اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
গত ৪ এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে বঙ্গবাজার মার্কেটের আড়াই হাজারসহ আশপাশের মার্কেটের প্রায় ৫ হাজার দোকান আগুনে পুড়ে যায়, যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো, যারা সবাই দোকানে ঈদের আগে নতুন পণ্য তুলেছিলেন। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ মোট ১২ জন আহত হয় এবং আল্লাহর রহমতে কোনো নিহতের ঘটনা না ঘটলেও অগ্নিকাণ্ডে প্রতিবছর বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। বিগত ১০ বছরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৫৯০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিমান বাহিনী, সেনা, নৌ ও বিজিবির ফায়ার ফাইটার টিম এবং ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা প্রচেষ্টার পর বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। উল্লেখ্য, বঙ্গবাজারে আগুন এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার আগুন লেগেছে এই মার্কেটে। গত কয়েকবছরে একাধিকবার আগুনের ঘটনা ঘটার পর সতর্কতা নোটিশ দেওয়া হলেও তাতে ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি।
দেশে প্রতিবছর ছোট-বড় ২০ হাজারের উপরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান মতে, ২০২২ সালে ২৪,১০২টি, ২০২১ সালে ২১,৬০১টি, ২০২০ সালে ২১,০৭৩টি, ২০১৯ সালে ২৪,০৭৪টি এবং ২০১৮ সালে ১৯,৬৪২টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ২০০০ সালে ঢাকার চৌধুরী নিট ওয়্যারে আগুন, ২০০১ সালে মিরপুরের ম্যাক্রো সোয়েটারে আগুন, ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের শান নিটিং অ্যান্ড প্রসেসিং লিমিটেডে আগুন, ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে কে.টি.এস টেক্সটাইল মিলে আগুন, ২০১০ সালে গাজীপুরের গারিব এন্ড গারিব সোয়েটার ফ্যাক্টরীতে আগুন, একই বছর আশুলিয়ার হামীম গ্রুপের দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যারে আগুন, ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে আগুন, ২০১৬ সালে টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ, ২০১৭ সালে গাজীপুরের মাল্টিফ্যাবস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে আগুন, ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ— এগুলো বিগত কয়েক বছরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। অগ্নিকাণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ ঘটনা ঘটেছে আবাসস্থলে। শিল্প কারখানা এবং পোশাক কারখানায়ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কম ঘটেনি। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে।
নানা কারণে দেশে অগ্নিদুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১. বৈদ্যুতিক গোলযোগ। একারণে অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে। ২. চুলার আগুন। ৩. জ্বলন্ত বিড়ি-সিগারেট। ৪. ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা। ৫. গ্যাস লাইন। ৬. অসচেতনতা এবং অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি অনীহা। ৭. উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি। ৮. এছাড়া অজ্ঞাত কারণেও কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটে।
কোথাও বড় ধরনের আগুন লাগলে তা নিভাতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ (ক) চাহিদার তুলনায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের লোকবল নিতান্তই কম। (খ) অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির মারাত্মক অভাব। (গ) অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঘিঞ্জি পরিবেশে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও সরঞ্জাজ প্রবেশে বিঘ্ন সৃষ্টি। (ঘ) পানির অপর্যাপ্ততা।
এক্ষণে আমরা বলতে চাই, (১) যে কোনো বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করা শিখতে হবে। (২) সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। (৩) সবক্ষেত্রে নিজস্ব প্রতিরোধব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে অগ্নিকাণ্ডের সময় অন্তত কয়েক মিনিট প্রতিরোধ করা যায়। (৪) অগ্নিদুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। (৫) ফায়ার সার্ভিসের লোকবল বাড়াতে হবে এবং তাদের আরো বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। (৬) ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। (৭) পরিকল্পিত নগরায়ন ও আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (৮) বড় বড় বিল্ডিং, মার্কেট, শপিংমল, অফিস, হাসপাতাল, শিল্পনগরী, আবাসিক এলাকা ইত্যাদিতে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ (Fire hydrant) সিস্টেম বসাতে হবে। (৯) শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণ জলাশয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে, বিপদে যেখান থেকে পানি নেওয়া যাবে। (১০) মানসম্মত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে এবং নিয়মিতভাবে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পর্যবেক্ষণ করে পরিবর্তন করতে হবে। (১১) জরুরী নির্গমনের পথগুলো এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে সেগুলো কোনোভাবেই অবরুদ্ধ না থাকে। (১২) জরুরী নির্গমনের দরজাগুলো বিশেষভাবে চিহ্নিত থাকতে হবে এবং সহজে সেখানে যাওয়ার সরাসরি রাস্তা রাখতে হবে। (১৩) দোষীদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় বিপদাপদ থেকে হেফাযতে রাখুন। আমীন!