কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আরবরা কেন ফিলিস্তীনিদের সক্রিয় সহযোগিতা করে না?

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

চরমপন্থা ও ধর্মান্ধতা ইয়াহূদীদের বৈশিষ্ট্যগত আচরণ, কিন্তু তার চেয়েও বিপজ্জনক হলো তারা মনে করে যে, তাদের চরমপন্থা পবিত্র। তাদের বর্বরতা, হিংস্রতা ও পাশবিকতা সীমালঙ্ঘনের যে-কোনো মাত্রা অতিক্রম করেছে। গাযার সকল স্থাপনা বুলডোজার ও বোমার আঘাতে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তবুও তাদের নির্বিচার গোলাবর্ষণ থামছে না। তাদের হিংসা ও প্রতিশোধের জ্বালা এত তীব্র যে ফিলিস্তীনি ইয়াতীমদের ক্রন্দন, যুবকদের চিৎকার, আহতদের বিলাপ এবং দুর্গতদের আর্তনাদ তাদের মনে সামান্যতম দয়া সৃষ্টি করে না।

সভ্যতার উত্থান ও পতন হয়, কিন্তু বর্বরতা থেকে যায়। সভ্যতা মানুষের উদারতার প্রতীক না হলেও সভ্য মানুষ চরমপন্থি, ধর্মান্ধ ও নিপীড়ক হয় না; কারণ অশুভ নীতি কেবল অজ্ঞতা ও পশ্চাৎপদতার দিকে ধাবিত করে। বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি ন্যায়বিচার ও মানবিকতা শেখানো হয় না? তাহলে সভ্যতার শীর্ষে থাকা মানুষদের এরূপ পশুসুলভ আচরণ কেন! উদার মানুষ মানবাধিকারকে বিশ্বাস করে আর পদলেহী চাটুকাররা ক্ষমতাবানদের বিশ্বাস করে। তাই পদলেহী বিশ্বাসঘাতকদের অপরাধীদের রক্ষা এবং গাযায় দুর্গতদের মুক্তদের প্রতিরক্ষা দেখে অবাক হবেন না। জন্মগতভাবেই আরব জনগণ ফিলিস্তীন সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেয়। তবে গাযায় হামাস নির্মূল যুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ, গত দুই দশক ধরে আরব রাজনীতিকে প্রভাবিত করে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ইরাক যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর শাসন কার্যক্রম পরিচালনায় পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ভর করে। ফলে ফিলিস্তীনিদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের রাজপথে দেখা যায় না।

আরব লীগের ওপর সঊদী আরবের নিয়ন্ত্রণের পর থেকে ফিলিস্তীনিদের পক্ষে প্রতিবাদ দুর্বল হয়ে পড়ে। বিগত বছরগুলোতে আরব দেশগুলোর রাজপথে ফিলিস্তীনিদের পক্ষে বিক্ষোভ না থাকলেও হাজারো ইয়ামানী রাজপথে তাদের সমর্থনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অধিকার রক্ষায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করা তাদের স্বভাবজাত বিষয়। কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিল যে অভ্যুত্থান, অস্থিরতা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে অন্যায়ের পরিবর্তন সম্ভব।

প্রথমত, আরব নেতারা ইসরাঈলের সামরিক ক্ষমতাকে ভয় পায়। ইসরাঈলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে তারা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে থাকে। এজন্য দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে জনগণের উপর ভয়ভীতি প্রদর্শন বা দমন-পীড়ন চালায়। এমনকি তাদের কিছু প্রজাতন্ত্রী শাসন রাজতন্ত্রের পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে বিক্ষোভের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের আশা ক্ষীণ হয়েছে। কোনো কোনো আরবদেশে শাসকদের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়লেও চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি।

দ্বিতীয়ত, আরবদের এমন কোনো রাজনৈতিক নেতা নেই যে ফিলিস্তীনিদের সমস্যা সমাধানে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করবে। একসময় আরব নেতৃত্ব ফিলিস্তীনের পক্ষে জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়। সমস্ত আরব দেশ পশ্চিমের স্বার্থ উপেক্ষা করে ইসরাঈলের পাশাপাশি ফিলিস্তীনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রদানের জন্য প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের উক্ত সমাধান ইসরাঈলি নেতারা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে। ফলে তাদের শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি।

তৃতীয়ত, সশস্ত্র বাহিনীর ওপর আমেরিকার তত্ত্বাবধান, গোয়েন্দা সংস্থার নযরদারি এবং দমন-পীড়নের ফলে রাজপথ নিয়ন্ত্রণে শাসকগোষ্ঠীর সক্ষমতা বেড়ে যায়। লেবাননের বিক্ষোভকারী ও ফিলিস্তীনি শরণার্থীরা কঠিন মার্কিন প্রতিরোধের শিকার হয়। আরব সামরিক বাহিনী আমেরিকা এবং তার সহযোগী শাসকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইরাকে আমেরিকার নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনী জনগণের ক্ষোভ থেকে রক্ষায় নিজেদের পাহারা দেয়। আরব সেনাবাহিনীর প্রধান ভূমিকা থাকে আমেরিকার চাহিদা অনুযায়ী বিক্ষোভ দমন ও প্রয়োজনে বিক্ষোভ দমনে প্রয়োজনে জনতাকে হত্যা করা।

চতুর্থত, ফিলিস্তীনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো আর ইসরাঈলের উপর শত্রুতা প্রকাশে জনগণকে রাস্তায় নামানো আরব শাসকদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কিন্তু তারা এখন মনে করে ইসরাঈল পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী সহচর। তাদের রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ইসরাঈলি সত্তার অখণ্ডতার উপর নির্ভরশীল। এমনকি তাদের কিছু শাসক ইসরাঈলের সাথে প্রকাশ্যে জোটবদ্ধ হয়েছে। ফিলিস্তীনের প্রতি সহানুভূতি জানানো এবং জায়নবাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রদর্শনের অর্থ বিদ্যমান সরকারগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতায় জড়ানো।

পঞ্চমত, বিনোদন জগতের খবর ও রাজনৈতিক মিথ্যা তথ্য আরব বিশ্বের মানসিকতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সংস্কৃতির উত্থানে আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রচারমাধ্যমের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাপক। শাসকদের রাজনৈতিক স্বার্থ এবং জায়নবাদীদের স্বার্থ রক্ষায় প্রচারমাধ্যমগুলো কাজ করে। তাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক ‘আশ-শারক আল-আওসাত’ মিথ্যা সংবাদ প্রচারে জায়নবাদীদের পৃষ্ঠপোষক ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-কে ছাড়িয়ে গেছে। ‘আশ-শারক আল-আওসাত’ একটি প্রবন্ধে গাযায় পশ্চিমাদের সাহায্য প্রেরণের খবর প্রচার করে; অথচ রকেট আর যুদ্ধ বিমানের গোলা-বারুদে সেখানকার শিশু ও নারী-পুরুষ ক্ষতবিক্ষত। এই যুদ্ধে আরব মিডিয়া ইসরাঈলের অপরাধের বিরুদ্ধে আরবদের ক্ষোভ ও প্রতিশোধকে প্রশমিত করে। মুহাম্মাদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ‘সঊদী সরকারও হামাসকে নির্মূল করতে চায়’ মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের এমন বক্তব্য সঊদী সরকার অস্বীকার করেনি।

ষষ্ঠত, জায়নিস্ট মিডিয়ার অন্যতম উপাদান হলো বিনোদন সংস্কৃতি। উপসাগরীয় সকল মিডিয়া বিনোদন ও খেলাধুলার প্রচারে ব্যস্ত। এমনকি গল্ফ খেলা যার সাথে আরবদের পরিচয় ছিল না সেটা তাদের শাসকদের বিনোদনের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে খেলাধুলা ও বিনোদনে আকৃষ্ট করতে ইসরাঈল চেষ্টা চলছে। প্রতিটি আরব দেশের নতুন প্রজন্ম খেলাধুলা ও বিনোদন সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত। এখন তাদের স্মৃতিপটে ফিলিস্তীনি শহীদদের পরিবর্তে আরব ক্রীড়াবিদদের নাম বেশি ভাসমান থাকে।

সপ্তমত, ইরাক যুদ্ধ এবং ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধের পর উপসাগরীয় শাসকরা সাম্প্রদায়িক মতভেদের প্রতি জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে এবং অভ্যন্তরীণ বিপদের প্রতি তাদেরকে মনোযোগী করতে চেষ্টা চালায়। আরবদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতি, সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করার সংস্কৃতি একটি সুচিন্তিত নীতি। প্রাচ্যনীতির সংস্কৃতি প্রমাণ করে আরবরাই তাদের সমস্যা এবং দুর্ভোগের জন্য দায়ী। উপসাগরীয় সরকারগুলো এই মতবাদকে গ্রহণ করে এটিকে জনপ্রিয় করেছে। প্রতিটি আরব দেশের সেনাবাহিনী সামাজিক মিডিয়ায় একথা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, জায়নবাদী এজেন্ডা আরবদের জন্য হুমকির কারণ নয়।
অষ্টমত, অনেক আরব দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়েছে কিংবা নিষেধাজ্ঞার কবলে বন্দি আছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সব আরব দেশের প্রধান দলগুলো ফিলিস্তীনের পক্ষে সক্রিয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। ক্ষমতায় আসার আগে ফিলিস্তীনের স্বাধীনতার আহ্বানে সর্বাগ্রে ছিল বাথ পার্টি। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর মুক্তি ও ঐক্যের সংগ্রামের পরিবর্তে নিজেদের শক্তি টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে মনোনিবেশ করে। অনেক আরব দেশ বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে নিজস্ব দল গঠন করে যারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। প্যালেস্টাইনপন্থি সক্রিয়তায় মত প্রকাশের কাজে জনগণকে তারা গাইড করেন না। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তীনপন্থি আন্দোলনগুলো পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, কারণ সেখানে আরব শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দেয়নি; বরাং সেখানে ছাত্র ও প্রগতিশীল সংগঠন নেতৃত্ব দিয়েছিল।

নবমত, আরব দেশগুলোতে ফিলিস্তীনি শিবিরগুলোর ভূমিকা বদলে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, লেবাননে ফিলিস্তীনি শিবিরগুলো ফিলিস্তীনপন্থি সক্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। শিবিরগুলো থেকে বিক্ষোভের প্রস্তুতি এমনকি শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র বিপ্লবী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হতো। লেবাননে আজকের ফিলিস্তীনি শিবিরগুলো ফাতাহ এবং হামাস দলে বিভক্ত। তারা সঊদী আরব কিংবা আরব আমিরাতের প্রতি অনুগত থাকে।

দশমত, আক্বীদাগত পার্থক্য তাদের বিভাজনের অন্যতম কারণ। একজন মুসলিমের ইসলামের গণ্ডির মধ্যে থাকা বা না থাকার চূড়ান্ত মাপকাঠি তার আক্বীদা। বর্তমানে আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো ইরানের সাথে ফিলিস্তীন বিশেষ করে হামাসের সম্পর্ক গভীর। ইরান হামাসকে ইসরাঈলের মোকাবিলা করতে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ইরানের মদদপুষ্ট সশস্ত্রগ্রুপ হিযবুল্লাহ এর সাথেও তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আক্বীদাগত পার্থক্যের কারণে সালাফরা মনে করে তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা জরুরী। কারণ, যখন কোনো জাতির আক্বীদা ভ্রান্ত হয়, তখন তাদের দ্বারা প্রতারিত হওয়া স্বাভাবিক।

আরব বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ অকুণ্ঠভাবে ফিলিস্তীনিদের সমর্থন করে। তারা ফিলিস্তীনিদের সংগ্রামকে নিজেদের মর্যাদা ও মুক্তির আন্দোলনের প্রতিফলন হিসেবে দেখে। কাজেই আরব রাষ্ট্রপ্রধানদের উচিত হবে পশ্চিমা কিংবা ইউরোপের কোনো শক্তির কাছে মাথা নত না করা; বরং জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের দাবিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দেশ পরিচালনা করা। সততার সাথে দেশ পরিচালনা করলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সাহায্য আসবেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় অতি সন্নিকটে’ (আছ-ছফ, ৬১/১৩)

আরব জনগণ কি মনে করে যে ওয়েবসাইটে একটি টুইট বা মন্তব্য সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট? অন্দলোন সংগ্রাম সরকার পরিবর্তন করে, যখন তারা মনে করে উক্ত কারণের জন্য সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করছে। আল্লাহ তাআলা সকল মুসলিম রাষ্ট্রের শাসককে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলিমদের সহযোগিতা করার কিংবা তাদের জনগণকে অত্যাচারী শাসককে পরিবর্তন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন! (স.)

Magazine