কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

হঠাৎ লোডশেডিং ভয়াবহভাবে বেড়ে গেল কেন?

post title will place here

দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে গত ১৯ জুলাই থেকে চলছে শিডিউল করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং। প্রতিদিনই রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দফায় দফায় লোডশেডিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে লোডশেডিং আরও তীব্র। অনেক এলাকায় দিনে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হচ্ছে।

সরকার সারা দেশে প্রতি এলাকায় দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং-এর কথা বললেও বাস্তবে কোথাও কোথাও দিনে ৯ ঘণ্টাও হচ্ছে৷ লোডশেডিংয়ের নতুন যে শিডিউল দেওয়া হয়েছে, তাতে কোথাও দিনে তিন ঘণ্টার কম লোডশেডিং নেই৷

২০১২ সালে জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতি মোকাবিলায় দিনে ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার নির্দেশ দেন। এর আগে লোডশেডিংয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না। ২০১৮ সালে সরকার ঘোষণা করে, দেশে উৎপাদন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং নেই। যেটুকু আছে, সেটা বিতরণ সমস্যা ও সিস্টেম লসের কারণে হয়ে থাকে।

হঠাৎ করেই বিদ্যুতের লোডশেডিং ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে৷ কেন বিদ্যুতের এত ঘাটতি দেখা দিল? বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কেন চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না? এর উত্তরে সরকার থেকে জ্বালানি সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর অধিক নির্ভরতা, লোডশেডিংয়ে রেশনিংয়ে সমন্বয়হীনতার কারণে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫২ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।

আর জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোটগ্যাসের ৭০ ভাগই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়।

বিদ্যুৎ সংকটের কারণে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বলানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু৷ এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে৷ এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে৷ গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে৷ যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য সব দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে৷ এ পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি’৷

রাশিয়া জানিয়েছে, পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ অনেক কমিয়ে দেবে তারা। স্বাভাবিক সরবরাহের মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস আসবে। আতঙ্কিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রাসেলসে জরুরী এক বৈঠকে সদস্য দেশগুলোতে আগামী সাত মাস গ্যাসের ব্যবহার কমপক্ষে ১৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইইউ জোটের সাথে মস্কোর সম্পর্ক এখন তলানিতে। প্রতিশোধ নিতে শীতের আগে রাশিয়া গ্যাস দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে বলে ইউরোপে গভীর আতঙ্ক দেখা দিয়েছে

গত আড়াই বছরে করোনার ধকল কাটতে না কাটতেই এবার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। জ্বালানি সংকটের কারণ দেখিয়ে সারা দেশেই লোডশেডিং দিচ্ছে সরকার। ফলে দিনের বেলায় ক্লাসে গিয়েও গরমের কারণে পড়াশোনা করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে সন্ধ্যার পরও কয়েক দফায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে ঘরে বসেও ঠিকমতো পড়াশোনায় মন বসাতে পারেছে না তারা। ফলে করোনায় শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছিল তা সহসা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া গত কয়েক দিনের তীব্র তাপদাহে অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা স্কুলে গিয়েও প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শিক্ষকগণ ক্লাসে গিয়েও লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো নিয়মিত পাঠ কার্যক্রম চালাতে পারছেন না।

শুধু স্কুলের ক্লাসরুমেই নয়, বরং বাসাবাড়িতেও সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, গভীর রাতেও বিদ্যুতের লুকোচুরি চলছে। সবচেয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ চলে গেলে। সারা দেশে প্রত্যেক গ্রাম কিংবা শহরই শুধু নয়; প্রতিটি পরিবারের শিক্ষার্থী সন্তানরাই সন্ধ্যার পরে পড়তে বসে। কিন্তু গত কয়েক দিনের প্রাত্যহিক রুটিনে দেখা গেছে সেখানেও বিভ্রান্তি ঘটছে। সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ না থাকলে অনেক পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই আর বিকল্প আলোতে পড়তে পারছে না। নিয়মিতভাবে এভাবে বিদ্যুতের বিভ্রাট চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবেই তারা পড়াশোনায় আরো পিছিয়ে পড়বে

ভরা মৌসুমে সারা দেশের মতো চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে চা শিল্প। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও গুণগত মান নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। যার প্রভাব পড়বে আগামী রফতানি বাজারে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং শিডিউল চালু হওয়ায় এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের অন্যতম অর্থকরী ও রফতানিযোগ্য ফসল চা।

হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে অনেক সময় অর্ধেক অপারেশন করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে এবং চিকিৎসকদের জেনারেটরের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার কিছু কিছু মেশিন জেনারেটর দিয়ে চালানোও সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া এক্স-রে ও প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টও ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি মোকাবেলায় রেশনিং শুরু করেছে সরকার৷ চাহিদার চেয়ে দেড় হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ নিয়ে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টার লোডশেডিং দিয়ে এটা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু তাতে কি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে হয়তো সাময়িক উপশম হবে৷ কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যেতে হবে৷ আর সেটা সম্ভব গ্যাস ও কয়লা দিয়ে৷ তবে এই খাতে লুটপাট বন্ধ না হলে কিছুতেই কিছু হবে না।

সরকার বিদ্যুতের রেশনিং-এর সাথে সাথে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে ৷ তাতে আরো এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হবে৷ সব মিলিয়ে দেশে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা আছে ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট৷ পাওয়া যাচ্ছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট৷ ঘাটতি আছে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট৷ এই ঘাটতি মেকাবেলা করতেই এখন এলাকাভিত্তিক প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হচ্ছে৷ এতে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম লাগবে বলে সরকার বলছে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম মনে করেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিসেবে ফাঁকি আছে৷ পিক আওয়ারে যদি শপিংমলসহ দোকানপাট বন্ধ রাখা হয় তাহলে খুব সামান্যই লোডশেডিং হওয়ার কথা, এক ঘণ্টা নয়৷ বাস্তবে গ্রামে আগে থেকেই লোডশেডিং আছে৷ এখন এক ঘণ্টা নয় আরো বেড়েছে।

সেই সাথে সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার জন্য রাত আটটার পর শপিংমল, দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে৷ অফিস সময়ও পরিবর্তন হতে পারে৷ সব দাপ্তরিক মিটিং ভার্চুয়ালি করার জন্য বলেছে৷ ছালাত ও প্রার্থনার সময় ছাড়া মসজিদ ও উপাসনালয়ে এসি বন্ধ রাখতে বলেছে৷ আর জ্বালানি তেলের ওপর চাপ কমাতে সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করছে৷

উৎপাদন ও সঞ্চালনে সার্বিক অবকাঠামোগত সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশে চলমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসন হতে এ বছর পেরিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা অচিরেই এ সংকটের সমাধান হয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।


জুয়েল রানা

 খত্বীব, গছাহার বেগ পাড়া জামে মসজিদ (১২ নং আলোকডিহি ইউনিয়ন), গছাহার, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর।

Magazine