কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বন্যা ২০২৪ ও ভারতের পানি আগ্রাসন

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

বাংলাদেশের প্রধান বন্যাপ্রবণ এলাকা মূলত উত্তরাঞ্চল। নিকট অতীতে কয়েক বছর থেকে পূর্বাঞ্চলে বন্যার ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে। যেমন ২০২২ সালে সিলেটের বন্যা এবং ২০২৪ সালে বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লার বন্যা। পূর্বাঞ্চলের মানুষ এই ধরনের ভয়াবহ বন্যার সাথে অভ্যস্ত না হওয়ায় এই ধরনের বন্যায় তাদের অভিজ্ঞতাও কম। যা তাদের কষ্টের মাত্রাটাও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে উত্তরাঞ্চলে বন্যা কেন বেশি হয় এবং পূর্বাঞ্চলে কেন কম হয়। সিলেট হাওড় অঞ্চল হলেও তা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের অন্য অনেক জেলার চেয়ে সিলেটের মাটি উঁচু। ফলত স্বাভাবিক যে-কোনো পাহাড়ি ঢলের পানি দ্রুত হাওড় হয়ে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে নেমে যায়। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল সমতল হওয়ায় সেখান থেকে পানি যমুনা হয়ে নামতে দেরি হয় এবং নিয়মিত বন্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর বিশেষভাবে এবারের চলমান ভয়াবহ বন্যার কারণ যদি আলোচনা করতে চাই তাহলে মোটাদাগে তিনটি পয়েন্ট উঠে আসবে—

প্রথমত: ত্রিপুরা রাজ্যে ভয়াবহ বন্যা। আমরা জানি উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য মূলত পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে ৩ হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু পাহাড় রয়েছে। ত্রিপুরার সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে বাংলাদেশের সাতটি জেলা— উত্তরে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ, পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা, দক্ষিণে ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং পূর্বে খাগড়াছড়ি জেলা অবস্থিত। ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়গুলো থেকে উৎপন্ন হয়ে বেশ কয়েকটি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ১৫টিই ত্রিপুরা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো— গোমতী, ডাকাতিয়া, মুহুরী ও ফেনী।

ত্রিপুরা রাজ্যের বৃষ্টির পানি এই ১৫টি নদী দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল গতিতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আর ত্রিপুরা রাজ্যে বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় তা ত্রিপুরা রাজ্যসহ এর সংলগ্ন বাংলাদেশের সাতটি জেলায় বন্যা সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় আকস্মিক বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড।

দ্বিতীয়ত: ডম্বুর বাঁধ ‍খুলে দেওয়া। ডুম্বুর লেক সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে গোমতী নদীর মুখে তৈরি করা একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। জলবিদ্যুৎ ড্যাম হচ্ছে নদীর দুই পাড়ের মধ্যে আড়াআড়িভাবে নির্মিত একটি উঁচু দেয়াল বা বাঁধ, যা বর্ষাকালে উজানের পানি জলাধারে আটকে রাখে এবং সেই জমানো পানি টারবাইনের ভেতর দিয়ে ছেড়ে দিয়ে সারা বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার গোমতী নদীটির উৎসমুখ ডুম্বুর লেক থেকে তিন কিলোমিটার ভাটিতে ডুম্বুর ড্যাম নামে একটি জলবিদ্যুৎ তৈরির বাঁধ (ড্যাম) নির্মাণ করে। ডুম্বুর ড্যামের উচ্চতা ৩০ মিটার, বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ১৫ মেগাওয়াট এবং স্পিলওয়ে বা ইমার্জেন্সি গেটের সংখ্যা ৩টি। এবারে ত্রিপুরার ভয়াবহ বন্যায় পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলে ভারত এই বাঁধটি খুলে দেয়। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও সত্য উক্ত বাঁধটি খুলে দেওয়ার বিষয়ে ভারত বাংলাদেশকে কিছুই জানায়নি। আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে উজানের দেশ ড্যামের ইমার্জেন্সি গেট খোলা অথবা ড্যাম ভেঙে গেলে সেই তথ্য অবশ্যই ভাটির দেশকে জানিয়ে দেবে, যাতে ভাটির দেশ বন্যার পূর্বাভাস দিতে পারে এবং বন্যার্ত অঞ্চল থেকে লোকজনকে দ্রুত সরিয়ে নিতে পারে। এবার এর ব্যত্যয় হয়েছে, যার দায় ভারতের; যা সরাসরি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

আর ভারতের এই পানি আগ্রাসন আজ নতুন নয়; বাংলাদেশের উপর ভারতের পানি আগ্রাসনের অন্যতম দুটি নজির হচ্ছে পদ্মা ও তিস্তা। ফারাক্কা ও গজলডোবা। ফারাক্কা বাঁধ সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মৌসুমে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ নিয়ে উভয় পক্ষ যাতে সমঝোতায় আসতে পারে সে উদ্দেশ্যে ভারত প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ফিডার ক্যানেল চালু করে। সে অনুসারে ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। কিন্তু ৪১ দিনের পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার বা তুলে নেওয়া অব্যাহত রাখে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে গঙ্গার পানি হুগলি নদীতে নিয়ে যায়। এর ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ফিডার ক্যানেল চালু করার পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মায় পানিপ্রবাহ যেখানে ছিল ৬৫ হাজার কিউসেক সেখানে ১৯৭৬ সালে তার পরিমাণ নেমে আসে মাত্র ২৩ হাজার ২০০ কিউসেকে। এভাবেই শুরু হয় ভারতের পানি আগ্রাসন। এরপর ভারতকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশের কাছেও দিতে হয়নি কোনো জবাবদিহিতা। ১৯৯৬ সালের ৩০ বছর মেয়াদী পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী কখনোই ভারত বাংলাদেশকে পদ্মার ন্যায্য পানি দেয়নি। বর্তমানে পদ্মার প্রায় ৩০টি শাখা নদী শুকিয়ে গেছে। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে, গঙ্গা ছাড়া বাকি ৫৩টি অভিন্ন নদীগুলোতেও পানি চুক্তি করবে দুই দেশ, কিন্তু ভারতের অসহযোগিতার কারণে গত ২৮ বছরে আর একটি নদীতেও কোনো পানি চুক্তি হয়নি। পানি চুক্তি না থাকায় শুকনো মৌসুমে গজলডোবায় নির্মিত ব্যারাজের মাধ্যমে ভারত তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প পানিশূন্য হয়ে পড়ে এবং তিস্তা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ নদ-নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে। ভারতের পানি আগ্রাসন শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়; ভারত যেমন ইচ্ছামতো পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভূমি বানিয়ে দিচ্ছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে তার অভ্যন্তরে নদীকেন্দ্রিক কোনো প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না। যেমন বাংলাদেশ তার নিজের অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য রাজবাড়ী জেলার পাংশায় গঙ্গা নদীর ওপর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা ও নকশা চূড়ান্ত করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে তার বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অথচ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি আটকে রেখে তা গড়াইসহ আরও কয়েকটি নদী দিয়ে সরবরাহের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা ও মরুকরণ প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখত। ঠিক তেমনি চীনের সহযোগিতায় তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ । উক্ত মহাপ্রকল্পের অধীনে তিস্তার দুই পাড়ের বাঁধ সংরক্ষণ ও নদী খননের মাধ্যমে বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রাখা এবং শুষ্ক মৌসুমে নদীর নাব্যতা রাখার ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শুধু ভারতের বাধায় এখন পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে উঠেনি; বাংলাদেশের যে-কোনো বন্যায় ভারতের এই পানি আগ্রাসনের ব্যাপক ভূমিকা থাকে।

তৃতীয়ত: বাংলাদেশের নদী অব্যবস্থাপনা। কুমিল্লায় বন্যা হলে পানি নামার পথ গোমতী নদী। এই নদী অনেকটাই ভরে গেছে। আর সে কারণেই পানি সরতে অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের দাবি অনুযায়ী ফেনীর সোনাগাজীতে ফেনী নদীর বাঁধের যে রেগুলেটর আছে, সেখানকার ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার ভাটিতে চর পড়ে গেছে। এ ছাড়া ফেনী নদীও বেশ সংকীর্ণ। সাগরে পানি যাওয়ার পথও সংকীর্ণ। পাশাপাশি ফেনী, কুমিল্লার মতো শহরগুলোয় পানিনিষ্কাশনের কার্যকর পথ নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেই এমনটা হয়েছে। এটা শুধু এই দুটি শহরের ক্ষেত্রে নয়, দেশের সব শহরেরই প্রায় একই রকম অবস্থা। নগরীর নর্দমাগুলোতে এমন কোনো বস্তু নেই, যা মানুষ ফেলে না। এতে পানি সরতে আরও বিঘ্ন ঘটে।

উক্ত কারণগুলোর আলোকে আমরা বাংলাদেশের নতুন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের নিকট কিছু প্রস্তাবনা রাখতে চাই— ১. যেহেতু ভারত আমাদেরকে ন্যূনতম বন্যার তথ্য পর্যন্ত প্রদান করেনি সেহেতু এই বন্যার বড় একটা দায় ভারতের। ভারত কি ইচ্ছাকৃতভাবে নতুন সরকারকে বিব্রত অবস্থার মধ্যে ফেলার জন্য এমনটি করেছে কিনা তা জানতে চেয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো উচিত। ২. ভারতের সাথে অতি দ্রুত সময়ে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সকল নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করা। চুক্তি অনুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ভারতকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আওয়াজ উঠাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে হবে। ৩. বাংলাদেশের সকল নদী ও খালগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৪. কঠোর হস্তে নদী ভরাট ও খাল ভরাট রোধ করা ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা। ৪. যেহেতু বাংলাদেশের বেশির ভাগ সমতল অংশে পড়েছে। আর দুই দিকেই ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চল। ফলে উজানে পাহাড়ি ঢল থেকে বন্যার প্রায় ৯০ শতাংশ পানি নেমে আসে। এই বাস্তবতাকে মাথায় নিয়েই আমাদের বন্যা পরিস্থিতিকে দেখতে হবে। ফলত আমাদের নদী নালা-খাল-বিলগুলোকে বন্যার কথা মাথায় রেখেই সাজাতে হবে। বন্যার পানি দ্রুত ও সহজে নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা রেখেই নগরায়ণ ও শহরায়ন করতে হবে। ৫. তিস্তা মহাপরিকল্পনার মতো কিছু মহাপরিকল্পনা পদ্মা ও যমুনার মতো বড় বড় নদীতেও বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে বর্ষার পানি পর্যাপ্ত সংরক্ষণ করে শুস্ক মৌসুমে কাজে লাগানো যায়।

পরিশেষে আমরা বলতে চাই, যে জাতি রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে একতাবদ্ধ হয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে সে জাতি ভারতের যে-কোনো আগ্রাসনকে রুখে দিতে প্রস্তুত। ভারতকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ চরম স্বাধীনচেতা। বাংলাদেশের মানুষকে পরাধীন করার চেষ্টা তাদের অখণ্ডতার জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রদান করত নদীগুলোর পানি সমবণ্টনে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হব এই বন্যা আমাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা অথবা আমাদের কৃতকর্মের শাস্তি উভয়টিই হতে পারে। তাই সবসময় সকল পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। তার কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। তার আদেশ ছাড়া আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করে না। তার আদেশ ছাড়া পানি প্রবাহিত হয় না। আল্লাহ তাআলা নূহ আলাইহিস সালাম-এর ক্বওমকে বন্যা দিয়ে ধ্বংস করেছেন। তাই সদাসর্বদা মহান আল্লাহর গযবের ভয়ে আমাদের তটস্থ থাকা উচিত। গুনাহ ও পাপাচার বন্ধ করে মহান আল্লাহর সাহায্য চাওয়া উচিত। তিনিই আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। আর তিনিই সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান। (প্র. স.)

Magazine