কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

নববী দু‘আ পেয়েছেন যারা

ভূমিকা: মনে মনে কল্পনা করুন— নবীকুলের শিরোমণি, রহমাতুল্লিল আলামীন, জগতের শ্রেষ্ঠ মানব, মুছত্বফা, মুজতাবা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যমযমে ধোয়া পরিশুদ্ধ অন্তর থেকে আপনার জন্য দু‘আ করছেন। তাঁর একক রব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে আপনার জন্য মাগফেরাত চাচ্ছেন বা আপনার বিদ্যা বৃদ্ধির ফরিয়াদ করছেন কিংবা আপনার জন্য বলছেন, আল্লাহ! তুমিএকেভালোবাসো’। এক জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি কিছু হতে পারে! নববী বরকতময় দু‘আ পাওয়ার পর পৃথিবীর বুকে আপনার চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কেউ কি হতে পারে! ছাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুম-এর মাঝে বেশ কিছু ছাহাবী নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যবান থেকে দু‘আ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন। সেই দু‘আর বরকতে তাঁদের একেকজনের জীবন হয়ে উঠেছিল একেক দিক থেকে বিস্ময়কর সুন্দর। যারা দু‘আ পেয়েছিলেন, তাঁরা বাস্তব জীবনে সেই দু‘আর প্রতিফলন দেখেছেন। যা স্পষ্টত রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মু‘জিযার সাক্ষী। এই আলোচনায় আমরা নববী দু‘আপ্রাপ্ত কয়েকজন ছাহাবীর কথা জানব ইনশা-আল্লাহ।

১. আয়েশা বিনতু আবীবকর রাযিয়াল্লাহু আনহা: একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রফুল্ল মনে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর কাছে ছিলেন। এমন এক অন্তরঙ্গ সময়ে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা তাঁর এই খুশি মন দেখে নম্র অনুরোধে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য একটু দু‘আ করুন’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে দু‘আ করলেন, اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَائِشَةَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنَبِهَا وَمَا تَأَخَّرَ، مَا أَسَرَّتْ وَمَا أَعْلَنَتْ ‘হে আল্লাহ! আয়েশার পূর্বের-পরের সব পাপ ক্ষমা করোসে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে যা করেছে, সব তুমি মাফ করো’ প্রিয়তম স্বামী ও জগতের সর্বোত্তম মানবের কাছ থেকে এমন সুন্দর দু‘আ পেয়ে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা আনন্দে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে তাঁর মাথা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মমতাময় কোলে জায়গা করে নিল। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমার এই দু‘আর কারণেই কি তুমি এত খুশি হয়েছ?’ আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ‘এমন দু‘আ পেয়ে খুশি না হয়ে থাকা যায়’। উম্মতপ্রেমী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, وَاللَّهِ إِنَّهَا لَدُعَائِي لِأُمَّتِي فِي كُلِّ صَلَاةٍ ‘আমার উম্মতের জন্য প্রত্যেক ছালাতে আমি এই দু‘আ করি’।[1]

২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা: উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা রাযিয়াল্লাহু আনহা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর খালা ছিলেন। একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়মূনা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর ঘরে অবস্থান করছিলেন। সেসময় সেখানে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমাও ছিলেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযূ করতে গেলে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর জন্য ওযূর পানি রেখে দেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওযূর পানি কে এনে দিল?’ মায়মূনা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস আপনার জন্য এই পানি রেখেছে’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাঁর কাঁধে হাত রেখে দু‘আ দিয়ে বললেন, اللهُمَّ فَقِّهْهُ فِي الدِّينِ، وَعَلِّمْهُ التَّأْوِيلَ হেআল্লাহ!তাঁকেদ্বীনেরগভীরজ্ঞানদানকরোএবংতাফসীরবাব্যাখ্যারজ্ঞানপ্রদানকরো’।[2]

অন্য রেওয়ায়েতে ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, اللَّهُمَّ عَلِّمْهُ الحِكْمَةَ হেআল্লাহ!তাঁকেহিকমাহতথাজ্ঞান-প্রজ্ঞাঅন্তর্দৃষ্টিশিক্ষাদাও’।[3]

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই দু‘আর বরকতে তিনি হয়ে উঠেন ‘রাইসুল মুফাসসিরীন’ তথা ‘তাফসীরকারকদের সেরা’। তাঁকে বলা হতো ‘হাবরুল উম্মাহ’ তথা ‘উম্মাহর পণ্ডিত’। তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক বেশি হাদীছ বর্ণনা করেছেন, যার সংখ্যা প্রায় ১৬৬০টি। শ্রেষ্ঠ ছাহাবী উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত বড় কোনো মাসআলাতে তাঁর শরণাপন্ন হতেন।

৩. আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু: সর্বাধিক হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী হলেন আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি প্রায় ৫৩৭৪টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। কোনো হাদীছ তিনি ভুলে যেতেন না। যদিও ভুলে যাওয়া মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। তাঁর এই অসাধারণ স্মরণশক্তির পিছনে আছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু‘আর বারাকাহ। একদা তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিনীত স্বরে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার থেকে অনেক হাদীছ শুনি, কিন্তু পরক্ষণেই তা ভুলে যাই’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার চাদরটা বিছিয়ে দাও’। আমি চাদর বিছিয়ে দিলাম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাত ভরে তা চাদরের মধ্যে ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘জড়িয়ে নাও’। আমি চাদরটি বুকে জড়িয়ে নিলাম। এরপর থেকে আমি আর কখনো কোনো হাদীছ ভুলিনি।[4]

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামগ্রহণের পরও তাঁর মা মুশরিক থেকে যান। এমনকি তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে অশ্রাব্য কথাবার্তা বলতেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে সকাল-সন্ধ্যা ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন কিন্তু তিনি কোনোমতেই ইসলামে রাজি হচ্ছিলেন না। একদিন আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু ভাঙা মনে কাঁদতে কাঁদতে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অনুনয় করে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার মা কিছুতেই ইসলাম মেনে নিচ্ছেন না! আপনি একটু আমার মায়ের জন্য দু‘আ করুন’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে বললেন, ‘হে রব! তুমি আবূ হুরায়রার মাকে হেদায়াত দাও’

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে দু‘আ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। দরজার কাছাকাছি আসতেই তাঁর মা তাঁকে সেখানেই থেমে যেতে বলেন। গোসল করলেন, জামা পরলেন এবং তাড়াহুড়োতে খিমার না পরেই দরজা খুলে দিয়ে কালেমা শাহাদাহ পাঠ করে মুসলিমা হয়ে গেলেন। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু খুশিতে আত্মহারা হয়ে আনন্দাশ্রু ছাড়তে ছাড়তে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হলেন। মায়ের ইসলাম কবুল করার সুসংবাদ দিয়ে আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহকে একটু বলুন না, তিনি যেন আমাকে ও মাকে সকল মুমিনদের কাছে প্রিয় করে দেন। আর তাঁদেরকেও আমাদের প্রিয়ভাজন করে দেন’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এই আবেদন রাখলেন এবং দু‘আ করলেন। যে দু‘আর ফলে এমন কোনো মুমিন নেই, যিনি আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখেছেন কিংবা তাঁর কথা শুনেছেন কিন্তু তাঁকে ভালোবাসেননি।[5]

৪. আনাস ইবনে মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু: আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন আনছারী ছাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী। যেখানে অন্য আবাদীতে বছরে একবার ফসল হতো, সেখানে তাঁর বাগানে বছরে দু‘বার ফল ধরত।[6] শুধু তাই নয়, তাঁর ছিল ১০০টিরও বেশি সন্তানসন্ততি। ছাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে যিনি বেশি হায়াত পেয়েছিলেন, তিনি হলেন আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু। ১০৩ বছর জীবিত ছিলেন তিনি। তাঁর এমন দীর্ঘ হায়াত, শতাধিক সন্তান ও অঢেল ধনদৌলতের পিছনে ছিল রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু‘আ। ছোটবেলায় তাঁর মা উম্মু সুলাইম তাঁকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এনে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই হলো আনাস, আমার ছেলে, সে আজ থেকে আপনার খাদেম। তাঁর জন্য একটু দু‘আ করুন’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করে দিলেন, اللَّهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ، وَوَلَدَهُ، وَبَارِكْ لَهُ فِيمَا أَعْطَيْتَهُ ‘আল্লাহ! তাঁকে অঢেল সম্পদ দাও ও সন্তান সংখ্যা বাড়িয়ে দাওতুমি তাঁকে যা দিয়েছ, তাতে বারাকাহ দাও’[7]

৫. উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু: ইসলামগ্রহণের পূর্বে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের ঘোর শত্রু ছিলেন। এমনকি তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করার জন্য উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে বের হয়েছিলেন। আবূ জাহলের মতো ক্ষমতাধর ছিলেন তিনি। বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম কবুলের কথা শুনে তিনি ছুটে গিয়ে তাঁদের আঘাতও করেছিলেন।[8] কিন্তু পরবর্তীতে তিনি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে মুসলিম হন। তাঁর এই ইসলামগ্রহণ ও ইসলামের একজন কিংবদন্তি ব্যক্তি হওয়ার পিছনে ছিল রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দু‘আ। তিনি দু‘আতে বলেছিলেন, اللَّهُمَّ أَعِزَّ الإِسْلاَمَ بِأَحَبِّ هَذَيْنِ الرَّجُلَيْنِ إِلَيْكَ بِأَبِي جَهْلٍ أَوْ بِعُمَرَ بْنِ الخَطَّابِ ‘হে আল্লাহ! আবূ জাহল আর উমারের মধ্যে যে তোমার কাছে প্রিয়, তাঁর দ্বারা তুমি ইসলামকে শক্তিশালী করো’।[9] আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর দ্বীনের জন্য উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বেছে নিয়েছিলেন। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের জন্য হয়ে উঠেছিলেন শক্ত মযবূত প্রাচীরের মতো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর যবানে ও অন্তরে হক্ব প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন। ইবনে মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ব্যাপারে বলেন, ‘উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ইসলামগ্রহণ ছিল বিজয়, হিজরত ছিল সহায়তা আর খেলাফত ছিল রহমত’।[10] নববী দু‘আর বারাকাতে তাঁর দ্বারা ইসলাম সর্বদা আগে বাড়তে থেকেছে।

৬. আলী ইবনু আবী তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহু: আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুভূতি ছিল খুবই আশ্চর্যজনক। তাঁর শরীরে ঠাণ্ডা, গরমের কোনো প্রভাব পড়ত না। অসহ্য গরম তাঁকে ঘামাতে পারত না। জ্বলন্ত রোদ তাঁকে পুড়াতে পারত না। ‌হাড় কাঁপানো শীত তাঁকে স্পর্শ করতে পারত না। যার শীত নেই, নেই গরমের আতিশয্য। যার অনুভব সবসময় নাতিশীতষ্ণ। প্রচণ্ড গরমে তিনি শীতের মোটা পোশাক পরতেন আর মাঘের শীতে তিনি গরমের পাতলা পোশাক পরতেন। তাঁর কাছে এই অদ্ভুত ক্ষমতার রহস্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘একবার আমার চোখ উঠেছিল। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখে একটু থুথু ছিটিয়ে ‍দিয়ে চোখ খুলতে বললেন। চোখ খোলার পর থেকে অদ্যাবধি আর কখনো সেখানে ব্যথা অনুভব করিনি। এরপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার জন্য দু‘আ করলেন, اللَّهُمَّ أَذْهِبْ عَنْهُ الْحَرَّ وَالْبَرْدَ ‘আল্লাহ! আলীকে গরম ও ঠাণ্ডা থেকে নিরাপদে রাখো’ এই দু‘আর পর থেকে আর কখনো আমি ঠাণ্ডা, গরম অনুভব করিনি’।[11]

৭+৮. হাসান ও হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুমা: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদরের দু’নাতি ছিলেন হাসান ও হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুমা। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের এত বেশি ভালোবাসতেন যে, কোলে তুলে আদুরে চুমু এঁটে দিতেন তাঁদের গালে। কখনো বা ছালাতে তাঁদেরকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়াতেন। তাঁদেরকে এত মমতা করতেন যে, তাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছেন, اللَّهُمَّ إِنِّي أُحِبُّهُمَا فَأَحِبَّهُمَا ‘হে আল্লাহ! আমি এদের দুজনকে ভালোবাসিতুমিও তাঁদেরকে ভালোবাসো’[12] সুবহানাল্লাহ! জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটি যাদের বলেন ‘ভালোবাসি’, তাঁদের আর কীসের অভাব! ভালোবাসার নয়নমনি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রবকে ডেকে বলছেন, ‘তুমি তাঁদের ভালোবাসো’, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর এই জীবনে কী হতে পারে!

শুধু কী তাই! ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে বাক্য দিয়ে তাঁর দু’সন্তান ইসমাঈল ও ইসহাক্ব আলাইহিমাস সালাম-এর জন্য দু‘আ করতেন, ঠিক একই বাক্য ব্যবহার করতেন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় দুই স্নেহের দুলালের জন্য। তিনি তাঁদের মাথায় হাত রেখে বলতেন, أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ ‘আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ বাণীর মাধ্যমে শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী ও কুদৃষ্টির অনিষ্ট থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।[13] সুবহানাল্লাহ! নবীকুলের শিরোমণির এমন দু‘আর পরও কোন অশুভ দৃষ্টি আছে, তাঁদের দিকে তাকাতে পারে? কোন শয়তান আছে, তাঁদের ক্ষতি করতে পারে? কোন বিষদাঁত আছে, তাঁদেরকে ছুঁতে পারে?

এমনকি কলিজার নাতিদের ভালোবাসাকে তিনি নিজের ভালোবাসার সাথে সম্পৃক্ত করে বলেন, ‘যারা তাঁদেরকে ভালোবাসল, তারা আমাকে ভালোবাসল। আর যারা তাঁদেরকে ঘৃণা করল, তারা আমাকে ঘৃণা করল’।[14]

৯. সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ রাযিয়াল্লাহু আনহু: বদরের তুমুল যুদ্ধে যখন আকাশ-বাতাস থমকে স্তব্ধ, যখন ছাহাবীদের একমাত্র শক্তি ঈমান আর একমাত্র সম্বল আল্লাহর সাহায্য, ‍ঠিক সেই কঠিন মুহূর্তে এক বীর মুজাহিদ ছাহাবী সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ রাযিয়াল্লাহু আনহু তির ছুঁড়ছিলেন শত্রুবাহিনীর উপর। তূণীর থেকে তির বের করে ধনুকের সুতাই লাগাতে লাগাতে তিনি বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ! কাঁপিয়ে দাও শত্রুর পা, ভয় ঢুকিয়ে দাও তাদের অন্তরে, ধ্বংস করো তাদের সব পরিকল্পনা’। তাঁর এই দু‘আ শুনে পাশ থেকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ! ‍তুমি সা‘দের দু‘আ কবুল করো’। সেইদিন থেকেই শুরু হলো সা‘দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দু‘আ কবুলের যাত্রা। তিনি যে দু‘আই করতেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কবুল করে নিতেন। তিনি এই মহান তাওফীক্ব পেয়েছিলেন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু‘আর বারাকাতে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য দু‘আ করে বলেছিলেন, ‘হে রব! সা‘দের দু‘আগুলো তুমি কবুল করে নিয়ো’[15]

১০. উরওয়া ইবনু আবিল জা‘দ আল-বারেক্বী রাযিয়াল্লাহু আনহু: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে একটি ছাগল কেনার জন্য এক দীনার দেন। তিনি সেই দীনার দিয়ে দুটি ছাগল কিনেন। দুটির মধ্যে একটিকে আবার এক দীনারের বিনিময়ে বিক্রি করেন। এরপর সেই দীনার ও আগে কেনা ছাগলটি নিয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হন। রাসূলছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতাঁরএইবুদ্ধিমত্তাদেখেতাঁরজন্যবরকতেরদু‘আকরেন এই দু‘আর পর থেকে ব্যবসায় লাভবান হতে থাকলেন তিনি। এমনকি তিনি যদি মাটি ক্রয়বিক্রয়ও করতেন, তাতেও তাঁর মুনাফা হতো।[16]

১১. উক্কাশাহ ইবনে মিহছান রাযিয়াল্লাহু আনহু: একদিন ছাহাবীদের মাঝে বসে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমার কাছে সব উম্মতকে পেশ করা হয়েছে। তাদের মাঝে বড় একটি দল আমার উম্মত। আর আমার উম্মতের মধ্যে ৭০ হাজার বিনা হিসেবে, বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।

এই বলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলিস থেকে উঠে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। ছাহাবীগণ রাযিয়াল্লাহু আনহুম বলাবলি শুরু করলেন, ‘কারা হবে এই সৌভাগ্যবান ৭০ হাজার মানুষ?’ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে এসে তাঁদের এমন উদ্বিগ্নতা দেখে বললেন, ‘তাঁরা হলো, যারা কখনো রুকইয়া (ঝাড়ফুঁক) করবে না, পাখি উড়িয়ে ভাগ্য নির্ধারণ করবে না, একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করবে’। মসলিজের মধ্য থেকে উক্কাশাহ ইবনে মিহছান রাযিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমার জন্য একটু দু‘আ করুন না, আল্লাহ যেন আমাকে সেই সৌভাগ্যবানদের একজন করেন’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ দিয়ে বললেন, তুমিতাঁদেরএকজন’।[17]

উপসংহার: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখের প্রতিটি বাক্য ছিল অহীর ছায়ায় ঘেরা। ছাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুম-এর জন্য তাঁর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ শুধু কল্যাণজনকই নয়, বরং সেগুলো তাঁদের উচ্চ মর্যাদার সনদ। নববী দু‘আ পাওয়ার ভাগ্য যাদের হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ঈমান, আনুগত্য, ইবাদতের উজ্জ্বল উদাহরণ। নিজেদের আদর্শ ও নববী দু‘আ সাথে নিয়ে তাঁরা এপার-ওপারে হয়ে উঠেছেন ঝলমলে নক্ষত্র। আমাদের উচিত— জীবনকে তাঁদের মতো করে সাজানো। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু‘আ ও ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা। তাঁর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাহ পালনের মাধ্যমে আত্মাকে ছাহাবীদের মতো পরিশুদ্ধ করে ‘নববী দু‘আ পেয়েছেন যারা’, তাঁদের কাতারে শামিল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে পুষে রাখা।

মাজহারুল ইসলাম আবির

 শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. ইবনে হিব্বান, হা/৭১১১; হাকেম, হা/৬৭৩৮; মাজমাউল যাওয়ায়েদ, ৯/২৪৬, ‘হাসান’।

[2]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৯৭, ‘ছহীহ’।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫৪৬।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৯।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৯১।

[6]. আল-ইছাবাহ ফি তাময়িযিছ ছাহাবা, ১/২৭৭।

[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৪, ৬৩৭৮।

[8]. আর-রাহীকুল মাখতূম (সমকালীন প্রকাশনী), পৃ. ১৫৮। তারিখু উমার ইবনুল খাত্ত্বাব, পৃ. ৭, ১০, ১১।

[9]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৬৯৬; তিরমিযী, হা/৩৬৮১।

[10]. ইবনু আসাকির, তারীখু দেমাশক, পৃ. ৪২।

[11]. সুনান ইবনে মাজাহ, হা/১১৭; আহমাদ, হা/৭৭৮, ‘হাসান’।

[12]. তিরমিযী, হা/৩৭৮২।

[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৩৭১।

[14]. ইবনে রজব, ফাতহুল বারী, ১/৬৫।

[15]. তিরমিযী, হা/৩৭৫১।

[16]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬৪২।

[17]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭০৫।

Magazine