কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসরাঈলী পেগাসাস : ফোনে আড়ি পাতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই

ভূমিকা : তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় এ যাবৎকালের সবচেয়ে ভয়ংকর দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পেগাসাস স্পাইওয়্যার। বিশ্বে ভয়াবহ রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এমন সব দেশ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগগুলো ব্যবহার করছে এই প্রযুক্তি। বেশকিছু দেশে তা ব্যবহার করা হচ্ছে বা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে- এমন ইঙ্গিতও মিলেছে। ফলে অপরাধ তদন্তের বৈধ একটি হাতিয়ার এই প্রযুক্তি, এমন দাবি করা হলেও এর বৈধ ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেগাসাসের ব্যবহার নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে আমরা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি।*

ইসরাঈলী পেগাসাস নিয়ে হইচই : সম্প্রতি পেগাসাস নামের একটি সফটওয়্যার সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছে, যার সাহায্যে অভিনব পদ্ধতিতে আইফোনের মতো অত্যন্ত সুরক্ষিত স্মার্ট ফোনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের ৫০ হাজারের মতো মানুষের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। ফোনের ব্যবহারকারীরা এ বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি।

ইসরাঈলী একটি প্রতিষ্ঠান এনএসও এই সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে, যা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এনএসও বলেছে, সাধারণ মানুষের ফোনে আড়ি পাতার জন্য তাদের পেগাসাস কেউ ব্যবহার করেনি। সাধারণত ই-মেইল বা বার্তা পাঠিয়ে ফোনে হ্যাক করার চেষ্টা করা হয়। কেউ যখন সেই ই-মেইলের লিংক বা মেসেজে ক্লিক করেন, তখনই ফোনে একটি সফটওয়্যার ইনস্টল হয়ে যায়, যার সাহায্যে ওই ফোনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু পেগাসাসের সাহায্যে এই কাজটিই করা হয়েছে অভিনব উপায়ে— ফোনের ব্যবহারকারীর কোনো লিংকে ক্লিক করার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়নি।

পেগাসাস একটি শক্তিশালী সফটওয়্যার, যার সাহায্যে নানা উপায়ে ফোন হ্যাক করা যায়। তবে মোবাইল ফোন হ্যাক করার সবচেয়ে মারাত্মক উপায় হচ্ছে— ‘জিরো ক্লিকে’ কারো ফোনে আড়ি পাতা। অর্থাৎ এর জন্য আপনাকে কোনো লিংকে ক্লিক করতে হবে না। কিছু ডাউনলোড করতে হবে না। কোনো মেসেজের রিপ্লাই দিতে হবে না। কিছু খুলতে হবে না। কোনো অ্যাপ ইনস্টল করতে হবে না। এমনকি কোনো ওয়েবসাইটেও যেতে হবে না। এককথায় আপনাকে কিছুই করতে হবে না। হ্যাক করার জন্য হ্যাকারদের শুধু প্রয়োজন হবে আপনার ফোন নম্বর, অথবা ই-মেইল অ্যাড্রেস, যা দিয়ে আপনি আপনার ফোন ব্যবহার করেন।

জিরো ক্লিকে মোবাইল ফোনে কোনো সফটওয়্যার স্থাপন করা খুবই কঠিন ও আধুনিক একটি ধাপ। কারণ, মোবাইল ফোন নিয়মিত আপডেট হয়। যখন আপডেট হয় তখন এটি নতুন একটি সফটওয়্যার তার সুনির্দিষ্ট উৎস থেকে ইনস্টল করে থাকে। কিন্তু জিরো ক্লিকে সেটা করতে পারার অর্থ হচ্ছে, হ্যাকাররা তখন ওই ফোনের অপারেটিং সিস্টেমের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়, যেটা অত্যন্ত ভয়ের ব্যাপার। আর এই আড়ি পাতার পুরো প্রক্রিয়াটিই হয় গোপনে। অবশ্যই ব্যবহারকারীর অজান্তে। এজন্য ফোনে যে মেসেজ পাঠানো হয়, সেটি নোটিফিকেশনে দেখাও যায় না। এরপর ম্যালওয়্যারটি নিজে নিজেই ফোনে ইনস্টল হয়ে যায়।

পেগাসাস ইনস্টল হলে যা হয় : পেগাসাসের সাহায্যে আপনার ফোনে যা কিছু আছে, তার সবকিছুই হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফোনে আপনি যা কিছু দেখতে পান, হ্যাকাররাও সেটা দেখতে পায়; আপনি যা করতে পারেন, হ্যাকাররাও সেটা করতে পারে। আপনার ফোনে হোয়্যাটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, টেলিগ্রাম, ফেসবুক মেসেঞ্জার ইত্যাদি অ্যাপের সাহায্যে যেসব টেক্সট মেসেজ আদানপ্রদান করা হবে, তার সবই হ্যাকাররা দেখতে ও পড়তে পারে।

পেগাসাসের সাহায্যে যাদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, ওই ফোনকলের কথাবার্তা শুনতে পারে হ্যাকাররা। একই সাথে আপনার ফোনে যেসব ছবি আছে সেসব দেখতে পারে, ই-মেইল পড়তে পারে তারা। এমনকি আপনি যেসব পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন, সেগুলোও চলে যাবে হ্যাকারদের হাতে। এখানেই শেষ নয়, আপনার ফোনের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন অন করে ফোনের আশপাশে যা কিছু হচ্ছে সেসবও তারা দেখতে ও শুনতে পারবে। পেগাসাস যদি কোনোভাবে একবার আপনার ফোনের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে আপনার অজান্তে ম্যালওয়্যারটি আপনার ফোনকে ২৪ ঘণ্টার এক নযরদারির যন্ত্রে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে। আপনার ফোন থেকে আপনি যত মেসেজ বা ছবি পাঠান, কিংবা রিসিভ করেন, পেগাসাস তা কপি করে গোপনে পাচার করে। পাঠিয়ে দেয় নির্দিষ্ট জায়গায়। এই স্পাইওয়্যারটি আপনার অগোচরে ফোনের কথাবার্তা রেকর্ড করতে পারে, এমনকি ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে গোপনে আপনার ভিডিও রেকর্ড করতে পারে। আপনি কোথায় আছেন, কোথায় গিয়েছিলেন অথবা কার কার সাথে দেখা করেছেন, পেগাসাস সে সম্পর্কেও জানতে পারে বলে মনে করা হয়।

২০১৬ সালে গবেষকরা পেগাসাসের সবচেয়ে প্রথম ভার্সনটির কথা জানতে পারেন। সে সময় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ফোনে টেক্সট মেসেজ বা ই-মেইলে পাঠানো হতো, যাতে থাকত একটি লিংক। সেই লিংকে ক্লিক করলেই পেগাসাস ফোনের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নিত। অবশ্য এরপর এনএসও গ্রুপ এই স্পাইওয়্যারের ক্ষমতাকে আরও বহুগুণ শক্তিশালী করেছে।

স্মার্ট ফোনও যখন ব্যর্থ হলো : ক্ষতিকর বিভিন্ন ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার প্রতিরোধের জন্য কম্পিউটারের মতো স্মার্ট ফোনেও বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ইনস্টল করা থাকে। এসব সফটওয়্যারের নিরাপত্তা-প্রাচীর ভেদ করে হ্যাকাররা ফোনের ভেতরে অত সহজে ঢুকে পড়তে পারে না। আর আইফোন নির্মাতারা তাদের ফোনকে অত্যন্ত নিরাপদ বলে দাবি করে। কিন্তু পেগাসাস দিয়ে যেসব ফোন হ্যাক করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এই আইফোনও রয়েছে। ম্যালওয়্যার ঠেকাতে আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলো নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও হ্যাকাররা এসব অপারেটিং সিস্টেমের ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারছে।

টেলিফোনে আড়ি পাতা যদি আটকানো সম্ভবই হ,য় তাহলে প্রশ্ন হতে পারে- পেগাসাসকে কেন ঠেকানো সম্ভব হলো না? ঠেকানো সম্ভব কি সম্ভব নয়? এর উত্তর নির্ভর করছে কারা ফোনে আড়ি পাতছে, এর পেছনে কত ক্ষমতা বা অর্থ খরচ করা হচ্ছে এবং কার ফোনে আড়ি পাতছেএসব প্রশ্নের উত্তরের ওপর। কিছু মানুষ একটা সফটওয়্যার তৈরি করছে। আবার কিছু মানুষ ওই সফটওয়্যারের ত্রুটি খুঁজে যাচ্ছে। একটি সফটওয়্যারকে বাজারে ছাড়ার আগে সেটি বিভিন্নভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু অনেক পরীক্ষার পরও কিছু ত্রুটি থেকে যায়, যেগুলো ধরা পড়ে না। একদল লোক, যারা ওই ত্রুটিকে ব্যবহার করে অন্য কিছু করতে চাইছে। তারা ওই ত্রুটি ধরে ফেলতে পারে।

এটা অনেকটা ভাইরাস ও এন্টিভাইরাস তৈরি করার মতো বিষয়। আমরা যখন একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করি, কখনো কখনো মেসেজ আসে যে আমরা এ বিষয়ে রিপোর্ট করতে চাই কি না। যদি রিপোর্ট পাঠাই তাহলে তারা সেটা দেখে আপডেট করে দেয়। কিন্তু যারা নযরদারি করতে চায়, তারা তো আর ওই ত্রুটি সম্পর্কে ফোনের নির্মাতাদের অবহিত করে না। তারা বরং ভেতরের সেই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে মানুষের ওপর নযরদারি করছে।

২০১১ সালের দিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ব্যক্তির কম্পিউটারে ই-মেইল পাঠানো হতো। এই ই-মেইলে ক্লিক করার সাথে সাথে তা থেকে ম্যালওয়ার ছড়িয়ে কম্পিউটারে তা চালু হয়ে যেত এবং ওই কম্পিউটারের তথ্য পাচার করত। কিন্তু স্মার্টফোনে পেগাসাসের চালু হওয়ার বিষয়টি আরো সূক্ষ্ম। আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো সংযোগ ছাড়াই এটি তার ফোনে চালু হতে পারে। একবার চালু হওয়ার পর পেগাসাস গোপন ম্যাসেজিং অ্যাপ হোয়াটস অ্যাপ, টেলিগ্রাম বা সিগন্যালসহ সব তথ্যই এনএসওর গ্রাহকদের কাছে পাচার করে। ফোন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই স্পাই ওয়্যার চালু থাকে। আবার পাওয়ার অন করার সাথে সাথে এটি চালু হয়।

পেগাসাসের সাহায্যে হ্যাকিংয়ের পর বলা যায়, ফোনে আড়ি পাতা ঠেকাতে সাধারণ ব্যবহারকারীদের দিক থেকে আসলে তেমন কিছুই করার নেই। সাধারণত হ্যাকাররা ই-মেইল বা মেসেজ পাঠিয়ে ব্যবহারকারীদের প্রলুব্ধ করে তাতে ক্লিক করার জন্য। বড় অঙ্কের লটারি জিতেছেন— এরকম বার্তা পাঠানো হয় যাতে আমরা ক্লিক করি। এরপর বিশেষ একটি সফটওয়্যার ফোনে ইনস্টল হয়ে যায়, যা দিয়ে ফোনে আড়ি পাতা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এ ধরনের লিংকে ভুল করেও ক্লিক করা যাবে না। না জেনেবুঝে কোনো অ্যাপও ইনস্টল করা উচিত নয়। করলেও সেটা বিশ্বস্ত কোনো উৎস থেকে করা উচিত। কিন্তু জিরো ক্লিকেই যেখানে ফোনের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে চলে যায়, তখন? এখানেই মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারীরা নিরুপায়।

যেভাবে বোঝা যাবে পেগাসাস ইনস্টল হয়েছে : এর উত্তরও নির্ভর করে কে আপনার ফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তার ওপর। আমাদের কম্পিউটারে যখন কোনো ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার প্রবেশ করে তখন কম্পিউটারে ইনস্টল করা অ্যান্টিভাইরাস তাকে ধরতে পারে। তখন ভাইরাসটিকে নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই অনুসারে আমরা কম্পিউটার থেকে ভাইরাসটিকে দূর করে থাকি।

কিন্তু কখনো কখনো ওই সফটওয়্যার কোনো একটি ভাইরাসকে চিহ্নিত করতে পারে না। কারণ সফটওয়্যারটি তখন পর্যন্ত ততটা আপডেট হয়নি। হয়তো পরবর্তী সংস্করণে ধরতে সক্ষম হবে। কিন্তু এর মধ্যে কম্পিউটারে বা ফোনে যে কাজটুকু হয়ে যায়, সাধারণ মানুষ তো সেসব ধরতে পারে না। তবে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা সম্ভব ফোনটিতে কেউ আড়ি পেতে আছে কি না। আবার এমনও হতে পারে, আপনি ফোনটির মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন না। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখা গেল যে ফোনটি কিছু ড্যাটা ব্যবহার করেছে। কখনো হয়তো দেখা যাবে যে ফোনের ব্যাটারির ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এসব থেকেও বোঝা যেতে পারে যে আপনার অজান্তেই কেউ ফোনটি ব্যবহার করছে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কা : নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতি মুহূর্তেই আগের থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপরও হ্যাকাররা বসে নেই। ১৯৮৩ সালে মাত্র ১৯ বছরের একটা ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের নিরাপত্তা ভেদ করে তাদের ওয়েবসাইট হ্যাক করে ঢুকে গিয়েছিল।

মেক্সিকোর সাংবাদিক সিসিলো পিনেডা ২০১৭ সালের ২ মার্চ তারিখে তার ফোন থেকেই এক ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন। ওই লাইভে তিনি সরকার ও স্থানীয় পুলিশকে দেশটির অপরাধী চক্র ও মাফিয়া সরদারদের সাথে যোগসাজশের জন্য অভিযুক্ত করেন। লাইভের দুই ঘণ্টা পরেই দুই ব্যক্তি মোটরসাইকেলে এসে তাকে গুলি করে হত্যা করে। কয়েক সপ্তাহ পরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ক বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ফরবিডেন স্টোরির প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়, শুধু পিনেডা নয়, তার হত্যা মামলার তদন্তকারী কৌসুলি জ্যাভিয়ার ওলেয়া পেলায়েজের ফোনও মাসের পর মাস ইসরাঈলী স্পাইওয়্যার পেগাসাসের মাধ্যমে নযরদারিতে রাখা হয়েছিল। পিনেডার ফোন উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পৌঁছানোর আগেই তার ফোন ঘটনাস্থল থেকে হারিয়ে যায়। সারা বিশ্বের মোট ১৮০ সাংবাদিকের ফোন পেগাসাসের মাধ্যমে নযরদারি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে

মেক্সিকোতে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট অন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ অবরাডরের স্ত্রী, সন্তান, তার গাড়িচালক এবং এমনকি তার একজন চিকিৎসকের ফোনও নযরদারির জন্য টার্গেট করা হয়। এমনকি, ভারতে মোদী সরকার কর্তৃক রাহুল গান্ধীকে ইসরাঈলী স্পাইওয়্যার দিয়ে নযরদারির টার্গেট করা হয়েছে— এমন খবরে বিরোধী কংগ্রেস দলের সমর্থকরা বিক্ষোভ পর্যন্ত করেছে।

অনুসন্ধানী তালিকায় বাংলাদেশের নাম অস্পষ্ট : কোন কোন দেশে এই নযরদারি করা হয়েছে তা পরিষ্কার জানা না গেলেও সবচেয়ে বেশি ফোনকলে আড়ি পাতা হয়েছে ১০টি দেশে। এসব দেশ হলো আজারবাইজান, বাহরাইন, হাঙ্গেরি, ভারত, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, মরক্কো, রুয়ান্ডা, সঊদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। কী পরিমাণ মানুষ এর শিকারে পরিণত হয়েছেন, তার প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলছেন, এ সংখ্যা অনেক বেশি। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। কোথায় কোন রাজনীতিক ফেঁসে যাচ্ছেন, কোন প্রধানমন্ত্রীর গোপন কথোপকথন এর মধ্য দিয়ে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে হিম আতঙ্ক।

বিশ্বের ১৭টি প্রথম সারির মিডিয়া, সাংবাদিকতা বিষয়ক প্যারিস-ভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ফরবিডেন স্টোরিজ’ এবং সেই সাথে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের পুরোটা এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। অনুসন্ধানে যেসব দেশে ব্যাপকহারে এই নযরদারি চালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে তেমন ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভারতের নাম রয়েছে। তবে তালিকা আরো লম্বা কিনা তা এখনো অস্পষ্ট।

বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে ৫০ হাজারেরও বেশি মোবাইল ফোনে ইসরাঈলী প্রতিষ্ঠান এনএসও’র তৈরি পেগাসাস নামের সফটওয়ারটি ঢুকিয়ে নযরদারির নজির এই অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, তাতে বাংলাদেশের কোনো টেলিফোন নম্বর রয়েছে কিনা তা এখনও অস্পষ্ট। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য না দেওয়া হলেও, সরকারের একজন মন্ত্রী পেগাগাস কেনা বা ব্যবহারের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। অবশ্য এ বছরের গোড়ার দিকে কাতারের আল-জাজিরা টিভি তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলে, নযরদারির জন্য বাংলাদেশ গোপনে ইসরাঈলী প্রযুক্তি কিনেছে— যে খবর নিয়ে সেই সময় দারুণ হইচই হয়।

জানুয়ারির শেষ দিকে প্রচারিত আল-জাজিরার এক দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, পিকসিক্স নামের একটি ইসরাঈলী প্রতিষ্ঠানের তৈরি ইমসি ক্যাচার নামে এই যন্ত্র দিয়ে ওয়াই-ফাই, সেলুলার এবং ভিডিও নযরদারি করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং ইসরাঈলী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি হয় এবং ২০১৯ সালে পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরিতে দু’জন ইসরাঈলী গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ এই প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর চার জন বাংলাদেশী গোয়েন্দাকে প্রশিক্ষৃণ দেয়। আল-জাজিরা তাদের প্রমাণ হিসাবে নথিপত্র-ছবি-ফুটেজ প্রচার করে, তবে বাংলাদেশ সরকার অবশ্য সেসময় তা অস্বীকার করে।

মন্তব্য : বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী থেকেও ফোনে আড়ি পাতা হয়। মূলত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য তাদের এই কাজের আইনগত বৈধতা রয়েছে। অনেক সময় তারা রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, অ্যাকটিভিস্ট ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ফোনেও আড়ি পেতে থাকে। কিন্তু পেগাসাস স্পাইওয়ারের সংবাদ হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, তা দেশের নিরাপত্তা, ভাবমূর্তি এবং সংবিধান অক্ষুণ্ন রাখাকেচ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কেননা, সংবিধানের ৪৩(খ) ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য দেশ থেকে আমাদের দেশের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপর নযরদারি করা হচ্ছে কিনা তা সরকারকে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাই এবং বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেই পরিষ্কার করতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ করছি।

জুয়েল রানা

* খত্বীব, গছাহার বেগ পাড়া জামে মসজিদ (১২ নং আলোকডিহি ইউনিয়ন), গছাহার, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর;
সহকারী শিক্ষক, চম্পাতলী জান্দিপাড়া ইসলামিক একাডেমি, চম্পাতলী বাজার, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর।



Magazine