কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

নব্য খারেজী থেকে সাবধান!


اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবূ বকর, উমার ও উছমান রাযিয়াল্লাহু আনহুম–এর সময়ে কোনো বিভক্তি তৈরি হয়নি। উছমান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ফেতনা শুরু হয়, সংঘটিত হয় উষ্ট্রের ও ছিফফীনের যুদ্ধ। সৃষ্টি হয় এই উম্মাহর মধ্যে প্রথম বিভক্তি। ঐ ফেতনার জের ধরেই জন্ম হয় খারেজী ও শীআ ফেরক্বাদ্বয়ের। এগুলো ৩৭ হিজরী ও তৎপরবর্তী ঘটনা। সুতরাং বলা চলে, খারেজীরাই ইসলামের প্রথম পদস্খলিত ও ভ্রান্ত ফেরক্বা।

‘খারেজী’ শব্দটি আরবী ‘খুরূজ’ (خروج) শব্দ হতে নির্গত। এর অর্থ- বেরিয়ে যাওয়া। বহুবচনে ‘খাওয়ারিজ’ (خوارج) ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থে- যে ব্যক্তি কোনো পূর্বসূরী ছাড়াই নিজে নিজে বেরিয়ে যায়, তাকে খারেজী বলে। এ অর্থ ও খারেজীদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মিল হচ্ছে, তারাও নিজে নিজেই মুসলিমদের অনুসৃত পথ থেকে বেরিয়ে গেছে এবং সালাফে ছালেহীনের মধ্য থেকে তাদের কোনো পূর্বসূরী নেই। পারিভাষিক অর্থে- যারা কাবীরা গোনাহর কারণে কোনো মুসলিমকে কাফের ফতওয়া দেয় এবং মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তাদেরকে খারেজী বলা হয়। এই দু’টি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে-ই খারেজী। কাফের ফতওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা কখনও কাবীরা গোনাহগারকে কাফের বলে। আবার কখনও পাপই নয়- এমন ব্যাপারে কাফের বলে। কখনও আবার স্রেফ ধারণার বশবর্তী হয়ে কাফের বলে। কখনও দেখা যায়, ইজতিহাদী বিষয়ে কাফের বলে। এসব ক্ষেত্রে তারা কোনো ধরনের নিয়মনীতি ও শর্তের তোয়াক্কা করে না। তবে, আক্বীদা, আমল ও চরমপন্থার দিক দিয়ে খারেজীরা সবাই এক রকম নয়। যাদের মধ্যে খারেজীদের নিদর্শন পাওয়া যায়, তারা দুই শ্রেণির: এক শ্রেণির মধ্যে খারেজীদের সবকিছুই পাওয়া যায় এবং আসলেই তারা খারেজী। এদের ব্যাপারে হাদীছে কঠোর শাস্তি ও নিন্দার কথা এসেছে। আরেক শ্রেণির মধ্যে খারেজীদের কিছু আলামত পাওয়া যায়, কিন্তু তাদেরকে খারেজী বলা যায় না। এ প্রকারটি বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের মধ্যে পাওয়া যায়, যাদের আলামতগুলোকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করতে না পারলে তারাও প্রথম শ্রেণিতে রূপান্তরিত হতে পারে। ফলে এদের অবস্থাও অত্যন্ত বিপজ্জনক।

কিছু কারণ রয়েছে, যেগুলো একজন মানুষকে ধীরে ধীর খারেজী হওয়ার বা চরমপন্থা অবলম্বনের দিকে নিয়ে যায়। যেমন- (ক) দ্বীনী ইলমের চরম সংকট। (খ) সালাফী মানহাজের প্রতি অবজ্ঞা। (গ) দ্বীন পালনের ব্যাপারে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি। (ঘ) জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছাড়াই অযথা আবেগপ্রবণতা। (ঙ) আলেম-উলামার সাহচর্য থেকে দূরে অবস্থান ও তাদের কাছ থেকে ইলমগ্রহণ বর্জন। (চ) জ্ঞানীর ভাব ধরা ও আত্ম-অহংকারে ফেটে পড়া। (ছ) বয়সের স্বল্পতা ও অপ্রতুল অভিজ্ঞতা। (জ) আল্লাহর দিকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার অভাব ইত্যাদি।

প্রাচীন ও নব্য প্রত্যেক খারেজী আসলে একই গোয়ালের গরু। সর্বযুগে তাদের বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ প্রায় একই। তবে কিছু বৈশিষ্ট্য এমন আছে, যা প্রাচীন খারেজীদের মধ্যে ছিলো, কিন্তু এখন নেই। আবার এর উল্টোটাও ঠিক। আবার কিছু বৈশিষ্ট্য আগে ছিলো, এখনও আছে; তবে মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেছে। প্রত্যেক খারেজীর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কাবীরা গোনাহগারকে কাফের বলা। মূলত এই বিশ্বাস থেকেই এদের অন্য শাখা-উপশাখা বৈশিষ্ট্যগুলো গজিয়েছে। এখান থেকেই তারা মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কারণ তাদের দৃষ্টিতে তারা কাফের। ফলে ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের নামে তারা মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রোপাগান্ডা চালায়। এতে তারা নিজেদের সাহসী বীরপুরুষ ভাবে। এছাড়া তাদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: (১) সর্বযুগের খারেজীরা মূল যে ভিত্তির উপর ভর করে মুসলিমদেরকে কাফের বানানোর অপচেষ্টায় নামে, সেটা হলো- ‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ফায়সালা করা’। এই হক্ব কথার অন্তরালে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে। (২) কুরআন-হাদীছ বুঝার ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীনের বুঝের তোয়াক্কা না করা। কারণ সালাফে ছালেহীনকে তারা পাঁচ পয়সার মূল্য না দিয়ে নিজেদেরকে মহাপণ্ডিত মনে করে এবং যা ইচ্ছা ব্যাখ্যা প্রদান করে। (৩) তাদের মধ্যে আলেম-উলামা না থাকা। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর বর্ণনামতে, তৎকালীন খারেজীদের মধ্যে একজনও ছাহাবী ছিলেন না। তার মানে তাদের মাঝে একজন আলেমও ছিলেন না। কারণ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর সময়ে ছাহাবীগণ কেবল আলেম ছিলেন। বর্তমানযুগে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। (৪) বিরোধীদের প্রতি চরম দুঃসাহসিকতা, তিনি যত জ্ঞানী-গুণী-সম্মানীই হন না কেন। (৫) তাদের বিরোধী আলেম-উলামাকে জাতির সামনে খাঁটো করে উপস্থাপন করা এবং হীন ও রূঢ় আচার-ব্যবহার দেখানো। তারা আলেম-উলামাকে কাপুরুষতা ও ভয়ের অপবাদ দিয়ে থাকে। বর্তমানযুগে তারা আলেম-উলামাকে ‘মুরজিঈ’, দরবারী আলেম, সরকারের দালাল ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে জাতির সামনে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। যাদের প্রথম পূর্বপুরুষ যুল খুওয়াইছারা স্বয়ং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বেইনছাফীর ট্যাগ লাগানোর দুঃসাহস দেখিয়েছিল (!), তার বশংবদেরা অন্য যে কাউকে যে কোনো ট্যাগ লাগাতে পারে- এটাই স্বাভাবিক নয় কি? (৬) যাকে তাকে কাফের ফতওয়া দেওয়া, বিশেষ করে শাসকশ্রেণিকে। তাদের কাছে বর্তমান মুসলিম শাসক বলতে কেউ নেই। এক্ষেত্রে তাদের জিহ্বা অত্যন্ত পিচ্ছিল। এমনকি পিতা-মাতা পর্যন্ত তাদের এই ফতওয়াবাজি থেকে বাঁচতে পারেন না। (৭) তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিমদেশ বলে কিছুই নেই, এমনকি মক্কা-মদীনাও না। (৮) মুসলিমদের রক্তপিপাসা। অযথা মুসলিমদের কাফের ফতওয়া দিয়ে তাদের রক্ত নিয়ে হোলিখেলা খারেজীদের সর্বযুগের বৈশিষ্ট্য। এমনকি তাদের বিরোধীদের স্ত্রী-সন্তানরাও তাদের নগ্ন হামলা থেকে বাদ যায় না। মুসলিমবিশ্বের আত্মঘাতি ও গুপ্ত হামলাগুলো তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। (৯) যিম্মী, মুস্তা’মিন ও মু‘আহাদ কাফেরের রক্ত হালাল মনে করা। আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে আগমনকারী কাফেরদের উপর বিভিন্ন সময়ে নগ্ন হামলা একথার প্রমাণ বহন করে। (১০) কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের কখনও কোনো ভূমিকা ছিলো না, আজও নেই; বরং তাদের সংগ্রামই হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে। (১১) হিজরতের আহ্বান জানানো, এমনকি মক্কা-মদীনা থেকেও। তারা লোকালয় বর্জন করে নির্জনে যাওয়ার ডাক দেয়। সেজন্য বোধ হয়, অনেককে গ্রামে-গঞ্জে, বনে-জঙ্গলে হিজরতের ডাক দিতে দেখা যায়। (১২) নিজেদেরকে ফিরক্বা নাজিয়াহ বলে বিশ্বাস করা এবং তারা ভিন্ন আর কেউ কুরআন ও সুন্নাহর উপরে নেই মনে করা। (১৩) এদের দৃঢ় ও পূর্ণ বিশ্বাস হলো, তাদের অনুসারীরা শহীদ ও জান্নাতে। (১৪) মানুষকে বাতিলে অবগাহন করাতে কিছু হকের টোপ দেওয়া এবং সাথে বাতিল মিশিয়ে গলধঃকরণ করানো। (১৫) কারো ব্যাপারে তড়িঘড়ি করে হুকুম দেওয়া। (১৬) চটকদার কথা কিন্তু গর্হিত কাজ। (১৭) প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া। তাদের কর্মকাণ্ডে সবসময় এটা প্রমাণিত। (১৮) সবকিছুতে গোপনীয়তা। সেজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের কণ্ঠ শোনা যায়, কিন্তু চেহারা দেখা যায় না। (১৯) নিজেদের ভুল স্বীকার না করা; বরং উল্টো নিজেদের কর্মকাণ্ডকে নেকীর কাজ ভাবা। সেজন্যই তো তাদেরকে নিরীহ মানুষ জবাইয়ের ভিডিও প্রচার করে উল্লাস করার ভিডিও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়। (২০) খারাপ নয় এমন কিছুকে খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করা। (২১) মুসলিম শাসকের নেতৃত্বে জিহাদকে অস্বীকার করা এবং যত্রতত্র জিহাদের ডাক দেওয়া। (২২) ইসলামের কল্যাণ-অকল্যাণের মূলনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। সেজন্য হিতাহিত জ্ঞানহীনভাবে তাদেরকে বিভিন্ন অপকর্ম ঘটাতে দেখা যায়।

বুঝা গেলো, চরমপন্থা ও উগ্রবাদই খারেজীদের মূল হাতিয়ার; এরা অসম্ভব রকমের চরমপন্থী ও উগ্রবাদী হয়ে থাকে। এদের এই সীমালঙ্ঘন ও চরমপন্থার কারণে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদেরকে নানানভাবে নিন্দা করেছেন এবং এদের কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি তাদেরকে নিকৃষ্টতম সৃষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (মুসলিম, হা/১০৬৭)। তাদেরকে জাহান্নামের কুকুর বলা হয়েছে (ইবনু মাজাহ, হা/১৭৬, হাসান)। তারা ইসলাম থেকে তীরের ধনুক থেকে বের হওয়ার ন্যায় বের হয়ে যায় (বুখারী, হা/৩৬১১; মুসলিম, হা/১০৬৪)। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদেরকে হত্যা করতে বলেছেন এবং হত্যাকর্মে নেকীর ঘোষণা দিয়েছেন (বুখারী, হা/৬৯৩০; মুসলিম, হা/১০৬৬)। বরং তিনি নিজে তাদেরকে আদজাতির মতো করে হত্যা করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন (বুখারী, হা/৩৩৪৪; মুসলিম, হা/১০৬৪)

কারণ এদের দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এরা বিভিন্ন সময় পৃথিবীব্যাপী নিষ্পাপ ছোট-বড়, নারী-পুরুষের রক্ত ঝরিয়েছে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি করেছে। মুসলিমদের মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। কাফেরদের চোখে ইসলাম ও মুসলিমদের খাঁটো করেছে। এরাই মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা ইসলাম ও এর অনুসারীদেরকে সন্ত্রাসী ট্যাগ লাগিয়ে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করেছে। ফলে তারা যেমন প্রত্যক্ষভাবে মুসলিমদের উপর নগ্ন হামলা চালিয়েছে, তেমনি কাফেরগোষ্ঠীকে দিয়েও তাদের জান-মালের উপর আক্রমণের পথ তৈরি করে দিয়েছে। তাদেরকে বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে।

মহান আল্লাহ খারেজীসহ সকল দিকভ্রান্তদের হেদায়াত দান করুন এবং হেদায়াতপ্রাপ্তদের হেদায়াতের উপর অবিচল রাখুন। আমীন!

Magazine