কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আক্বল বনাম নাফস: অন্তর্জগতের দ্বন্দ্ব ও সত্য পথে চলার সংগ্রাম

ভূমিকা:

আল্লাহ তাআলা আমাদের স্রষ্টা। তিনি আমাদের শুধু শরীর দিয়ে সৃষ্টি করেননি; বরং দিয়েছেন আত্মা, আক্বল (বিবেক-বুদ্ধি) ও নাফস (মন)। এই আক্বল ও নাফসের মাঝে প্রতিনিয়ত এক নীরব, কিন্তু ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। এটাই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আলোচনার বিষয় হলো আক্বল ও নাফস, এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব এবং আমাদের করণীয় কী?

নাফস কী?

‘নাফস’ হলো মানুষের ভিতরের চাহিদা, লালসা, প্রবৃত্তি ও নিজেকে বড় ভাবার অভ্যন্তরীণ শক্তি। এই নাফসকে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বিভিন্ন স্তরে বর্ণনা করেছেন। কুরআনে নাফসের তিনটি অবস্থা উল্লেখ আছে।

১.নাফসে আম্মারাহ (যেই নাফস খারাপের প্রতি আহ্বান করে): আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي ‘নিশ্চয় নাফস মন্দ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে, তবে আমার রব যাকে দয়া করেন সে ছাড়া’ (ইউসুফ, ১২/৫৩)। এটি সেই নাফস যা মানুষকে সর্বদা গুনাহ, লোভ, হিংসা, ব্যভিচার, অহংকার, অন্যায় ও অপকর্মের দিকে আহ্বান করে।

২.নাফসে লাওয়ামাহ (তিরস্কারকারী নাফস): আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ ‘আরও শপথ করছি তিরস্কারকারী নাফসের’ (আল-ক্বিয়ামাহ, ৭৫/২)। এটি সেই অন্তর, যা সবসময় নিজেকে তিরস্কার করে; ভালো কাজ করলে এই বলে তিরস্কার করে, “আরও কেন বেশি করলাম না” আর মন্দ কাজ করলে এই বলে তিরস্কার করে, “হায়! আফসোস, যদি এটা না করতাম!”

৩. নাফসে মুত্বমাইন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা): আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ‘হে প্রশান্ত আত্মা!’ (আল-ফজর, ৮৯/২৭)। এটি হলো সেই আত্মা, যা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে তৃপ্ত, গুনাহ থেকে মুক্ত এবং নেক আমলের মাঝে প্রশান্ত।

আক্বল কী?

‘আক্বল’ হলো মানুষের সেই বিবেক ও যুক্তি-বুদ্ধি, যা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন ন্যায়ের পথে চলার জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ ‘আমি আদমসন্তানকে মর্যাদা দিয়েছি’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৭০)

এই মর্যাদার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আল্লাহ মানুষকে ‘আক্বল’ দিয়েছেন, যা কোনো জীবজন্তুর নেই। মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের গুনাহ করার মতো মনমানসিকতা দেননি আর জীবজন্তুর নৈতিকতা নেই। কিন্তু মানুষকে দেওয়া হয়েছে নৈতিক বিবেক আর সেই আক্বল, যা তাকে তার নাফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। কাজেই পাপ কাজের প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও যখন মানুষ আল্লাহকে ভয় করে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে, তখনই তার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

আক্বল বনাম নাফস:

এই আক্বল ও নাফসের মধ্যেই চলে মানুষের আসল যুদ্ধ। আক্বল মানুষকে বলে, সৎ পথে চলো, সচেতন হও, আল্লাহকে ভয় করো। পক্ষান্তরে নাফস বলে, আরাম করো, পাপ করো, মানুষ দেখছে না, সমস্যা নেই।

উদাহরণস্বরূপ ধরুন, কেউ মোবাইল ফোনে হারাম কিছু দেখছে। এক্ষেত্রে আক্বল বলছে, এটা গুনাহ, আল্লাহ দেখছেন, বিরত হও; কিন্তু নাফস বলছে, কেউ দেখছে না, শুধু একবার দেখলে কিছু হয় না।

এই দ্বন্দ্বে যে নাফসের কথা শোনে, সে পাপের পথে চলে যায় আর যে আক্বলের কথা শোনে, সে জান্নাতের পথে এগিয়ে যায়।

নাফসের সাথে যুদ্ধ:

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي طَاعَةِ اللَّهِ ‘আর প্রকৃত মুজাহিদ হলো সে, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজের নাফসের সাথে জিহাদ করে’।[1] এই হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন, প্রকৃত জিহাদ শুধু শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ নয়; বরং নিজের ভেতরের খেয়াল-খুশি, গুনাহের প্রবণতা ও দুনিয়াবী লালসার বিরুদ্ধে লড়াই করাও একটি বড় জিহাদ।

নাফস সবসময় মানুষকে গুনাহ, অলসতা, অহংকার, হিংসা, লোভ ইত্যাদির দিকে টানে। এগুলো দমন করে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে স্থির রাখা—এটাই হচ্ছে নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ।

নাফসকে পরাজিত করার উপায়:

১. তাওহীদ ও তাক্বওয়া বৃদ্ধি করা: আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কেবল আল্লাহভীরুদের থেকেই (তাদের কৃত আমল) কবুল করে থাকেন’ (আল-মায়েদা, ৫/২৭)

২. নিয়মিত তওবা করা: রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে কুদসীতে বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তওবা করো, হে ঈমানদারগণ!’ (আন-নূর, ২৪/৩১)[2]

৩. সৎ ও পরহেযগার বন্ধু বেছে নেওয়া: যারা আল্লাহকে ভয় করে, তারা নাফসের ফাঁদ থেকে আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে। তাই আমাদের উচিত তাক্বওয়াবান বন্ধু নির্বাচন করা।

৪. নফল ইবাদত করা: ছওম, তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল ইবাদত নাফসকে দুর্বল করে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, الصَّوْمُ جُنَّةٌ ‘ছওম ঢালস্বরূপ’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৯২)

৫. নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদকে গুরুত্ব দেওয়া: নিজের মনের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। সহজে তাকে পাপের অনুমতি দিবেন না। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি যা করছি, আল্লাহ কি তাতে খুশি হচ্ছেন?

সফলতা কোথায়?

আল্লাহ তাআলা বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا، وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا ‘যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফল হয়েছে। আর যে একে কলুষিত করেছে, সে ব্যর্থ হয়েছে’ (আশ-শামস, ৯১/৯-১০)

অতএব, সফলতা সেই ব্যক্তির, যে নাফসকে দমন করে এবং আক্বলকে অনুসরণ করে।

উপসংহার:

সুধী পাঠক! নাফস এমন এক শত্রু, যে আমাদের নিজের ভেতরেই বাস করে। এটা আমাদেরকে গুনাহের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু আক্বল ও ঈমান আমাদেরকে সঠিক পথ দেখায়। আমরা যদি আক্বলকে প্রাধান্য দিয়ে কুরআন ও হাদীছের শিক্ষা অনুসরণ করে চলি, তাহলে আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হব, ইনশা-আল্লাহ!

আল্লাহ আমাদের নাফসকে নিয়ন্ত্রণ করার তাওফীক্ব দান করুন। আমাদের আক্বলকে নূরের পথ দেখান এবং তাক্বওয়ার শক্তিতে ভরপুর করে দিন- আমীন!

আদিল বিন ফোরকান

 শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. সিলসিলা ছহীহা, হা/৫৪৯; বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, হা/১০৬১১।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭০২।

Magazine