اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
১৩ অক্টোবর ২০২১ রাতে কুমিল্লা সদরের নানুয়ার দীঘিরপাড়ের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার মণ্ডপে পবিত্র কুরআন অবমাননার ঘটনা ঘটে। যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন হনুমান মূর্তির কোলে কুরআন রেখে কে বা কারা মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের চরম অবমাননার অপচেষ্টা করে। ফলে সারাদেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙচুরসহ হতাহতের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। ২২টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং এর সাথে জড়িতদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
এরপর আমরা বলতে চাই- ইসলাম, ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কুরআন-হাদীছ ও এর নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবমাননার অপচেষ্টার ঘটনা নতুন নয়। বরং সর্বযুগে এজাতীয় ঘটনা ঘটেছে। এমনকি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশাতেও তাঁকে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেসব ঘটনার বিপরীতে যুগে যুগে তাদের ভূমিকা কী ছিল, তা আমাদেরকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে। শান্তি, ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতার জীবনব্যবস্থার নাম ইসলাম। ইসলামের মতো আর কোনো ধর্ম অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে উদারতা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে পারেনি। এমনকি যুদ্ধেও নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বেসামরিক নিরপরাধ নাগরিকের উপর হামলা করতে ইসলাম নিষেধ করেছে। অনুরূপভাবে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নষ্ট করাও নিষেধ। সেজন্য মুসলিমদের হৃদয়ে অন্যদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, প্রতারণা লুক্কায়িত থাকে না। বরং একজন মুসলিম ইসলামের ন্যায়পরায়ণতা, সমতা, অঙ্গীকার রক্ষা, দয়ার্দ্রতা ও নিরাপত্তা দ্বারা সকল মানুষের সাথে চলে। তবে এক্ষেত্রে সে ইসলামী আক্বীদা ও আচার-অনুষ্ঠানের অপমান বরদাশত করে না। নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েম করেন, তখন সেখানে বানু কুরায়যা, বানু ক্বায়নুক্বা‘ ও বানুন-নাযীর নামে তিনটি ইয়াহূদী গোত্র ছিল। ইসলাম যদি পরম উদারতা ও সহিষ্ণুতার ধর্ম না হতো, তবে তাদের সাথে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহযোগিতা ও উত্তম প্রতিবেশিত্বের সন্ধি চুক্তি করতেন না। মুসলিমদেশে কাফেরদের প্রতি ইসলাম কী অসাধারণ উদারতা প্রদর্শন করেছে, তা ইসলামের নিম্নবর্ণিত মূলনীতিগুলো থেকে খুব সহজে বুঝা যায় : (১) কাফেররা তাদের কুফরী অবস্থায় থাকতে পারবে। ‘আহলুয-যিম্মাহ’ বা মুসলিমদেশে ট্যাক্স দিয়ে বসবাসকারী কাফের, ‘মু‘আহিদ’ বা চুক্তিবদ্ধ কাফের ও ‘মুসতা’মিন’ বা ভিসা নিয়ে মুসলিমদেশে আগত কোনো কাফেরকে ইসলাম তাদের কুফরী অবস্থায় থাকার অনুমোদন দিয়েছে। তাদের কাউকে ইসলামে প্রবেশের জন্য ইসলাম বাধ্য করে না (আল-বাক্বারাহ, ২/২৫৬)। উল্লিখিত কোনো কাফেরের রক্ত ঝরালে সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না বলে ইসলাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছে (বুখারী, হা/৩১৬৬)। (২) কাফেরদের সাথে চুক্তি করা বৈধ। ইসলাম তাদের এবং আমাদের মধ্যকার এই চুক্তি রক্ষা ওয়াজিব করেছে, যদি তারা চুক্তি ভঙ্গ না করে (আত-তওবা, ৯/৪)। (৩) কাফেরদের সাথে শান্তি চুক্তি করা এবং তাদের নিরাপত্তা গ্রহণ করা বৈধ। খোদ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় কাফেরের নিরাপত্তা ও আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন (বুখারী, হা/৩১৩৯)। (৪) কাফেরদের হেদায়াতের আশায় তাদের রক্ত না ঝরানোর প্রতি যত্নশীল হওয়া। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভূমিকা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট বুঝা যায় (দ্র. মুসলিম, হা/১৭৮০)। (৫) কোনো মুসলিম কোনো কাফেরকে আশ্রয় দিতে পারে। আর এ অবস্থায় তার জান-মাল নিরাপদ থাকবে (দ্র. আত-তওবা, ৯/৬; বুখারী, হা/৩১৭৯; মুসলিম, হা/১৩৭১)। (৬) কাফেরদের প্রতি ইনছাফ করা ওয়াজিব, যদিও তা মুসলিমদের বিপক্ষে হয় (আল-মায়েদা, ৫/৮; আহমাদ, হা/১৪৯৫৩, সনদ শক্তিশালী)। (৭) সাধারণ কাফের জনগোষ্ঠীর সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে (আল-মুমতাহিনা, ৬০/৮)। (৮) কাফেরদের দেবতাদের ভাঙচুর তো দূরের কথা, গালি দিতেও মহান আল্লাহ নিষেধ করেছেন, অন্যথা তারাও আল্লাহকে গালি দিবে (আল-আনআম, ৬/১০৮)।
এক্ষণে আমাদেরকে যা করতে হবে : (১) উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতিতে আবেগতাড়িত ও অপরিণামদর্শী হয়ে তাড়াহুড়ো করে এমন কোনো কর্মকাণ্ড করা যাবে না, যা হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। যেখানে বিনা জ্ঞানে আল্লাহকে গালি দিতে পারে বলে মুশরিকদের গালি দিতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে আমাদের পদক্ষেপ কত সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত হতে হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অযথা নিরপরাধ জনগণ ও তাদের বাড়ি-ঘর, মালামালের উপর হামলা করা যাবে না। (২) নিন্দা ও প্রতিবাদের শরীআতসমর্থিত যে কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অনলাইন-অফলাইন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে। বড় বড় আলেম-উলামাকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। (৩) মুসলিমদেরকেই আগে পবিত্র কুরআনের সম্মান দেওয়া শিখতে হবে। আর তা হবে কুরআন শেখা, শেখানো ও সার্বিক জীবনে এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে। (৪) অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের প্রতি ইসলামের উদারতা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সকলের নিকট তুলে ধরতে হবে। (৫) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হিফযুল কুরআনের জন্য ও ব্যাপকহারে কুরআন প্রিন্ট ও বিতরণের জন্য ওয়াক্বফ গড়ে তুলতে হবে। (৬) পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ অনুবাদ প্রকাশ করে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝে তা বিনামূল্যে বিতরণের কর্মসূচি হাতে নিতে হবে, যাতে কুরআন মাজীদের শান্তির বার্তা তাদের নিকট স্পষ্ট হয়। (৭) একদল গবেষক তৈরি করতে হবে, যারা অবমাননাকারীদের তাত্ত্বিক ও যৌক্তিক জবাব দিতে পারবেন। (৮) যে কোনো জাতি ও গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা থেকে সতর্ক থাকতে হবে, সেই ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ যেমনই হোক না কেন। ববং তাদেরকে দলীল-প্রমাণ ও উত্তম নছীহতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট তাদের ধর্মের অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বুঝাতে হবে। (৯) মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে কুরআন অবমাননার বিষয়টিকে তাদের বড় ইস্যুগুলোর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং অবমাননাকারীদের ব্যাপারে আইন করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। (১০) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনের কাছে সকল জাতি ও গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া নিষিদ্ধ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য জোর দাবি জানাতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে দেশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার ও দ্বীন পালনের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!