اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
দীর্ঘ দুই বছর যাবৎ গাযা ও ইসরাঈলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সাময়িক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। ৯ অক্টোবর সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টের মাধ্যমে ট্রাম্প জানান তার প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তির প্রথম ধাপে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। ১০ অক্টোবর সকালে ইসরাঈল তার মন্ত্রিসভায় এটিকে অনুমোদন দেয়। সেই দিনই দুপুর ১২টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। উক্ত যুদ্ধবিরতিকে সকল পক্ষ নিজ নিজ বিজয় হিসেবে দাবি করছে। যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতায় মুসলিম দেশগুলোর মধ্য থেকে তুরস্ক, মিশর, কাতার ও সঊদী আরব মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। উক্ত যুদ্ধবিরতির পূর্বে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব তুলে ধরেন। তার সেই শান্তি প্রস্তাবকে সামনে রেখেই যুদ্ধবিরতির আলোচনা নতুন করে শুরু হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থাপিত সেই শান্তি প্রস্তাবের যে প্রথম ধাপে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে তা হচ্ছে, ইসরাঈল তার বাহিনীকে গাযার শহর ও আবাসিক এলাকাগুলো থেকে একটি নির্দিষ্ট এরিয়ায় সরিয়ে নিবে। রাফাহ সীমান্ত দিয়ে সকল ধরনের ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিবে। উভয়পক্ষ তাদের কাছে থাকা বন্দিদের মুক্তি দিবে। উক্ত প্রস্তাবের দ্বিতীয় ধাপের যে বিষয়গুলো এখনো অমীমাংসিত রয়েছে তা হচ্ছে, গাযার শাসনব্যবস্থা ও হামাসের নিরস্ত্রীকরণ। আমেরিকার শান্তি প্রস্তাব অনুযায়ী হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে। গাযার দায়িত্ব নিবে আন্তর্জাতিক তৃতীয় কোনো পক্ষ। হামাসের দাবি হচ্ছে গাযার দায়িত্ব পালন করবে ফিলিস্তীনি কর্তৃপক্ষ। এই বিষয়টি এখনো আলোচনার টেবিলে রয়েছে; চূড়ান্ত কোনো মীমাংসা হয়নি।
আর এই কারণেই সুদীর্ঘ এই যুদ্ধের প্রাথমিক যুদ্ধবিরতির পরও উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপাক অবিশ্বাস, আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। বিশেষত, এই দুই বছরে আসলে কাদের বিজয় হয়েছে—সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল বিতর্ক। একদল বিশ্লেষকের মতে, এটি ইসরাঈলের বিজয়। কেননা সে তার যুদ্ধবন্দিদেরকে উদ্ধার করতে পারছে। উদ্ধার শেষ হলে পুনরায় গাযা দখল করা তার কাছে কিছুই নয়। কেননা গাযা এখন সম্পূর্ণরূপে বিরানভূমি ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে আছে। এই সমতল ভূমিতে পুনরায় দখল প্রতিষ্ঠা করা ইসরাঈলের কয়েক সেকেন্ডের সিদ্ধান্ত মাত্র। সেহেতু বর্তমান যুদ্ধবিরতি মূলত ইসরাঈলী যুদ্ধবন্দিদের উদ্ধারে ইসরাঈলের একটি কৌশল মাত্র। কেননা ইতোমধ্যে গাযায় ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে ইসরাঈল প্রমাণ করে দিয়েছে—সে দুনিয়ার কোনো আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না। এমনকি চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলা অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম ট্রুথে ইসরাঈলকে গাযায় হামলা বন্ধের ইমিডিয়েট নির্দেশ দেওয়ার পরও ইসরাঈল হামলা চলমান রেখেছিল। সুতরাং ইসরাঈল আমেরিকার আদেশ মেনে নিবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শুধু তাই নয়, গত দুই বছরে ইসরাঈল শুধু গাযায় হামলা চালায়নি; বরং সিরিয়া, কাতার, লেবানন, ইয়ামান ও ইরানসহ বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়েছে। যা প্রমাণ করে, তার কাছে আরব বিশ্বের কোনো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ন্যূনতম মূল্য নেই।
অন্যদিকে আরেকদল বিশ্লেষক মনে করছেন, উক্ত যুদ্ধবিরতি হামাসের এক প্রকার বিজয়। কেননা ইসরাঈল যখন যুদ্ধ শুরু করে তখন তার দাবি ছিল—সে কখনোই সন্ত্রাসীদের সাথে আলোচনায় বসবে না। সে শক্তির জোরে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করেই তার যুদ্ধবন্দিদের উদ্ধার করবে। এই দাবির ভিত্তিতেই সে গাযাকে সম্পূর্ণরূপে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ সমতল ভূমিতে পরিণত করেছে। গাযার বুকে আর কোনো বিল্ডিং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নেই। বিশ্ববিদ্যায়ল, স্কুল ও হাসপাতাল থেকে শুরু করে সব ধ্বংস করা হয়েছে। ৬৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার পাওয়ার আমেরিকার সহযোগিতা নিয়ে ইসরাঈলের দুই বছর যাবৎ নৃশংস হামলা চালানোর পরও, সম্পূর্ণ গাযাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পরও, ইসরাঈল তার শক্তির জোরে তার যুদ্ধবন্দিদের উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে। এটি ইসরাঈলের চরম পরাজয়। যাদেরকে সন্ত্রাসী ঘোষণা দিয়ে তাদের সাথে কোনোরকম আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তাদের সাথে আলেচনায় বসেই চুক্তি করেই তাকে যুদ্ধবন্দি উদ্ধার করতে হচ্ছে। এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কী হতে পারে? সেক্ষেত্রে এই যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়া ছাড়া কোনো অর্জন হতো বলে মনে হয় না। শুধু গত দুই বছরে প্রায় ১২০০ ইসরাঈলী সৈন্য নিহত হয়েছে। প্রায় ২০ হাজার সৈন্য শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। যা ইসরাঈল সৃষ্টির পর থেকে সর্বোচ্চ। গত দুই বছরে ইসরাঈলের আনুমানিক খরচ প্রায় ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া সামগ্রিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ সীমাহীন।
জয়-পরাজয় নিয়ে বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ যাই হোক না কেন, সকলেই এই বিষয়ে একমত যে, বর্তমান যুদ্ধের সময় মিডিয়া জগতে ইসরাঈলের একক কোনো আধিপত্য না থাকায়, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপেন প্লাটফর্মের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ইসরাঈলের প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভ ভেঙে পড়েছে। আমেরিকা ও ইউরোপের জনগণ গাযার মানুষের অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে। কলম্বিয়াসহ বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। এককথায় গাযার পক্ষে সমগ্র বিশ্বে এক নতুন আলোড়ন তৈরি হয়েছে। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল সুমুদ ফ্লোটিলার নৌবহর। গত কয়েক শতব্দী যাবৎ মিডিয়ার পেছনে ইসরাঈল যত অর্থ বিনিয়োগ করেছে, তার সকল পরিশ্রম ও ইনভেস্ট এই যুদ্ধে মাটির সাথে মিশে গেছে। যা ইসরাঈলের বিশাল ব্যর্থতা।
পরিশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবে— দুনিয়াবী সক্ষমতা কখনোই জয়-পরাজয়ের মানদণ্ড নয়। বর্তমান গাযার মানুষ ও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো ইসরাঈল ও আমেরিকার কাছে যত অসহায়, ফেরাউনের শক্তির কাছে মূসা আলাইহিস সালাম তার চেয়ে শতগুণ অসহায় ছিলেন। মূসা আলাইহিস সালাম বিজয় অর্জন করেছিলেন গায়েবী মদদে। মহান আল্লাহর শক্তি-সামর্থ্যের উপর যেন মূসা আলাইহিস সালাম-এর অগাধ আস্থা তৈরি হয়, তার অন্যতম একটি মাধ্যম ছিল লাঠিকে সাপে পরিণত করার মু‘জিযা। যার মাধ্যমে মূসা আলাইহিস সালাম জানতেন মহান আল্লাহ যেকোনো কিছু করতে পারেন। আল্লাহর শক্তির উপর এই অগাধ অস্থাই মূসা আলাইহিস সালাম-কে তার আদর্শে অটল থাকতে সাহায্য করেছিল। যুগে যুগে মুসলিমরা কখনোই দুনিয়াবী শক্তির উপর ভরসা করে বিজয় লাভ করেনি; বরং সবসময় মহান আল্লাহর অদৃশ্য গায়েবী শক্তির সহযোগিতায় জয়লাভ করেছে। এমনকি স্বয়ং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় মহান আল্লাহ বদর, উহুদ ও খন্দকসহ বিভিন্ন যুদ্ধে ফেরেশতা অবতীর্ণ করে সহযোগিতা করেছেন। এই জন্য মুসলিমদের সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার সাথে পরিচিত হওয়া। কুরআনের শিক্ষার মাধ্যমে সেই জ্ঞান অর্জন করা। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামাআতে আদায়, রাতের ছালাত ও সকাল-সন্ধ্যার যিকিরের মাধ্যমে মহান আল্লাহর গায়েবী মদদ অর্জন করা। নিজ আদর্শের উপর অটল থাকা। ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যবাদিতার চর্চার মাধ্যমে প্রকৃত নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো। যেকোনো জাতির মধ্যে এই বিষয়গুলোর সংমিশ্রণ ঘটলে তারা দুনিয়াবী যত দুর্বলই হোক না কেন, মহান আল্লাহর সহযোগিতায় বিজয় তাদের পদচুম্বন করবে ইনশাআল্লাহ। (প্র. স.)
