اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
দেশে যে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট চলছে, তা লিখে পাঠককে বুঝানোর দরকার নেই। কারণ সকলেই ভুক্তভোগী। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। সরকারের হিসাব মতে, সারাদেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, উৎপাদন হচ্ছে তার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ কম, যা লোডশেডিং-এর মাধ্যমে সমন্বয় করতে হচ্ছে। ফলে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ছে। দীর্ঘ লোডশেডিংয়ের কারণে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ, বৃদ্ধ ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। শিল্প, কৃষি, ব্যবসায় সর্বক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কল-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হলে বিদেশে পণ্য রপ্তানি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে সেচপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চলতি আউশ মৌসুমের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও এর বিরূপ প্রভাব সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। কারণ বিদ্যুৎবিভ্রাটে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। এককথায় বিদ্যুতের অভাবে চারিদিকে হাহাকার ও স্থবিরতা বিরাজ করছে।
গ্যাস স্বল্পতার কারণেই মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানির উচ্চমূল্য অন্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। ফলে এ যুদ্ধের প্রভাবে অন্য অনেক দেশের মতো বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশও। আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুতের অন্যতম কাঁচামাল এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় আমদানি একদমই কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা প্রায় বন্ধ করা হচ্ছে। ফলে তীব্র জ্বালানি সংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারছে না। গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আগে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হলে তেল বা কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানো হতো। কিন্তু গ্যাসের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যও বৃদ্ধির কারণে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এ সংকটের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসলেও রেন্টাল ও কুইক রেন্টালকেও দুষছেন অনেক বিশেষজ্ঞই। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। দৈনিক চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। এই বিদ্যুৎ চাহিদা স্থায়ী কেন্দ্রের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব। তাহলে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হবে, সে প্রশ্ন অনেকেরই। তাছাড়া ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। একটি সূত্র মতে, ‘দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। দৈনিক চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। এই বিদ্যুৎ চাহিদা স্থায়ী কেন্দ্রের মাধ্যমে মেটানো যাচ্ছে। তারপরও তিন বছরের চুক্তিতে আনা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না। স্বল্প মেয়াদের কথা বলে এক যুগ ধরে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে বাড়তি দামে। বিদ্যুৎ না নিলেও এসব কেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে’ (মানবজমিন, ২২ জুলাই)। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং তা কখনই স্থায়ী সমাধান নয়।
এক্ষণে, (১) সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন ও মিতব্যয়ী হতে হবে। দরকারের বাইরে সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎও কোথাও খরচ করা যাবে না। বিদ্যুৎ স্টোর করে রাখার মতো কোনো ভোগ্যপণ্য নয়। বরং চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করতে হয়। ফলে উৎপাদন কম হলে লোডশেডিং অপরিহার্য। সেজন্য কারো বিলাসিতা ও অপচয় অন্যের দুর্ভোগের কারণ। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও অপচয় রোধ করা গেলে জনদুর্ভোগকে কিছুটা সহনীয় মাত্রায় রাখা যাবে। এক্ষেত্রে অপচয়ও ইসলামনিষিদ্ধ অপচয়ের আওতায় পড়বে। (২) সর্বপ্রকার আলোকসজ্জা বন্ধ রাখতে হবে। নৈশকালীন প্রোগ্রামগুলো, যেখানে প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যয় হয়, দিনে করতে হবে। বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান সন্ধ্যার আগেই শেষ করতে হবে। (৩) বিদ্যুৎখাতের যাবতীয় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে পাওয়া অবৈধ লাইনগুলো বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং সিস্টেম লস সর্বোচ্চ কমিয়ে আনার উপর জোর দিতে হবে। (৪) দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করতে হবে। কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র বিকল্প হতে পারে । অবশ্য এক্ষেত্রে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশবাসীকে আশার আলো দেখাচ্ছে। (৫) নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, বিশেষ করে সমুদ্র এলাকায়। ফলে বাপেক্সকে আরো শক্তিশালী করে অনুসন্ধান কাজে জোর দিতে হবে। (৬) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও এর ব্যবহার বাড়াতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। (৭) এনার্জি সেভিংস বাল্ব ব্যবহারে জনগণকে আগ্রহী করে তুলতে হবে এবং স্বল্প মূল্যে সাধারণ জনতার দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
মহান আল্লাহ দ্রুত সমস্যা কাটিয়ে আমাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনুন। আমীন!