কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

তালেবানের উত্থান: বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তন

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

১৫ আগস্ট দিবাগত রাতটি বিশ্ববাসীর কাছে একটি স্মরণীয় রাত হয়ে থাকবে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির চুপিসারে পলায়ন। তালেবানের কাবুলে প্রবেশ ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল। ১৬ আগস্ট সকালে এক নতুন কাবুল দেখল কাবুলবাসী। গত কয়েকমাসে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা দখল করা শুরু করেছিল তালেবান। পাশাপাশি তাদের সকল শক্তি বিনিয়োগ করেছিল উত্তরাঞ্চল বিজয় করার জন্য। প্রধান প্রধান সকল স্থলবন্দর ও সীমান্ত এবং উত্তরাঞ্চল দখল করে নেওয়ার পর হালকা বিরতি দিয়ে বড় শহরগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে তালেবান। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলছিলেন গ্রামাঞ্চল যত দ্রুত দখল করতে সক্ষম হয়েছে তালেবান তত দ্রুত শহর দখল করতে পারবে না। আরো বলা হচ্ছিল আফগান বাহিনী মূলত তার সকল শক্তি বিনিয়োগ করেছে শহর রক্ষায়। সুতরাং তালেবানের জন্য শহর বিজয় করা অত সহজ হবে না। সকল বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎবাণী উপেক্ষা করে ঝড়ের বেগে একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী দখল করতে শুরু করল তালেবান। এমনকি ২৪ ঘণ্টায় তিনটা প্রাদেশিক রাজধানী দখল করারও রেকর্ড করে ফেলে তারা। উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর মাযার-ই-শরীফ চারিদিক থেকে আবদ্ধ করে ফেললে মাযার-ই-শরীফ সফরে যান আশরাফ গনি। সেখানে আব্দুর রশীদ দোস্তম ও শাহ আহমাদ মাসুদসহ বিভিন্ন উজবেক ও তাজেক মিলিশিয়া গ্রুপের সাথে মিটিং করে মাযার-ই-শরীফকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেন। ঠিক এই সময়েও বলা হচ্ছিল কাবুল দখল করতে ছয় মাস লাগতে পারে তালেবানের। কিন্তু আশরাফ গনির মাযার-ই-শরীফ সফরের মাত্র তিন দিনের মাথায় পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে কাবুলও দখল করে নেয় তালেবান। অথচ আফগান সেনাবাহিনী ও সরকারের পিছনে গত বিশ বছর ধরে কত জান ও মাল খরচ করেছে আমেরিকা, ন্যাটো ও ভারত তার ইয়ত্তা নেই। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারত আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নায়নে ৩০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করেছে। ২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে আফগানিস্তানে ন্যাটো জোট পরিচালিত যুদ্ধে ২,৪২,০৬২ জন মানুষের মৃত্য হয়, যার মধ্যে ৭৮ হাজার ৩১৪ জন বেসামরিক লোক। এই যুদ্ধে আমেরিকা ৮৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করে।(প্রথমআলো, ১৪ জুলাই,২১) আমেরিকা ও ভারতের উল্লিখিত কোটি কোটি ডলার ব্যয় নিমিষেই তুরুপের তাসের মতো ভেঙ্গে পড়ে। চারজন প্রেসিডেন্ট বুশ, ওবামা, ট্রাম্প ও বাইডেন মোট বিশ বছর যাবৎ কোটি কোটি টাকা খরচ করে হাজারো সেনা ও সাধারণ আফগান জনগণের প্রাণহানি করে যে তালেবানদের সরাতে চেয়েছিল আমেরিকার পূর্ণ দেশ ত্যাগের পূর্বেই সেই তালেবান তাদের চোখের সামনে তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষিত কোটি টাকা বিনিয়োগকৃত সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিল।যারা আফগানিস্তানের ভূ-রাজনীতি বুঝেন তারা জানেন, আমেরিকার সাথে চুক্তি হলেও আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল এত সহজ ছিল না। যেখানে পূর্ব থেকে চলে আসা পশতুনদের সাথে উজবেক, তাজিক ও হাজারাদের রেষারেষি রয়েছে। যাদের কারণে প্রথম শাসনামলে তালেবান উত্তরাঞ্চলে তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পারেনি। জাতিগত এই বিদ্বেষের সাথে রয়েছে প্রশিক্ষিত আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশ। সেক্ষেত্রে তালেবানেরা তাদের বিজয়াভিযান উত্তরাঞ্চল থেকেই শুরু করেছে, যা ছিল সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত কৌশলগত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। উত্তরাঞ্চলে সফলতা তাদের পথকে সুগম করে দেয়। তবে কয়েকটি মৌলিক কারণে তারা এই ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ মুকাবেলা করতে সক্ষম হয়।

প্রথমত, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। তারা সব সময়ই সকলকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, আত্মসমর্পণ করলে কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষমতা দখলের পর যেভাবে তালেবানরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সরকারি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছে এবং কাজে যোগ দেওয়ার আহব্বান করেছে তা সত্যিই প্রশংসিত।

দ্বিতীয়ত, দ্রুত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত সফলতা। তালেবানদের অতীতেও এই মর্মে সুনাম ছিল যে, তারা কোনো এলাকা দখল করলে সেখানে জান-মালের নিরাপত্তা, চুরি-ডাকাতি ও লুট-তরাজ বন্ধ হয়ে যায়। তাই গৃহযুদ্ধের চেয়ে এবং অন্য কারো কাছে আত্মসমর্পণের চেয়ে তালেবানের কাছেই আত্মসমর্পণকে নিজের এবং পরিবারের জন্য বেশি নিরাপদ ও কল্যাণকর মনে করেছে আফগানেরা। এই জন্য আমরাও দেখেছি পুরো অফগানিস্তানের এই বিশাল সীমানা দখল করার পরেও কোথাও কোনো ব্যাংক ডাকাতি বা নিরাপত্তার ঘাটতি দেখা যায়নি। যা নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় তাদের সক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।

তৃতীয়ত, যেহেতু আফগানরা জন্মগতভাবে গোত্রীয় সিস্টেমের মধ্যে বেড়ে উঠে। সেই জায়গায় আফগান সরকারি বাহিনী ছিল সকল গোত্রের মিশ্রণ। নির্দিষ্ট কোনো গোত্রকেন্দ্রিক নয়। ফলত আফগানদের জন্মগত ও রক্তগত বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা এই রকম পরিস্থিতিতে গোত্রীয় বন্ধনহীন এমন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের জন্য ঢাল মনে করাকে নিরাপদ মনে করেনি। ফলত তাদের মধ্যে তালেবানদের সামনে আত্মসমর্পণ করার হিড়িক পড়ে যায়।

চতুর্থত, কূটনৈতিক সফলতা। মাঠের যুদ্ধের সমান্তরালে যেভাবে কাতার থেকে আলাদা চৌকস রাজনৈতিক টিম বিভিন্ন দেশের সাথে মিটিং দিয়েছে তা তালেবানের বিজয়কে তরান্বিত করেছে। মাঠের দ্রুত অগ্রগতি চলমান সরকারের উপর প্রেসার বাড়িয়েছে বাহিরের কূটনৈতিক সফলতা আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির গ্রাউন্ড ফ্লোর প্রস্তুত করেছে।

এখন তালেবানের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তারা তাদের আল-ইমারাহ আল-ইসলামিয়্যাহ-এর আদর্শ ও চিন্তাধারার সাথে গত বিশ বছরে সামাজিক ও সংস্কৃতিকভাবে পরিবর্তিত আফগানিস্তানের কীভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলবে? দেশ পরিচালনার জন্য কী ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো তারা নির্ধারণ করবে? আর্ন্তজাতিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ কীভাবে মুকাবেলা করবে? দেশের উন্নতি, জনগণের রোজগার ইত্যাদি ক্ষেত্রে কীভাবে অতীতের সরকারের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা করবে? বিভিন্ন জাতি-গোত্র ও মাযহাবে বিভিক্ত একটি দেশের সকল মানুষকে কীভাবে মৌলিক অধিকার দিয়ে নিজেদের কাঠামোর মধ্যে রাখবে? প্রায় চল্লিশ বছরের পোড় খাওয়া এই দলের নেতারা হয়তো তাদের পরিপক্কতা, বুদ্ধিমত্তা ও হিকমা দিয়ে সবকিছু মোকাবেলা করতে সক্ষম হতেও পারেন। ঠিক যেভাবে কম ক্ষয়-ক্ষতি ও কম রক্তপাতে ক্ষমতা দখলের চ্যালেঞ্জ তারা মুকাবেলা করছে।

আমাদের চাওয়া ও দুআ হচ্ছে মহান আল্লাহ আফগানিস্তানের মুসলমানদের শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন! যুদ্ধ-বিগ্রহে বিধ্বস্ত এই দেশকে আর যেন যুদ্ধ দেখতে না হয়। আমীন!

Magazine