اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
গণতন্ত্রকে আধুনিক বিশ্বে এমন এক অপরিহার্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে মনে করা হয় সকল সমস্যার সমাধান গণতন্ত্রেই নিহিত। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও যদি সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে বলা হয়, এর কারণ গণতন্ত্রের পর্যাপ্ত চর্চার অভাব। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের সমাধান আরও বেশি গণতন্ত্র!
কিন্তু বাস্তবতা হলো, গণতন্ত্র নিজেই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা। এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ ও অকার্যকর শাসনব্যবস্থা, যা প্রকৃত অর্থে জনগণের নয়, বরং ক্ষমতাসীন অভিজাতদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। গণতন্ত্রের ব্যর্থতার কিছু প্রধান কারণ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: গণতন্ত্র নামেই জনগণের শাসন, কিন্তু বাস্তবে এটি আমলাতন্ত্রনির্ভর একটি ব্যবস্থা। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও প্রশাসনিক আমলাদের ক্ষমতার কাছে অনেক সময় যিম্মী হয়ে পড়েন। ফলে সাধারণ জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয় এবং তাদের অধিকার আদায়ের প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়।
২. রাজনৈতিক দলের একচেটিয়া আধিপত্য: গণতন্ত্র জনগণের শাসন নয়, বরং প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের শাসন। জনগণের হাতে সরাসরি প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা থাকে না; বরং রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো প্রার্থী মনোনয়ন দেয় এবং জনগণকে বাধ্য করা হয় সেই সীমিত বিকল্পের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নিতে।
৩. কর্পোরেট ও এলিট শ্রেণির প্রভাব: গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। ফলস্বরূপ, রাজনৈতিক দলগুলো কর্পোরেট ও অভিজাত শ্রেণির অর্থানুকূল্যে পরিচালিত হয়। বিশ্বের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এটি স্পষ্ট—যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ইলন মাস্কের প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। দিনশেষে, ক্ষমতা কেবল হাতে গোনা কয়েকজন পুঁজিবাদী অভিজাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
৪. সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার: গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে সকল জনগণের শাসন নয়, বরং এটি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এখানে সংখ্যালঘুর মতামতের আইনি কোনো মূল্য থাকে না। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্যের মানদণ্ড হতে পারে না, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত সব সময় ন্যায়সংগত বা নীতিগতভাবে সঠিক হবে—এমন নিশ্চয়তা নেই।
৫. গণতন্ত্র একটি আধুনিক ধর্ম: পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রশ্ন করা এক ধরনের ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র একপ্রকার সেক্যুলার ধর্মে রূপ নিয়েছে, যেখানে নির্বাচন হলো সেই ধর্মের পূজার আচার। অথচ প্রকৃত স্বাধীনতা হলো এই গণতান্ত্রিক মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা। গণতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে ৫১% জনগোষ্ঠী মিলে বাকি ৪৯% জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে পারে। ভোট প্রদান প্রক্রিয়া হচ্ছে স্বাধীনতা হরণের বিনিময়ে প্রাপ্ত ক্ষমতার ভ্রান্ত বিলাস। অর্থাৎ ভোট প্রদানের তাৎক্ষণিক আনন্দের বিনিময়ে ৫ বছরের জন্য দুর্নীতি, লুটপাট, খুন-গুম ও যুলমের সুযোগ। গত ১৬ বছর বাংলাদেশে ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠিত ছিল গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের নামেই। তথা গত ১৬ বছরের সকল খুন-গুমের জন্য কোনো ব্যক্তিকে দায়ী না করে সরাসরি গণতান্ত্রিক সিস্টেমকে দায়ী করা প্রকৃত স্বাধীনতা।
প্রকৃত গণতন্ত্র কেমন হতে পারে?
গণতন্ত্রকে যদি প্রকৃত অর্থেই গণতন্ত্র হতে হয় তাহলে গ্রামের মানুষজনকে স্বাধীনতা দিতে হবে। তারা কোনো প্রকার রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ছাড়া এবং রাজনৈতিক দল ছাড়াই নিজেরা গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে তাদের মধ্যে যোগ্য একজনকে সর্বসম্মতিক্রমে তাদের নেতা ঘোষণা করবে। অতঃপর একটি ইউনিয়নের সকল গ্রামের নেতারা মিলে তাদের মধ্যের ইউনিয়ন নেতা নির্ধারণ করবে। তারপর সকল ইউনিয়ন নেতা মিলে তাদের মধ্যে উপজেলা নেতা নির্ধারণ করবে। তারপর সকল উপজেলা নেতা মিলে তাদের এমপি নির্ধারণ করবে। এইভাবে পরামর্শভিত্তিক ধারাবাহিক পদ্ধতিতে পুরো দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত হবে। এটিই প্রকৃত গণতন্ত্র।
পরিশেষে, যেখানে গণতন্ত্র নিজেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ, সেখানে গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আশা কেবল দিবাস্বপ্ন। গণতন্ত্র একটি অকার্যকর ব্যবস্থা, যা কৃত্রিমভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু একদিন অবশ্যই এই গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়বে এবং সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী খেলাফত— যেখানে সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। (প্র. স.)