কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

ভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

মানুষ আল্লাহ তাআলার অসীম নেয়ামতের মধ্যে ডুবে আছে। তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, নির্মল স্বচ্ছ পরিবেশ, অক্সিজেন, অর্থসম্পদ, বসতবাড়ি, যানবাহন, স্ত্রী, সন্তানসন্ততি সবই আল্লাহ তাআলার নেয়ামত। আবেগ, অনুভূতি ও মনের ইচ্ছা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম বাকশক্তি। আল্লাহ মানুষকে বাকশক্তি তথা ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে বর্ণনা শিখিয়েছেন’ (আর-রহমান, ৫৫/৩-৪)। ভাষা আল্লাহ তাআলার এক অমূল্য নেয়ামত। কিন্তু আমরা কত অকৃতজ্ঞ! এত নেয়ামত ভোগ করেও আমরা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না!

মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার যেমন সম্মান আছে, আল-কুরআনের ভাষা হিসেবে তেমনি আরবীরও বিশেষ অবস্থান আছে। ভাষা শহীদদের সম্মানে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল প্রদান, শোভাযাত্রা করা, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিশেষ অনুষ্ঠান বা ক্রোড়পত্র প্রকাশ ইত্যাদি করা হয়। এর মাধ্যমে ভাষার প্রতি দায়িত্ব পালিত হয় না। কেননা ১৫০০ বছর পূর্বে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে ভাষার মূল্যায়ন করেননি। 

বর্তমানে আমাদের তরুণ শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলার পরিবর্তে বাংলিশ তথা বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। একটি বক্যের কিছু অংশে বাংলা শব্দ আর কিছু অংশে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে তারা। ভাষার এমন ব্যবহার ভাষা অবমাননার শামিল। এতে ব্যক্তির হীনম্মন্যতা ও সংকীর্ণতা প্রকাশ পায়। মাতৃভাষাকে চর্চা করতে হবে গর্বের সাথে। নিজের ভাষা উচ্চারণে যদি কেউ সংকোচবোধ করে, তবে বুঝতে হবে ভাষার প্রতি তার ভালোবাসার অভাব আছে এবং ভাষাদিবসে তার অংশগ্রহণ লোক দেখানো। এমনভাবে ভাষাদিবসের উদযাপন মোটেও কাম্য হতে পারে না।

আরব্য কিংবা পশ্চিমারা নিজ ভাষার শব্দ ব্যতীত অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করে না। তারা যে অন্য ভাষা জানে না তা নয়; কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার নিদর্শন এটি। আরবরা কম্পিউটারের পরিবর্তে ‘হাসুব’ আর রেডিওর পরিবর্তে ‘ইযাআ’ শব্দের ব্যবহার করে; অথচ আমরা ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করি। তারা আমাদের মতো মাতৃভাষার জন্য কোনো দিবস পালন করে না; কিন্তু মাতৃভাষায় কথা বলতে হীনম্মন্যতায় ভোগে না। জার্মানি, চাইনিজ, জাপানি ও ইংরেজদের অবস্থাও এমনই।

বর্তমানে আমাদের সমাজে অনেক সম্পদশালী ও জ্ঞানী মানুষ আছে, যারা বিদেশী ভাষা জানে তবুও সে ভাষায় কথা বলে না। আর আমাদের দেশের এক শ্রেণির তরুণ দুই লইন ইংরেজি শিখেই ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে প্রকাশ করতে তারা এমনটি করে থাকে। এ ধরনের আচরণ ভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। আমাদের দেশের উলামায়ে কেরাম সাধারণ মানুষকে কুরআন ও হাদীছ শিখানোর আরবী ভাষা শেখে থাকেন। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া তারা আরবী বলেন না। ভাষার জন্য শহীদদের জীবন উৎসর্গ তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা বাংলা ভাষার যথাযথ চর্চা করব।

আল্লাহর নেয়ামতের অপব্যবহারে তাঁর প্রতি অবজ্ঞা আর সদ্ব্যবহারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। ভাষা আল্লাহর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত। মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। দৈনন্দিন জীবনের সকল কার্যাবলি সম্পাদনে ভাষা ব্যবহার করা হয়। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আল্লাহর ইবাদত, তাঁর প্রশংসা ইত্যাদি ভালো কাজে আমরা এর ব্যবহার করি না। মানুষকে কষ্ট দেওয়া, মিথ্যা কথা, অন্যায় কাজ ও গাল-মন্দ করা ইত্যাদিতে আমরা ভাষার ব্যবহার করি। আল্লাহর রাসূল রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ (জিহ্বা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ (লজ্জাস্থান) সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দিব’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৭৪মিশকাতহা/৪৮১২)। 

ভাষা আল্লাহ তাআলার মহিমান্বিত গ্রন্থের সর্বশ্রেষ্ঠ অলৌকিক ঘটনা। বিশ্ববাসীর নিকট ইসলাম প্রচারে আরবরা কুরআনের আরবী ভাষাকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে। পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার বহু মানুষ ইসলামের প্রভাবে আরবী ভাষাভাষী হয়ে ওঠে। ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসাই তাদের আরবী ভাষাভাষী করেছে। ইসলামের পাশাপাশি কুরআনের ভাষা আরবীকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তারা তাদের মাতৃভাষা এবং পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে (আল-লুগা আরাবিয়া ওয়া মাকানাতুহা বায়নাল লুগাত, ১/২)

দীর্ঘকাল ধরে আরবী ভাষাই ছিল পৃথিবীর প্রথম সভ্য ভাষা। আরবী ভাষা হলো প্রাচীনতম ভাষা যা এখনও শব্দ, গঠন, রূপতত্ত্ব, ব্যাকরণ, সাহিত্য এবং রূপক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন। আরবী অভিধানের সম্পূর্ণতা এবং রূপতত্ত্ব ও ব্যাকরণের পরিপূর্ণতার বিচারে একে আরব উপদ্বীপে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষাগুচ্ছের জননী বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে পরিচিতি ভাষা আরবী। উৎস, সুবিধা এবং বৈশিষ্ট্যের বিচারে এটি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী (আবকারিয়্যাতুল লুগা ওয়াল আরাবিয়া, পৃ. ৭-৮)

আরব জাতি একটি বক্তব্যপ্রবণ জাতি। বাচনভঙ্গি ও বক্তৃতার বৈশিষ্ট্যে তারা অন্যন্য। আরবী ভাষা এমন একটি ভাষা যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরব সংস্কৃতিকে জীবন্ত রেখেছে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আরব জাতির যোগাযোগের সেতুবন্ধন হয়ে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে অবস্থান করেও এর মাধ্যমেই প্রাচীন ও বর্তমান আরবের মুসলিমগণ একতাবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ জীবনযাপন করে। সে জিহ্বা দিয়ে কথা বললেও তার চিন্তাভাবনা, গতিবিধি এবং আবেগকে এক ভাষার ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখে; ভূখণ্ড, অঞ্চল ও দেশের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও (আল-লুগা আরাবিয়া ওয়া মাকানাতুহা বায়নাল লুগাত, ১/২)। 

আরবী ভাষা আরব জাতির বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এটি তাদের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যুগযুগ ধরে চলমান আছে। আরবী একটি বিশাল মানব সভ্যতার ভাষা হতে সক্ষম হয়েছিল যেখানে বিভিন্ন জাতি অংশগ্রহণ করেছিল। আরবরা ছিল এর মৌলিক নেয়ামক এবং এর জাহাজের পথপ্রদর্শক। তারা সবাই একে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভাষা বলে মনে করত, তাই এটি বিজ্ঞান, রাজনীতি, বাণিজ্য, আইন, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, সাহিত্য এবং শিল্পের ভাষা হতে সক্ষম হয়েছিল (আল-লুগা আরাবিয়া ওয়া মাকানাতুহা বায়নাল লুগাত, ১/৩)

জাতির ভাষা তার ঐক্যের ভিত্তি, তার সভ্যতার দর্পণ এবং তার জীবনবিধানের অলৌকিকতার বহিঃপ্রকাশক। আল-কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যার মাধ্যমে আরবী ভাষা অলৌকিকতার পোশাকে আবৃত হয়। কোটি কোটি মানুষ আরবী ভাষার প্রতি আকৃষ্ট করে যা তাদের ভাষাকে পবিত্র ও গর্বিত করে। ফরাসী আর্নেস্ট রেনান বলেছেন, ‘আরবী ভাষা হঠাৎ করে খুব নিখুঁত হতে শুরু করেছে এবং এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা। এতে শৈশব বা বার্ধক্য নেই’ (আল-ইরতিকাউ বিল আরাবিয়া ফী ওয়াসাইলিল ই‘লাম, নূরুদ্দীন বিলবিল, কিতাবুল উম্মাত, ৮৩ সংখ্যা, রজব ১৪২২ হি.)। জার্মান ফ্রেইটাগ বলেছেন, ‘আরবী ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ভাষা’ (আল-লুগা আরাবিয়া ওয়া মাকানাতুহা বায়নাল লুগাত, ১/৪)। উইলিয়াম ওয়ার্ক বলেছেন, ‘আরবী একটি মনোরম ভাষা যা যুগের আলোকে খাপ খেয়ে যায়’ (আল-লুগা আরাবিয়া ওয়া মাকানাতুহা বায়নাল লুগাত, ১/৪)। ড. আব্দুল ওয়াহাব গ্রাম বলেছেন, ‘আরবী একটি সম্পূর্ণ, মনোরম, বিস্ময়কর ভাষা, এর শব্দগুলো প্রায় প্রকৃতির দৃশ্যগুলোকে চিত্রিত করে, এর শব্দগুলো আত্মার চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করে এবং এর অর্থ শব্দের ঝংকারে পরিস্ফুটিত হয়, যেন এর শব্দগুলো বিবেকের ধাপ, হৃদয়ের স্পন্দন এবং জীবনের সুর’ (আল-লুগা আরাবিয়া ওয়া মাকানাতুহা বায়নাল লুগাত, ১/৪)

ড. তাহা হুসাইন বলেছেন, ‘যে আরব বুদ্ধিজীবীরা তাদের ভাষা আয়ত্ত করতে পারেননি এটা তাদের কেবল সংস্কৃতিগত ঘাটতিই নয়, বরং তাদের পুরুষত্বেরও একটি বড় এবং অপমানজনক ঘাটতি’ (আল-লুগা আরাবিয়া ওয়া মাকানাতুহা বায়নাল লুগাত, ১/৪)। আরবী ভাষা পাঁচটি আন্তর্জাতিক ভাষার মধ্যে একটি। এর মাহাত্ম্য এতেই প্রকাশ পায় যে এটি কুরআনের ভাষা, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমরা কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি ঐ সম্প্রদায়ের জন্য যারা বোঝে’ (ইউসুফ, ১২/২)। 

অতএব, ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখাতে হবে এবং আরবীকে আল-কুরআেনর ভাষা হিসেবে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই ভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আংশিকভাবে পালিত হয়েছে বলে মনে করব। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

Magazine