اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
১ জুন বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে দেশের ৫২তম বাজেট পেশ করা হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ডিজিটাল উপস্থাপনার মাধ্যমে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেটটি ঘোষণা করেন। এবার বাজেটের প্রতিপাদ্য ছিল— ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’।
প্রস্তাবিত এ বাজেটটির আকার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড়। এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট সরকার ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের দলীল। বাজেটে স্পষ্ট উল্লেখ থাকা দরকার, কীভাবে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? কীভাবে সংকট নিরসন করা হবে? তাজউদ্দীন আহমেদের পেশকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের শেষের দিকে সুন্দর করে হিসাব দেওয়া ছিল, কোন খাতে কত টাকা আয় হবে এবং কত ব্যয় হবে? অর্থনীতিবিদ, সংসদ সদস্য ও অন্যান্য বিশিষ্টজনের সঙ্গে পরামর্শ করে বাজেট প্রস্তাব করলে আরো বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে অনেকে মনে করেন।
বরাবরের মতো এবারও বাজেট নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। অনেকেই একে বাস্তবতাবিবর্জিত ও উচ্চাভিলাষী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সমালোচনার দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে— বাজেটে কিছু পণ্যে শুল্ক কর ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলেও তার তালিকা অনেক ছোট। বাজেটে পাচারের টাকা ফেরত আনা ও খেলাপিঋণ উদ্ধারে বিশেষ ব্যবস্থাপনা নেই। বাজেটে দুর্নীতি ও বৈষম্য মুক্তির নির্দেশনা নেই, বরং জনগণের কাঁধে নানাভাবে করের বোঝা চাপানো হয়েছে। টিআইএন বা কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের আয় করমুক্ত আয়সীমার নিচে থাকলেও তাদেরকে ন্যূনতম ২০০০ টাকা কর দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আবার সেই কর উঠাতে ৪৪ ধরনের সেবায় আয়কর প্রাপ্তিস্বীকারপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ অন্যান্য দেশের মতো সবকিছু অনলাইনভিত্তিক করে ফেলতে পারলে বিষয়টির সহজ সমাধান হতো। মুদ্রাস্ফীতি কমানোর কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। বাজেটে বড় ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকলেও কীভাবে আয় বাড়ানো যাবে, তারও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা পেশ করা হয়নি। বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির তেমন কোনো দিকনির্দেশনাও চোখে পড়ে না। অথচ শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকারের ভারে আমাদের অর্থনীতি ন্যুব্জ। ওদিকে বিদেশী চাকরিজীবীরা প্রচুর পরিমাণে অর্থ আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ ২৭ শতাংশে উন্নীত করার যে ঘোষণা এসেছে, তাও বাস্তবসম্মত নয় বলে অনেক অর্থনীতিবিদের বিশ্বাস। মানবসম্পদ তৈরির জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়ানো জরুরী। দক্ষ ও ন্যায়-নীতিবান জনসম্পদ ছাড়া দেশের উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু এবার এ দু’টি খাত কিছুটা অবহেলিত রয়েছে গেছে। অথচ অর্থনৈতিক সংকটের এ বছরে সরকারের পরিচালনা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৭ শতাংশ। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটকে গরীববান্ধব দাবী করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমের দিকে থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ানো উক্ত দাবীর সাথে সাংঘর্ষিক। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের উপরই চাপ বেশি পড়বে। মোটা অংকের বাজেট ঘাটতি থাকায় একদিকে যেমন রিজার্ভের উপর চাপ বাড়বে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপও বাড়বে।
পক্ষান্তরে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে ব্যক্তি-করসীমা বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো, কিছু বিলাসী পণ্যের আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু ইত্যাদি।
বর্তমান দেশের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি, রিজার্ভ ঘাটতি, ডলার সংকট, রেমিট্যান্স হ্রাস, কর্মসংস্থানের অভাব, আমদানি-রফতানির চ্যালেঞ্জ, করোনা-উত্তর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ প্রদত্ত ঋণের শর্ত পূরণ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, সিন্ডিকেটের প্রাধান্য ইত্যাদি কারণে এবারের বাজেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়গুলো বাজেটে গুরুত্ব পাওয়া জনগণের নিকট খুব কাঙ্ক্ষিত ছিল।
মহান আল্লাহ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিসহ সার্বিক সমৃদ্ধি দান করুন। আমীন!