সুবহানাল্লাহ! কাঁচা মরিচের এত ঝাঁঝ! প্রচণ্ড ঝালে চোখের পানিতে ভেসেছে গোটা দেশ। অবিশ্বাস্যভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কেজি প্রতি ১২শ’ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে কাঁচা মরিচের দাম! ভাবা যায়! এ যেন রূপকথার গল্প!
এটি তো একটি উদাহরণমাত্র। এর আগে আমরা পেঁয়াজের ঝাঁঝেও চোখের পানিতে ভেসেছি। এভাবে দাম বাড়ে কখনও তেলের, কখনও চিনির, কখনও আলু, পটল, মাছ-মাংস ইত্যাদির। এমনি করে মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য চলছে সর্বত্রই। সবকিছু চলে যাচ্ছে সিন্ডেকেটের কবজায়। সিন্ডিকেটচক্রের দৌরাত্ম্য কেবল নিত্যপণ্যেই নয়, বরং পরিবহন, ব্যাংক-বীমা, গ্যাস-বিদ্যুৎ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, ঠিকাদারিসহ প্রায় সব সেক্টরেই বিস্তৃত। এমনকি জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসাসেবাও তাদের নিয়ন্ত্রণে। মধ্যস্বত্বভোগী এই চক্রটি যখন-তখন, যেভাবে খুশি পণ্যের দাম বৃদ্ধি করছে এবং ভোক্তাকে জিম্মি করে বেআইনিভাবে নিজেদের পকেট ভারী করছে। ফলে উৎপাদনকারীগণ ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, বরং অনেক সময় তাদেরকে লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। এদিকে ভোক্তাগণ চড়া মূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। সিন্ডিকেট শব্দটি সবসময় নেতিবাচক না হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে শব্দটি এখন দেশের সাধারণ জনগণের কাছে নেতিবাচক ও আতঙ্কের শব্দে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে উৎপাদনকারী ও ভোক্তাদের ঠকানোর যাবতীয় আয়োজন করা হয়৷
সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত দেশের রাঘববোয়ালেরা। ব্যবসায়ীদের উঁচু পর্যায়ের সিন্ডিকেটবাজদের অর্থ ও ক্ষমতার জোর এতই বেশি যে, তাদের কাছে সরকারকেও জিম্মি থাকতে হয় ৷ এর একটি মূল কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের টাকা কিংবা পৃষ্ঠপোষকতায় চলে। আর ব্যবসায়ীরা এখন সরাসরি রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছেন৷ স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সাড়ে ১৭ ভাগ ছিলেন ব্যবসায়ী৷ ১৯৯১ সালে যা বেড়ে ৩৮ ভাগে দাঁড়ায়৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই পেশায় ব্যবসায়ী, যা মোট সংসদ সদস্যের ৬২ ভাগ৷ বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে আছেন ব্যবসায়ীরা৷ তারাই আইন প্রণয়ন করছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করছেন, সরকার চালাচ্ছেন৷ ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের কাছে ব্যবসা আর মুনাফাই প্রাধান্য পাওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার জোরে এসব রাঘববোয়ালেরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান।
যে কোনো অবৈধ উপায়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না’ (আন-নিসা, ৪/২৯)। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের মাল হাতিয়ে নেয়, আল্লাহ তাআলা তার উপর ক্রোধান্বিত অবস্থায় সে তার সাথে সাক্ষাৎ করবে’ (আহমাদ, হা/৩৯৪৬)। হারাম খেলে বা পরলে ব্যক্তির ইবাদত কবুল হয় না (মুসলিম, হা/১০১৫)। মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সিন্ডিকেট করা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পাপিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ মওজুদদারি করতে পারে না’ (মুসলিম, হা/১৬০৫)। যে কোনো ধরনের যুলম ক্বিয়ামতের ময়দানে অন্ধকারের কারণ হবে (বুখারী, হা/২৪৪৭)। বরং অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ের হিসাব না দেওয়া পর্যন্ত ক্বিয়ামতের দিন ব্যক্তির পাদ্বয় আল্লাহর সামনে থেকে এক ধাপও সরতে পারবে না (তিরমিযী, হা/২৪১৬)।
আমরা মনে করি, দ্বীনদার, আমানতদার, পরহেযগার ও পরকালমুখী ব্যক্তি ছাড়া এসব দুর্নীতি কখনই বন্ধ করা যাবে না। সেজন্য এসব বৈশিষ্ট্যের মানুষ তৈরিতে কাজ করতে হবে। ধর্মমুখী সিলেবাস প্রণয়ন করে শেকড় থেকে সেই শিক্ষা দিতে হবে। দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সাবধান করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে এবং নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কড়া নজরদারি থাকতে হবে। খুচরা ও পাইকারি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শুধু নয়; বরং বড় আমদানিকারক, শিল্প গ্রুপ, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রকশ্রেণির বিরুদ্ধে আগে অভিযান চালাতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের অধীনস্থ টিমগুলোকে বাজার তদারকিতে মাঠে থাকতে হবে। দেশে সিন্ডিকেট ও মওজুদের বিরুদ্ধে যে আইন আছে, কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিসহ সার্বিক সমৃদ্ধি দান করুন। আমীন!