اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
পৃথিবীর প্রতিটি জাতিকে পরাধীন ও গোলাম রাখার অত্যন্ত সহজ উপায় হচ্ছে তাদেরকে বিভক্ত করা। ১৯৪৭-এ পূর্ব বাংলার মুসলিমদের স্বতন্ত্র স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য যে কুরবানী শের-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দিয়েছেন এবং নিজেদের অভিমান ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে স্বাধীন মুসলিম বাংলার প্রশ্নে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন সেই ঐক্যবদ্ধ চেতনাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। ৪৭ পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে সেই জাতিকেই বিভক্ত করার ভারতীয় বয়ান কলকাতা থেকে আমদানি করা হয়। অথচ এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বয়ান আমাদেরকে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের নামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। পূর্ববঙ্গের চাষাভুষা মুসলিমদের সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের টাকাতেই গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহর। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের সময় সমগ্র পূর্ববঙ্গে কোনো কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিছুই ছিল না। যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব পূর্ববঙ্গের মুসলিমদেরকে শত বছর যাবৎ যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল, সেই তত্ত্বকেই পুনরায় বিক্রি করে ৪৭ পরবর্তী সময়ে ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করার পাঁয়তারা শুরু হয়।
১৯৭১ আমাদের নিকটে পাকিস্তানিদের বৈষম্য থেকে মুক্তির লড়াই হলেও এটি ভারতের কাছে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন। ১৯৭১ আমাদের নিকটে একটি স্বাধীন জাতিসত্তার জন্ম হলেও ভারতের নিকটে এটি পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে জন্ম নেওয়া একটি বিকলাঙ্গ সন্তান। তাইতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে একমাত্র তাদের বিজয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন। উক্ত বিজয়ে বাংলাদেশের নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেননি। সেই একই কারণে ১৬ই ডিসেম্বরের অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে ইচ্ছাকৃতভাবে জেনারেল ওসমানীকে উপস্থিত হতে দেওয়া হয়নি। ঠিক একই কারণে প্রবাসী সরকারের সাথে ভারত সরকার একটি সাত দফার চুক্তি সম্পন্ন করে। যা মূলত একটি গোলামির চুক্তি ছিল। বাংলাদেশকে ভারত কখনোই একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিতে চায়নি। যে কারণে স্বাধীনতার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সকল ডিসি অফিস ও থানাগুলোতে ভারতীয় অফিসাররা দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করতেও গড়িমসি করে ভারত সরকার। আন্তর্জাতিক চাপে সেনা প্রত্যাহার হলেও রক্ষীবাহিনী নামের বিষফোড়া বাংলাদেশে রেখে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি জিইয়ে রেখে বাংলাদেশকে শাসন করার পরিকল্পনা করে ভারত। ১৯৭৫ সালে এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে গেলে এবং সকল প্রচেষ্টার পর বাংলাদেশ যখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টায় সফল হতে যাচ্ছিল, তখনি জাতিকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার জন্য নতুন চেতনা উপস্থিত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকারের নামে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর পর জাতিকে বিভক্ত করার চেতনা। শতকরা এক ভাগের চেয়েও কম জনগণের জন্য ৩০%-এরও বেশি কোটা রাখা হয়। এই চেতনা বিক্রি করেই গত ১৬ বছর ফ্যাসিজম তাদের সকল অন্যায়কে বৈধতা দিয়েছে। এই চেতনার মুখে চপেটাঘাত করেই ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্ররা রাতের আঁধার চিরে স্লোগান তুলেছিল— ‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার রাজাকার’। ২৪-এর ছাত্র আন্দোলন ছিল দেশকে বিভক্তকারী ও সকল অপরাধকে জায়েযকারী এই চেতনার কবর রচনার মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার আন্দোলন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, জুলাই বিপ্লবের পরও বাংলাদেশের চিহ্নিত কিছু মিডিয়া, দেশের চিহ্নিত রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের একটি অংশ পুনরায় সেই চেতনাকে বিক্রি করে দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যেমন, গত ২২ ডিসেম্বর রবিবার কুমিল্লায় একজন স্বীকৃত অপরাধী আব্দুল হাই ওরফে কানুকে এলাকাবাসী গলায় জুতার মালা পরিধান করিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। সাথে সাথেই বিষয়টি নজরে আসে ফ্যাসিজমের সুবিধাভোগী একদল মিডিয়ার। তারা অপরাধীর সকল কুকর্ম জানার পরও তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টিকে হাইলাইট করে ব্যাপকভাবে সংবাদ প্রচার শুরু করে। ‘মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা’, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার লাঞ্ছনা’ ইত্যাদি শিরোনাম দিয়ে এমনভাবে সংবাদ প্রচার শুরু করে যে, শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর ঘটনাটির তীব্র নিন্দা জানায়। এমনকি বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম সেক্যুলার রাজনৈতিক দল ও একটি বৃহত্তম ধর্মীয় রাজনৈতিক দল উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত তাদের কর্মীদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করে। প্রশাসন উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করে। অথচ সেই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধার সকল অপরাধ বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়। বিভিন্ন পত্রিকা মারফত তার আমলনামার যে ফিরিস্তি উঠে এসেছে তার সারমর্ম হচ্ছে, তিনি হত্যা মামলাসহ প্রায় ৯টি মামলার আসামী। হত্যা মামলাটি তার নিজ দল আওয়ামী লীগেরই কর্মী আবু বকর ছিদ্দীক রানাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করার মামলা। যেই মামলায় তিনি ও তার ছেলে বিপ্লব জেলও খেটেছেন। শুধু তাই নয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগও বহুবার তার বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করেছে এবং তার ফাঁসি চেয়েছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অনেক কর্মীকে তিনি এলাকাছাড়া এমনকি দেশছাড়া করতে বাধ্য করেছিলেন (দৈনিক ইনকিলাব, স্টাফ রিপোর্ট, ‘জুতার মালা’ মুক্তিযোদ্ধা কানুর ফ্যাসিস্ট রঙ মুছে দিলো?’, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)।
এই দিকে যারা উক্ত মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দিয়েছেন, তাদেরকে রাজাকারের নাতি সম্বোধন করে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘তাদেরকে গোলাম নিজামীর মতো ফাঁসি দেওয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অস্বীকারকারীদের ফাঁসি দেওয়া হবে’ (যমুনা টিভি, ‘আবারও বাংলাদেশ নিয়ে কটূক্তি আর অশালীন মন্তব্য বিজেপি নেতা শুভেন্দুর’, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪)। তার এই বক্তব্য প্রমাণ করে, ‘মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকার’ নামে দেশ ও জাতিকে বিভক্ত রাখা একটি ভারতীয় চেতনা।
অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অবশ্যই আমরা বিচারবহির্ভূত যেকোনো কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। তবে তার অর্থ এই নয় যে, এটিকে কেন্দ্র করে চিরদিন জাতিকে বিভক্ত রাখা হবে বা কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই আবেগতাড়িত হয়ে রাষ্ট্র এক তরফা সিদ্ধান্ত দিবে। আমাদের নবী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের পর মক্কার নব মুসলিম ও মদীনার মুহাজির-আনছারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করেননি। পৃথিবীর ইতিহাসের কোনো সভ্য দেশে জাতির মধ্যে এই ধরনের কোনো বিভক্তিকে দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখা হয় না। এই বিভক্তি জাতি হিসেবে আমাদেরকে দুর্বল করে দেয়। আমাদের শত্রুদেরকে সুযোগ করে দেয়— আমাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে আমাদেরকে শাসন করার। যাকে বলা হয়, ‘ডিভাইড এন্ড রুল’।
রাষ্ট্র ও আইনের দৃষ্টিতে অবশ্যই সকল নাগরিককে সমান হতে হবে। অপরাধ যেই করুক না কেন, তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট পরিচয় ধারণ করার জন্য যদি কারও অপরাধকে দৃষ্টির অগোচরে রাখা হয়, তাহলে এটিই সবচেয়ে বড় বৈষম্য। রাষ্ট্রীয় বৈষম্য। রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে বৈষম্য।
এই দেশে ৭১-এর পূর্বে ৫২ গেছে তারও পূর্বে ৪৭ গেছে। এখন ২৪ বিদায় নিল। এই প্রতিটি অধ্যায়েরই বাংলাদেশের ইতিহাসে সমান গুরুত্ব রয়েছে। আর প্রতিটিরই মূলমন্ত্র হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ। অতএব, কোনো নির্দিষ্ট চেতনাকে পুঁজি করে জাতিকে বিভক্ত করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ইবলীসও শয়তানে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বে সবচেয়ে বেশি ইবাদাতগুজার আল্লাহর অনুগত বান্দা ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারী মেজর ডালিম একজন বীর উত্তম উপাধিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তারপরও গত সরকারের নিকটে সে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত ছিল। অতএব, রাষ্ট্রকে সদাসর্বদা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তার নাগরিকদের মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (প্র. স.)