কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

এ আলো যেন আর না নিভে

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

‘সুশিক্ষাই আলো’; ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। দীর্ঘদিন ধরে যে আলো নিভে গিয়ে বা নিষ্প্রভ হয়ে জাতি গহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে জাতিরও মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর ৮ মার্চ থেকে বাংলাদেশেও এর বিস্তৃতি শুরু হয়। এর জের ধরে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বন্ধ থাকে দীর্ঘ ১৮টি মাস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, সেসবের মধ্যে বাংলাদেশ রানার-আপ! এ তালিকায় শীর্ষে থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে উত্তর আমেরিকার দেশ পানামা! যাহোক, অবশেষে করোনাভাইরাস মহামারিতে ৫৪৩ দিন বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে সীমিত পরিসরে খোলা হয় এবং জ্বলতে শুরু করে শিক্ষার আলো।

এ দেড় বছরে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত দেশে চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এ লম্বা সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। যেমন- (১) অটোপাশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভিত্তি দুর্বল হয়েছে এবং জ্ঞানের বড় ঘাটতি নিয়ে উপরের ক্লাসে উঠেছে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে বিনা পরিশ্রমে পাশের মানসিকতাও তৈরি হয়েছে। জ্ঞানের এ ঘাটতি কাটিয়ে না উঠতে পারলে এর বিরূপ প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হবে। (২) বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় সেশনজটের সৃষ্টি হয়েছে। (৩) কিন্ডারগার্টেন, প্রি-প্রাইমারি, প্রি-ক্যাডেট, প্রিপারেটরিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। (৪) শিক্ষার সকল স্তর থেকে বহু শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। (৫) শিশুশ্রম বেড়েছে। (৬) অনলাইন লার্নিং প্রোগ্রামগুলোর কারণে ধনী-গরীব এবং শহরের ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। কেননা বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে গরীব ও গ্রামের শিক্ষার্থীরা এসব ক্লাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। (৭) অনেক শিক্ষার্থী নানা অন্যায়-অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। (৮) মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদিতে আসক্ত হয়েছে অনেক শিক্ষার্থীই। (৯) শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। (১০) শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।

শিক্ষার এসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেই হবে। আর সেজন্য অন্তত ২/৩ বছরের জন্য মহাকর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে; অন্যথা ক্ষতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হবে। শিক্ষার এ অপূরণীয় ক্ষতি কাটিয়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা বলতে চাই— (১) শ্রেণিকক্ষে ফেরার বিকল্প নেই। যে কোনো মূল্যে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। (২) ক্লাসে ফিরতে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচ্ছন্ন করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি এর সব উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করতে হবে। (৩) শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরার সাথে সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন করে কারোনাকালীন ক্ষতি চিহ্নিত করতে হবে এবং তদনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। (৪) ভবিষ্যতের সতর্কতাস্বরূপ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি ডিজিটাল লার্নিং-এর ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে— যাতে শিক্ষার্থীরা এ পদ্ধতির সাথেও পরিচিত থাকে এবং যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লেখাপড়ার দুয়ার উন্মুক্ত রাখা সহজ হয়। (৫) শিক্ষকমণ্ডলীর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা করোনাকালীন ক্ষতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুষিয়ে নিতে পারেন। (৬) ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের খোজ খবর নিতে হবে এবং ক্লাসে তাদের অনুপস্থিতি কমাতে প্রয়োজনে উপবৃত্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। (৭) শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা বছরের ছুটিগুলো কমিয়ে বা দিনের শেষে অতিরিক্ত সময় যোগ করে অথবা বন্ধ বা ফাঁকা ঘণ্টায় অতিরিক্ত ক্লাস দিয়ে হতে পারে। (৮) যাদের অটোপাশ দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে পূর্বের ক্লাসের মূল বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তাকারে পড়িয়ে নিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন করা যেতে পারে— যাতে তাদের ভিত্তি দুর্বল না থেকে যায়। (৯) শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ কমিয়ে আনা যেতে পারে। প্রতি শিক্ষাবর্ষ থেকে তিন মাস মতো কমালে ৩/৪ বছরে শিক্ষার এ ক্ষতি পোষানো সম্ভব হতে পারে। অনুরূপভাবে উচ্চশিক্ষার প্রতি ৪ মাসের সেমিস্টার থেকে ১ মাস করে বিয়োগ করলে এক বছরেই আরেকটি অতিরিক্ত সেমিস্টার শেষ করা সম্ভব হতে পারে। (১০) শর্ট সিলেবাস তৈরী করা যেতে পারে। যাতে করে ছাত্রদের উপর বছর শেষ করতে চাপ তৈরী না হয়। (১১) যে সমস্ত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলোকে পুণরায় চালু করার জন্য বিনা সুদে কর্য হাসানা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। (১২) এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং তার যথার্থ ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া যেমন দরকার হবে, তেমনি প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ক্রয় করারও প্রয়োজন পড়বে।

আমরা মহান আল্লাহর নিকট দুয়া করি, তিনি যেন আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় ভালো কাজ ঠিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটি সুশিক্ষিত জাতি গঠনে ভূমিকা রাখার তাওফীক্ব দান করেন- আমীন!

Magazine