্যের ছিটেফোঁটা থাকলে গুজবের ডালপালা গজিয়ে মহীরুহ হয়ে ওঠে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যাহোক, পেঁয়াজের সঙ্কট যেহেতু সত্য; সেহেতু সেই সত্যের ওপর লবণের গুজব সহজেই ভর করতে পেরেছে। অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়তি দামে লবণ বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা কেজি দরের লবণ ৫০ থেকে ২০০ টাকায়। কপাল ভালো, লবণ গুজব দ্রুত সামাল দেওয়া গেছে। তবে এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্য শক্তিটি পেঁয়াজ বিক্রি করে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিলো, তার ক্ষতিপূরণ হবে কীভাবে?
আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর আসল চেহারা :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বকে ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত করেছিল। বিশ্বের অর্থনীতি এতে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। এই পঙ্গুত্বের হাত থেকে মুক্তি দিতে ধনী দেশগুলোর পরামর্শ, প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা। এসব সংস্থা গরীব দেশগুলোকে দারিদ্রের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেওয়ার নামে ঋণ দিয়ে নানা কর্মসূচী বাস্তবায়নে সাহায্য করে আসছে। কিন্তু প্রায় ৭০ (সত্তর) বছর পর এসেও দেখা যাচ্ছে, এইসব সংস্থার ঋণ নিয়ে, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে খুব কম দেশই উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে পেরেছে। আসলে সাহায্যের ছদ্মাবরণে দাতা সংস্থাগুলো তৃতীয় বিশ্বে এমনসব অপরাধ করে চলেছে, যার ফলে দেশগুলো হয়ে পড়েছে আরো বেশি সাহায্য নির্ভর। এসব দেশের জনগণ আরও বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছে এবং তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে আরও বহু গুণ।
মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে মিথ্যা ওকালতি :
পেঁয়াজের দাম বাড়ার ঘটনা প্রমাণ করছে, আমাদের অর্থনীতি ক্রমেই মুক্তবাজার থেকে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে চিৎকার-চেঁচামেচি করা হলেও বিশ্ব অির্থনীতি ক্রমেই পাঁচ থেকে ছয়টি বহুজাতিক করপোরেশনের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। তা না হলে সম্প্রতি এতো দ্রুত বিদেশ থেকে প্লেনে করে পেঁয়াজ আমদানী করার দক্ষতা হলো কী করে? গত বছরে দেশে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার কারণে এবং ভারতে বন্যা হওয়ার কারণে এই সময়ে বাংলাদেশে পেঁয়াজের সঙ্কট দেখা দেবে- এটাতো তাদের ভালো জানার কথা। তারপরেও তারা সঙ্কট ঠেকাতে আগাম প্রস্ত্ততি নিলো না কেন?
উপসংহার :
আজ আমরা পেঁয়াজের সমস্যায় আছি, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না যে, আমাদের ধানসহ অনেক ফসলের প্যাটেন্ট পশ্চিমা বিশ্বের হাতে। স্পষ্ট ভাষায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করা এবং একচেটিয়াত্ব ক্বায়েমের নতুন হাতিয়ার হচ্ছে কথিত বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন।