কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

রক্তাক্ত গাযা: পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে এক ভূখণ্ড, এক জাতি

অবরুদ্ধ গাযা উপত্যকায় ইসরাঈলের নৃশংস হামলায় আবারও রক্ত ঝরল। একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনী। গত ১৮ মাস ধরে চলা এ আগ্রাসনে শহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭০০ ছাড়িয়েছে। শুধু গত ২০ দিনেই ইসরাঈল হত্যা করেছে ৫০০’র বেশি শিশু, আর শহীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৩৫০ জনে।

৭ এপ্রিল (সোমবার) আল জাজিরার খবরে বলা হয়, দেইর আল-বালাহের পাঁচটি এলাকার বাসিন্দাদের এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ার পর ইসরাঈল গাযার মধ্যাঞ্চলে নতুন করে বোমাবর্ষণ করে। এতে নিহত হন আরও অনেক নিরীহ মানুষ, যাদের মধ্যে একজন সাংবাদিকও রয়েছেন। এর আগের দিন, ৬ এপ্রিল, ৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনী নিহত হন আরেক দফা ইসরাঈলি হামলায়।

এর আগেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (Iরাযিয়াল্লাহু আনহুরাযিয়াল্লাহু আনহু) গাযায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইসরাঈলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। গাযায় চলমান হত্যাযজ্ঞকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলাও চলছে।

গাযা: এক প্রাচীন শহর, আজ মৃত্যুপুরী

গাযা (আরবীতে: غَزَّةُ) ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ১৪০ বর্গমাইল আয়তনের একটি ছোট উপত্যকা। দক্ষিণ-পশ্চিমে মিসর এবং পূর্ব ও উত্তরে ইসরাঈলের ঘেরাটোপে আবদ্ধ এই ভূখণ্ডটি একদিকে যেমন ইতিহাসে সুপ্রাচীন, অন্যদিকে আজ এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন এলাকা।

গাযার আয়তন ঢাকার সমান হলেও, জনসংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ—জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৬,৫০৭ জন। এখানকার ৯৯% মানুষ সুন্নী মুসলিম এবং প্রায় সবাই ফিলিস্তিনী আরব। এই ছোট ভূখণ্ডটি যেন মানবতার লাশঘরে পরিণত হয়েছে।

গাযার ইতিহাস প্রায় ৪,০০০ বছরের পুরোনো। এটি একসময় ছিল মিসরীয়, আসিরীয়, গ্রীক, আরব ও অটোমানদের শাসনাধীন। ইসলামের যুগে গাযা ছিল এক প্রাণবন্ত কেন্দ্র। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আমর ইবনে ‘আছ রাহিমাহুল্লাহ-এর নেতৃত্বে মুসলিমরা শহরটি জয় করেন। এরপর এটি হয়ে ওঠে জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বযুদ্ধ ও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের পটভূমিতে শুরু হয় ফিলিস্তীনিদের দুর্বিষহ যাত্রা। ১৯৪৮ সালে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে গাযা বারবার আক্রমণের শিকার হয়। ২০০৫ সালে ‘ফলস ডেমোক্রেসির’ নামে ইসরাঈল কিছু সেনা প্রত্যাহার করলেও বাস্তবে গাযা এক খোলা বন্দিশিবিরে রূপ নেয়।

গাযা ও ঢাকা: ভৌগোলিক সাদৃশ্য, ভাগ্যের বৈপরীত্য

বাংলাদেশের মতো গাযাও তিন দিক দিয়ে এক দেশের ঘেরাটোপে। বাংলাদেশের আড়াই দিক ভারত ঘিরে রেখেছে, আর গাযাকে মিসর ও ইসরাঈল। ঢাকার মতো আয়তনে ছোট হলেও, গাযার ভাগ্যে জুটেছে শুধু আগুন, বোমা আর মৃত্যুর গন্ধ।

গণহত্যার মুখে গোটা জাতি: যুদ্ধ নয়, নিঃসন্দেহে অপরাধ

ফিলিস্তীনে যুদ্ধ হচ্ছে না; এটি একটি পরিকল্পিত, ঠাণ্ডা মাথার গণহত্যা। যুদ্ধের নামে নারী, শিশু ও হাসপাতালকে টার্গেট করে বোমা ফেলা হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে ঘরবাড়ি, ধর্মীয় স্থাপনা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস।

বিশ্ব মিডিয়া, বিশেষ করে পশ্চিমা প্রচারযন্ত্র, ইসরাঈলের পক্ষ নিয়ে একপাক্ষিক সংবাদ প্রকাশ করছে। তারা ‘মিথ্যা যুদ্ধের গল্প’ ছড়িয়ে দিয়ে গাযার আসল রক্তাক্ত চিত্র আড়াল করছে। মানবতার ভাষা শেখায় যারা, তারাই আজ মানবতা হত্যা করছে।

একাত্মতার সময় এখনই: উম্মাহর দায়িত্ব এবং আহ্বান

মুসলিম উম্মাহর এই মুহূর্তে প্রয়োজন ঐক্য, সাহস এবং বাস্তব পদক্ষেপ। শুধু বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। দরকার দু‘আর পাশাপাশি শক্ত অবস্থান। যারা ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন চালায়, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যেমন জরুরী, তেমনি ইসরাঈলি বর্বরতার বিরুদ্ধেও জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

আজ যারা নির্যাতনের শিকার, তাদের কান্না আকাশ কাঁপায়, আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আমাদের উচিত এক দেহের মতো হয়ে মাযলূমদের পাশে দাঁড়ানো।

শেষকথা:

গাযা আজ আমাদের চোখের সামনে রক্তাক্ত হচ্ছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ রেহাই পাচ্ছে না। অথচ বিশ্ব নীরব! এই নীরবতাই সবচেয়ে ভয়ংকর। আসুন! আমরা গাযার জন্য দু‘আ করি, সচেতন হই, লিখি, বলি, প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

হে আল্লাহ! তুমি গাযার নির্যাতিত মানুষদের হেফাযত করো। তুমি মানবতার এই চরম সংকটে তাদের রক্ষাকারী হও- আমীন!

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

Magazine