সম্প্রতি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ‘শ্বেতপত্র: বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ নামের একটা প্রকাশনা উন্মোচন করেছে। গত মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান কামাল এই শ্বেতপত্র প্রকাশনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন।
দুই মাস আগে এই শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলেও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে মূলত ১১৬ জন আলেমের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশের পর। এই শ্বেতপত্র তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও জমা দিয়েছে এবং শ্বেতপত্রে তাদের দেওয়া সুপারিশগুলো বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে।
আমাদের দেশে যাদের সম্পদের হিসাব জনগণ দাবি করে তারা সেটা করেন না। মন্ত্রী-সাংসদদের হিসাব প্রকাশের কথা থাকলেও তারা করেন না। বরং ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ক্ষমতা-হারা হয়ে যাওয়ার পর দুদকের পক্ষ থেকে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, জেল-জরিমানাও হয়। তারাও সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।
গত দুই দশকের সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমেই প্রায় ৯০% তথ্য উক্ত শ্বেতপত্রে সংকলিত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে চূড়ান্ত অসততা ও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে এসব পুরাতন তথ্য যাচাই, সম্পাদনা বা হালনাগাদও করা হয়নি। ফলে এই শ্বেতপত্রের পাতায় পাতায় অসংখ্য ভুল তথ্য, অর্ধ সত্য ও নানা রকম অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামও এখানে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বর্তমান স্থিতিশীল পরিবেশকে বিনষ্ট করে আলেম-উলামা ও সরকারকে মুখোমুখি করার একটি হীন, অপপ্রয়াস হিসেবেই গণকমিশন এই পদক্ষেপ নিয়েছে। হঠাৎ দৃষ্টিপটে আসা ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’ নামক এক সংগঠন গত ১১ মে দেশের কতিপয় ওলামা মাশায়েখ ও ওয়ায়েযীনকে ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ আখ্যা দিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। ১১৬ জন আলেমের এবং এক হাজার মাদরাসার বিরুদ্ধে ২২ শত পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রে অর্থ পাচার, সন্ত্রাস উসকে দেওয়া, নারীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা ইত্যাদি নানান ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করে দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্তের জন্য আবেদন করা হয়। ‘গণকমিশন’-এর এসব পদক্ষেপ দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তালিকাভুক্ত ওই সব ওলামা-মাশায়েখের সবাই দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত, মাননীয় এবং জনপ্রিয়। অথচ ‘গণকমিশন’-এর কর্তাব্যক্তি যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের কেউ কেউ সমাজে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত এবং বিতর্কিত। তাদের কারো কারো বিরুদ্ধেই বরং বিভিন্ন সামাজিক অভিযোগ রয়েছে। এই সব বিতর্কিতরাই জাতির সম্মানিত ও দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
গত ২০ মে, ২০২২ (শুক্রবার) সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে লায়ন্স ক্লাবের ২৭তম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, ‘১১৬ জনকে ধর্ম ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমন্বয়ে ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস’ তদন্তে গঠিত গণকমিশনের অভিযোগের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই’।
এই ভুঁইফোঁড় সংগঠনটি বরাবরের মতোই নিজেদের ইসলামবিদ্বেষী চেহারা জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে। তাদের এই শ্বেতপত্র যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং মিথ্যা তথ্যে ভরপুর, এটি সমগ্র দেশবাসীর সামনে আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
২.
গত কয়েক মাস ধরেই শ্রীলংকা অর্থনৈতিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত। দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তীব্র ঘাটতি রয়েছে। দেশটির পেট্রোল, ওষুধ এবং বৈদেশিক রিজার্ভ শেষ হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে সরকারের প্রতি ক্ষোভে ফুঁসে উঠে জনগণ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নামে। এক পর্যায়ে জনতা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে এবং তার মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। এরপর নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। দেশটির চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য দেশটির বেশিরভাগ মানুষ দুষছেন বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা বা সংক্ষেপে ‘গোটা’কে।
শ্রীলংকান রাজনীতিবিদরা জনগণকে রাজনীতির নামে সস্তা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে প্রায় দুই দশক ধরে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে দেশকে তলানিতে ঠেকিয়েছেন। আমি মনে করি যারা শাসনের নামে জনগণের ভাগ্য নিয়ে টালবাহানা করে, তাদের শ্রীলংকার রাজনৈতিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষা নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ রাজনীতি কারও জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। রাজনীতি সব সময়ই পরিবর্তনশীল, এমনকি যে সমাজে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা বদলের রাস্তা নেই, সেখানেও চিরস্থায়ী ক্ষমতা বলে কিছু নেই। বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকদের পতনের ইতিহাস সেদিকেই ইঙ্গিত করে। শ্রীলংকার সাথে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মানুষের আগ্রহে কোনো ঘাটতি দেখছি না। পূর্ব ইউরোপের এই যুদ্ধ ঘিরে নানা ধরনের আলোচনা, জল্পনাকল্পনা হচ্ছে, যার একটি হচ্ছে পারমাণবিক সংঘাতের আশঙ্কা।
এতদিন পর্যন্ত রাশিয়ার আগ্রাসন এবং হত্যাযজ্ঞ থামানো যাচ্ছে না। কারণ বেশি কিছু করতে গেলে প্রেসিডেন্ট পুতিন পারমাণবিক বিস্ফোরণ বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারেন- এই ভয়ে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্র কাদের কাছে নিরাপদ? আমেরিকা ইরাক ধ্বংস করেছিল পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে। এমনকি তারা ইরানকেও ওই একই অজুহাত দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যদি ইরাক-ইরান বা অন্য দেশগুলোকে বিশ্বাস না করা যায় তাহলে রাশিয়া, ইসরাঈল, আমেরিকার মতো দেশগুলোকে কেন বিশ্বাস করতে হবে? বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক অস্ত্র কারোর কাছে নিরাপদ নয়। পারমাণবিক অস্ত্র নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বিতর্কিত একটি অস্ত্র।
ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটি এত ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে এর আগে কখনও পড়েনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশও শ্রীলংকার মতো ব্যয়বহুল কিন্তু সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রকল্পে বিদেশী ঋণ নিয়েছে, যাকে সমালোচকরা ‘শ্বেত-হস্তী’ প্রকল্প বলে থাকেন। শ্রীলংকার কিছু লক্ষণ ধীরে ধীরে বাংলাদেশে প্রকট হচ্ছে। আমরা চাই না আমাদের দেশ শ্রীলংকার মতো হোক, তবে বাস্তবতা কি আমরা এড়াতে পারব?
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন!
জুয়েল রানা
খত্বীব, গছাহার বেগ পাড়া জামে মসজিদ (১২ নং আলোকডিহি ইউনিয়ন), গছাহার, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর।