কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

দেশের শিক্ষা ও অর্থনীতিতে এনজিওদের একক দৌরাত্ম্য: ভয়াবহ কিছু্র ইঙ্গিত

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

প্রতিটি দেশের মূল মেরুদণ্ড শিক্ষা ও অর্থ। কোনো দেশের যদি শুধু শিক্ষাব্যবস্থা দখল করা যায় তাহলে সেই দেশ আর বাস্তবে দখল করার প্রয়োজন হয় না। কেননা পরবর্তী প্রজন্ম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে গড়ে ওঠে। অনুরূপই অর্থনৈতিক অবস্থা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার রাস্তা দিয়েই এই অঞ্চলে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মুসলিমদের সমগ্র বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম রাস্তাই ছিল মুসলিমরা জ্ঞানে ও ব্যবসায় সবার চেয়ে সেরা ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আজকের মুসলিম উম্মাহ জ্ঞানে ও ব্যবসায় দুই জায়গাতেই পিছিয়ে আছে।

জুলাই বিপ্লবের পর আমরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলাম। বাংলাদেশ দীর্ঘ ভারতীয় উপনিবেশ থেকে মুক্ত পেয়ে স্বাধীনভাবে নিজের স্বকীয়তা ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। তবে যত দিন যাচ্ছে ততই আমাদের আশা গুড়ে বালি। একদিকে সমগ্র দেশের জনগণ নিজের মতো যখন যেখানে সম্ভব হচ্ছে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। মূর্তি ভাঙা, মাযার ভাঙা, বিভিন্ন দলের কার্যালয় ভাঙা, বিভিন্ন জনের বাড়ি ভাঙা ইত্যাদি কাজগুলোকেই তারা বিরাট সফলতা মনে করে এক প্রকার তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। অথচ দেশের নীতি নির্ধারণে তাদের ন্যূনতম ভূমিকা নেই। অন্যদিকে ইন্টেরিম সরকার মোটামুটি যে কয়টা ইতিবাচক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল সেগুলো প্রত্যেকটাতে বাংলাদেশের তথাকথিত সবচেয়ে বৃহৎ দল ভেটো দিয়ে যাচ্ছে। তারা পূর্বের বিতাড়িত দলের জায়গা পূরণ করে দিচ্ছে তাদের কার্যক্রম দিয়ে। গত ১৬ বছর যে বয়ান দিয়ে বহু অপরাধকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে—‘মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকার’—সেই বিভেদ–রাজনীতি আবারও জিইয়ে রাখা হচ্ছে, যা আসলে ফ্যাসিবাদী কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার। ফলে হুজুগে জনতা ব্যস্ত অকাজে, আর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ব্যস্ত নির্বাচন ও ক্ষমতার ধান্ধায়।

এদিকে এই সুযোগে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের শিক্ষা ও অর্থব্যবস্থা—উভয় খাতে এনজিও–কেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করছে। অথচ এ বিষয়ে বিপ্লবী জনতা, ইসলামী দলগুলো বা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো—কারোই দৃশ্যমান মনোযোগ নেই; সবাই নিজ নিজ স্বার্থে ব্যস্ত।

সরকার নতুন বিধিমালা জারি করেছে (২০২৫) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে Assistant Teacher (Music) এবং Assistant Teacher (Physical Education) নামে দুইটি নতুন পদ যুক্ত করা হয়েছে। তথা মিউজিক বা গানের জন্য এবং শারীরিক শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগ করবে। অথচ মুসলিম সমাজের দীর্ঘ দিনের দাবি অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষার জন্য আলাদা ‘ধর্ম/ইসলাম শিক্ষা’ শিক্ষক-পদ রাখা হয়নি। ধর্মীয় বিষয়টি আগের মতোই সাধারণ (ক্লাস) শিক্ষক দিয়েই পড়ানো হয়। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের সন্তানরা কুরআন সঠিকভাবে শিখার কোনো সুযোগ পচ্ছে না। অথচ তাদেরকে নাচ-গান শিখানো হবে। এমনিতেই প্রাথমিক স্কুলগুলোর বেহাল দশার কারণে অভিভাবকদের আস্থা নেই। দিন দিন ইবতেদায়ী মাদরাসা ও নূরানী মাদরাসায় ছাত্র সংখ্যা বাড়ছে। তার উপর যদি নাচ-গান শিখানো হয় আর কুরআন ও ধর্মীয় শিক্ষার কোনো গুরুত্ব না থাকে তাহলে মুসলিম অভিভাবকদের আস্থা আরও হারিয়ে যাবে।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা শারমিন মুর্শিদ কিছুদিন পূর্বে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা পতিতাদের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। যেখানে রাষ্ট্রের উচিত ছিল পতিতাদের পুনর্বাসনে খরচ করা সেখানে তারা পতিতাদের প্রণোদনা দিচ্ছেন। গর্ভপাত আইন বাতিল, সম্পত্তির সমান অধিকার ইত্যাদি অত্যন্ত ধর্মীয় সেন্সিটিভ ইস্যু নিয়ে কাজ করার বিষয়ে কিছু বামপন্থি ধর্মবিদ্বেষী ঢাবির ছাত্রীদেরকে তিনি আশ্বস্ত করেছেন। পাশাপাশি ট্রান্সজেন্ডারের নামে সমকামিতা প্রমোশনে তিনি নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক খাতও একচেটিয়ে এনজিওদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস বিকাশ শীঘ্রই ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে যাচ্ছে। প্রথম দৃষ্টিতে এটি তেমন কিছু মনে না হলেও বাস্তবে এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর ঝুঁকি। বিকাশ ইতোমধ্যেই দেশের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ৭০ শতাংশের বেশি দখল করে রেখেছে। এর ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ব্র্যাক ব্যাংক, আর ব্র্যাক ব্যাংক নিজেই একটি বিশাল ইকোসিস্টেমের অংশ—যেখানে রয়েছে মাইক্রোফাইন্যান্স, রিটেইল ও কর্পোরেট ব্যাংকিং, হাউজিং ফাইন্যান্স, বীমা এবং এনবিএফআই খাতের শক্ত অবস্থান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিকাশের হাতে ক্রেডিট ব্যুরো লাইসেন্স, যা তাদেরকে গ্রাহকের বিপুল ক্রেডিট তথ্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিয়েছে। এখন যদি ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্সও তাদের হাতে যায়, তবে কার্যত বাংলাদেশে জমা, ঋণ, বীমা, পেমেন্ট থেকে শুরু করে ক্রেডিট ডেটা পর্যন্ত সবকিছু একক কনগ্লোমারেটের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসকে ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এটি সর্বপ্রথম বিকাশকেই দেওয়া হচ্ছে। এই একচেটিয়া অবস্থা প্রতিযোগিতাকে ধ্বংস করবে। বিকাশ তার বিশাল মোবাইলকেন্দ্রিক গ্রাহক ভিত্তি ব্যবহার করে খুচরা ব্যাংকিং, কার্ড ব্যবসা এবং এসএমই খাত দখল করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের অন্যান্য ব্যাংক ও নতুন ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। গ্রাহকের বিকল্প কমে যাবে, ঋণের সূদ বাড়বে, আমানতের মুনাফা কমে যাবে, আর ডেটা গোপনীয়তা থাকবে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে। আরও উদ্বেগজনক হলো, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী একক স্পনসর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার রাখতে পারে এবং কোনো বিদ্যমান ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের স্পনসর হতে পারে না। অথচ ব্র্যাক ব্যাংক বিকাশের অর্ধেকের বেশি মালিক হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। শুধু বিকাশ ও ব্রাককে এই অন্যায্য সুবিধা দেওয়ার জন্য নতুন ডিজিটাল ব্যাংক নির্দেশিকায় এই সীমা শিথিল করা হয়েছে, যা স্পষ্টতই নীতিগত সংঘাত এবং অযৌক্তিক সুবিধা দেওয়ার নজির।

পরিশেষে আমরা বলতে চাই, শিক্ষা ও অর্থ এই দুই ক্ষেত্রেই এনজিও-কেন্দ্রিক একক আধিপত্য গড়ে উঠলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সামাজিক ও সাস্কৃতিক স্বকীয়তা হুমকির মুখে পড়বে। অতএব, এখুনি সময় এই বিষয়ে শক্ত আওয়াজ উঠানোর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া যায় না। এই মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেই বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে ইনশা-আল্লাহ। (প্র. স.)

Magazine