কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীন বাংলাদেশ

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

কোটা সংস্কারের এক ন্যায্য দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তীতে শাসকশ্রেণির হঠকারিতায় সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। এই কোটা সংস্কারের জন্য ছাত্ররা ২০১৮ সালেও আন্দোলন করেছিল। তখন স্বয়ং শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার না করে কোটা বাতিল করে দেন। ২০২৪ সালে কৌশলে সেই কোটা বাতিলের পরিপত্র হাইকোর্টে বাতিল করা হয়। এই নাটকীয়তার ফলে ছাত্রসমাজ নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। শেখ হাসিনা ছাত্রদেরকে রাজাকার হিসেবে তাচ্ছিল্য করেন। যা আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ করে। ছাত্ররা ‘আমি কে, তুমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। এই ঐতিহাসিক স্লোগান দিতে দিতে রাতের অন্ধকারে ঢাবির সকল হলের তালা ভেঙে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। এই এক স্লোগান সমগ্র দেশে আন্দোলনের চিত্রই সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়। সরকার নিরুপায় হয়ে তার হানাদার লীগের হেলমেট বাহিনীকে নামিয়ে দেয়। হানাদার লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে ছাত্রীদের উপর হামলা চালায়। ছাত্রীদের উপর চালানো এই নৃশংস হামলায় পুরো দেশের ছাত্রসমাজ কেঁপে ওঠে। পাবলিকের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও নেমে আসে। সরকার উপায়ন্তর না দেখে পুলিশ বাহিনীকে সরাসরি গুলি চালানোর আদেশ দেয়। বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই প্রায় ৫০ জন ছাত্র সারা দেশে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। পুরো দেশ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ফুঁসে ওঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এমনকি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্রডব্যান্ড ওয়াইফাই লাইনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরদিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) লাখো জনতা ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। এক ভয়ংকর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই গণঅভ্যুত্থান দমনে সরকার বিজিবি র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীকে হিংস্র হায়েনার মতো নিরস্ত্র জনগণের উপর ছেড়ে দেয়। হেলিকপ্টার, স্নাইপার সকল মাধ্যম ব্যবহার করে শত শত নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা করা হয়। পুরো দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। পাঁচ দিন পর ইন্টারনেটে ফেরত আসলে হত্যার বিভিন্ন ভয়ংকর ফুটেজ বের হয়ে আসতে থাকে। একেকটি ফুটেজ পুরো দেশের মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। পুরো দেশের মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। সবার দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা তৈরি হয়। কেউ রাতে ভালো মতো ঘুমাতে পারে না। এই অবস্থায় সমন্বয়কদের ডিবি উঠিয়ে নিয়ে গেলে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়। সরকার সমগ্র দেশে ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। সরকারের এই নিপীড়নে কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে ঘরে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। প্রথমত, শিক্ষকগণ প্রতিবাদ জানানো শুরু করেন। তারপর ধীরে ধীরে শিল্পীসমাজ, মধ্যবিত্ত এমনকি গুলশান-ধানমন্ডির উচ্চবিত্ত পরিবারেরাও রাজপথে নেমে আসে। মিরপুর ও মহাখালী ডিওএইচএসের সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারেরাও রাজপথে নেমে আসে। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহত-নিহত ছাত্র দেখতে না গিয়ে মেট্ররেল দেখতে গিয়ে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেন। যা তার হিংস্র চোহারা জনগণের সামনে স্পষ্ট করে দেয়। এভাবেই সরকার পতনের মাহেন্দ্রক্ষণের সূচনা হয়। শহীদ মিনারের বিশাল ছাত্রজনতার সমাবেশ থেকে এক দফার ঘোষণা দেওয়া হয়। গণভবন ঘেরাও এর ডাক আসে। সেনাবাহিনী জনগণের বুকের উপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। সেনাবাহিনী অস্বীকৃতি জানালে পুলিশও জানায় তাদের পক্ষে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। এভাবে ৫ আগস্ট লাখো জনতার পদচারণায় দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সমগ্র দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস গ্রহণ করে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরবর্তী বিক্ষোভ ও সরকারের পতনের পর সব মিলিয়ে সহিংসতায় ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৫৮০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪৪০ জন নিহতের খবর পাওয়া গিয়েছিল।

এই সরকারে দীর্ঘ শাসনামলে পিলখানায় অর্ধ শতাধিক সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়। অগণিত অসংখ্য মানুষকে গুম করে রাখা হয় আয়না ঘরে। হাজারো মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। বহু আলেমকে জেলখানায় আবদ্ধ করে রাখা হয়। কাউকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আবার কাউকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ভারতের দখলে চলে যায়। ভারত ট্রানজিট ও করিডোর পেয়ে যায় এক প্রকার বিনা শুল্কে। কিন্তু বাংলাদেশের খাতায় শূন্য। বাংলাদেশের তিস্তা ও পদ্মা পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হয়। ন্যায্য হিস্যা পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখে কয়েকশ নদীকে হত্যা করা হয়। সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশীদেরকে হত্যা করা হয়। উন্নয়নের নামে অর্থ পাচার ও ব্যাপক লুটপাট হয়। স্বয়ং শেখ হাসিনার মুখের ভাষা অনুযায়ী তার পিয়নই প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। দেশের রিজার্ভ কমে আসে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। গত ১৫ বছর কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। বরং প্রতিষ্ঠিত বহু ব্যবসাকে ধ্বংস করা হয়েছে।

দীর্ঘ এই ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। আমরা উক্ত সরকারের কাছে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনাগুলো পেশ করছি।

১. অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু করতে হবে।

২. প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা চালু করতে হবে।

৩. সংসদের উচ্চকক্ষে দেশের শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ স্থান পাবেন। তারাই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্ধারণ করে দিবেন। জনগণের তাদের মধ্যে যে-কোনো একজনকে বেছে নিবেন।

৪. প্রেসিডেন্ট নির্ধারণ হওয়ার পর তিনি নিজ পরিষদ নিজের মতো বাছাই করবেন।

৫. সংবিধানে শরীআত-বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না মর্মে একটি ধারা রাখতে হবে।

৬. মুসলিম পারিবারিক আইনসহ যেসমস্ত আইন সরাসরি শারঈ বিধান অনুযায়ী পরিচালনা সম্ভব হবে তার জন্য শারঈ কোর্ট চালু করতে হবে। যেখানে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদেরকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।

৭. সূদবিহীন ইসলামী অর্থনীতি চালু করতে হবে।

৮. জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করত বাংলাদেশী পরিচয়ে উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমের কোনো কবিতাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।

৯. ভারতের সাথে সকল দাসত্বের চুক্তি ছিন্ন করতে হবে। সমতার ভিত্তিতে চুক্তিগুলোকে নবায়ন করতে হবে।

১০. তিস্তা ও পদ্মাসহ যৌথ নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা ভারতের থেকে আদায় করে নিতে হবে। নদীগুলোকে ড্রেজিংসহ বাধ সংস্কারের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

১১. প্রাদেশিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যাতে ক্ষমতার এককেন্দ্রিকরণ সম্ভব না হয়।

১২. রাজধানী বিকেন্দ্রীকরণ করত রাজধানীর উপর চাপ কমাতে হবে।

১৩. বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিতে হবে।

১৪. পুলিশবাহিনীকে সংস্কার করত জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশকে যেন কেউ রাজনৈতিক স্বার্থ ব্যবহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে এই জন্য পুলিশকে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

১৫. বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।

১৬. শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তক নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। কর্মমুখী জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

১৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

১৮. জনগণের অর্থের অপচয় করে মূর্তি ও ভাস্কর্য বানানো নিষিদ্ধ করতে হবে।

১৯. কৃষিখাতে ব্যাপক ভরতুকি প্রদান করত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ গড়ে তুলতে হবে।

২০. স্বাস্থ্য খাত ও ব্যবসায়িক খাতে উন্নত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যাতে করে দেশে ব্যবসায় বিনিয়োগ করার জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশ নির্ভরতা কমানো যায়।

আমরা আশা করি উক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে যেমন রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসবে ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানবাধিকার নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ। আমরা সকলে মিলে একটি শান্তিপূর্ণ উন্নত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব ইনশাআল্লাহ।

Magazine