কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ভাইরাল রোগে আক্রান্ত হবেন না!

post title will place here

বর্তমান সময় প্রায়শই দেখা যায় উঠতি বয়সের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতি এমনকি ছোট-বড় অনেকেই এখন নিজেকে একটু প্রকাশ করার জন্য বেছে নেয় নানান ধরনের পথ। আর এ পথ বেয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ। নিজেকে কীভাবে বাহিরের দুনিয়ায় প্রকাশ করা যায় এ জন্য বেছে নেয় তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম— ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, এমনকি টিকটক ইত্যাদি। শুধু একটাই নেশা তা হচ্ছে ‘আমাকে ভাইরাল হতে হবে’; ‘আমাকে সেলিব্রেটি হতে হবে’। আর এই ভাইরাল হওয়া আজ এক প্রকার নেশায় পরিণত হয়েছে। আপনাদের সাথে এই ‘ভাইরাল’ নিয়েই আলোচনা করব ইনশা-আল্লাহ।

প্রথমত, আমাদের জেনে নেওয়া যাক ভাইরাল শব্দের শাব্দিক অর্থ কী? খোলাসা করে বলতে গেলে এটির শাব্দিক অর্থ নেই বললেই চলে। এটি কেবল ভাবার্থেই ব্যবহৃত হয়।

এই শব্দটির উৎপত্তি হলো ‘ভাইরাস’ শব্দ থেকে। আর ভাইরাস শব্দটি মূলত ইংরেজি বর্ণমালার V, I, R, U এবং S-এর সমন্বিত রূপ, যেগুলো আলাদাভাবে পূর্ণাঙ্গ একেকটি শব্দ। অর্থাৎ ভাইরাস শব্দটি একটি সংক্ষিপ্ত রূপ, যার পূর্ণরূপ হলো, ‘Vital Information Resources Under Seize’ (ভাইটাল ইনফরমেশন রিসোর্সেস আন্ডার সিজ)। অর্থাৎ ভাইরাস (Virus) শব্দটিকে Noun (বিশেষ্য) ধরে এটির Adjective বা গুণবাচক শব্দ (বিশেষণ) হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভাইরাল (Viral) শব্দটি। আর ভাইরাস শব্দটি যেহেতু দূষণ, জীবাণু বা বিষাক্ত— এ ধরনের অর্থে ব্যবহার করা হয় এবং ভাইরাস যেহেতু খুব দ্রুতই ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়ে বা বিস্তার লাভ করে, তাই হঠাৎ সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া কোনো বিষয় বা ইস্যুকেই ‘ভাইরাল’ বলে উল্লেখ করা হয়।[1]

সুতরাং আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে, ভাইরাল আসলে এক প্রকার ভাইরাসের মতো, যা অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই হিসেবে আজ আমাদের অনেক ভাই-বোন এই ভাইরাসে আক্রান্ত। খুব সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীরা ভাইরাল হতে গিয়ে মৃত্যু কিংবা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপে পা দিচ্ছে।

কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীদের আজ একটা অংশ টিকটকের মতো জঘন্য অ্যাপস ব্যবহার করে মৃত্যুর ফাঁদে পা দিচ্ছে। কারণ একটাই ‘আমাকে ভাইরাল হতে হবে’। এইতো বেশ কয়েক মাস আগের ঘটনা— গত ৮ জুলাই নোয়াখালীর চাটখিলে টিকটক ভিডিও বানানোর সময় অসাবধানতাবশত পা পিছলে সানজিদা আক্তার (১১) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। এরপর ১১ জুলাই কুমিল্লায় চলন্ত ট্রেনের ছাদে টিকটক করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মেহেদী হাসান (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। এছাড়াও টিকটক ভিডিও আপলোড করাকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের মার্চে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত খুন হয়।[2]

শুধু যে টিকটক করতে গিয়েই মৃত্যু তা কিন্তু নয়; এরকম আরও সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যে কত শত কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা ও মৃত্যুবরণ করেছে তার কোনো হিসাব নেই। বিশেষ করে ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে সামান্য লাইক ও কমেন্টের জন্য একজন আরেকজনকে আহত করছে, দিনশেষে দিতে হচ্ছে কত যে প্রাণ তা আর নাই-বা বললাম। সব কিছুর মূলে রয়েছে ‘আমাকে ভাইরাল হতে হবে’।

এই ভাইরাল হওয়ার পিছনে একটা অংশ কাটে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ও টিকটকে, যা বলতে গেলে একেবারেই সময়ের অপচয়। তাছাড়াও অনর্থক কথাবার্তায় কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অথচ সময়ের গুরুত্ব বোঝাতে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সময়ের শপথ করে বলেন,وَالْعَصْرِ - إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ - إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ‘সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়’ (আল-আছর, ১০৩/১-৩)। অন্য আয়াতে প্রকৃত মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ ‘তারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে’ (আল-মুমিনূন, ২৩/৩)

এছাড়াও আমরা হাদীছে দেখতে পাই— আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে তার অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করা’।[3] ইবনু মাসঊদ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদম ও স্ব-স্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না— (১) তার জীবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করেছে, (২) যৌবনের সময়টা কীভাবে ব্যয় করেছে, (৩) ধনসম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে, (৪) তা কীভাবে ব্যয় করেছে এবং (৫) সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা’।[4]

আবার ভাইরালের পিছনে লোকদেখানো একটা প্রবণতা থেকেই যায়, যার ফলশ্রুতিতে মানুষকে করতে হয় নানা ধরনের আঞ্জাম। এমনকি মানুষ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। অথচ আমরা হাদীছে দেখতে পাই— নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লোক-শোনানো ইবাদাত করে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোক-শোনানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি লোকদেখানো ইবাদাত করবে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোকদেখানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন’।[5]

এই ভাইরাল হওয়া রোগে যে শুধু সাধারণ মানুষই আক্রান্ত তা কিন্তু নয়, বরঞ্চ আমাদের আলেম সমাজও আজ এই রোগে আক্রান্ত। হয়তো অনেকেই অবাক হবেন যে, আলেম সমাজ আবার কীভাবে ভাইরাল রোগে আক্রান্ত। হ্যাঁ, সত্যিই আজ আমাদের আলেম সমাজও ভাইরাল রোগে আক্রান্ত।

আপনি একটু ওয়ায-মাহফিলের ময়দানগুলো লক্ষ করলেই দেখবেন যে, কীভাবে আজ আমাদের কিছু আলেম নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মানুষকে ওয়ায-নছীহতের নামে হাসাচ্ছে। নানা ধরনের গান-কৌতুকের মাধ্যমে মানুষকে মজিয়ে রাখছে।

তাছাড়া এক বক্তা ভাইরাল হওয়ার জন্য আরেক বক্তার নামে নানা ধরনের গীবত পর্যন্ত করে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ‘তোমরা একে অপরের যেন গীবত না কর। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ পছন্দ করে? অনন্তর তোমরা তা অপছন্দ কর’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/১২)

আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আমাদেরকে এ রোগ থেকে হেফাযত করুন। আমীন!

মুহাম্মাদ জাহিদ হাসান

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী, দক্ষিণখান, ঢাকা-১২৩০।

[1]. https://www.deshrupantor.com/specially/2019/12/09/185737.

[2]. https://www.jagonews24.com/technology/article/777307#চলতি বছর টিকটক করতে গিয়ে ১০ জনের মৃত্যু।

[3]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৯৭৬, হাদীছ ছহীহ।

[4]. তিরমিযী, হা/২৪১৬, হাদীছ হাসান।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯৯।

Magazine