اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
ইরান ও ইসরাঈলের দ্বন্দ্ব গত কয়েক দশক ধরে কেবল মৌখিক হুমকি-ধমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কখনও-সখনও কিছু টুকটাক হামলা-পাল্টা হামলা হলেও, তা ছিল অভ্যন্তরীণ সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত। ফলে অনেকেই ইরান-ইসরাঈল যুদ্ধকে অলীক কল্পনা হিসেবে বিবেচনা করতেন। এমনকি কেউ কেউ তাদেরকে পরস্পরের গোপন মিত্র বলেও মনে করতেন। সেইসব ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে, ১৩ জুন ২০২৫ তারিখে, ইসরাঈলি সময় ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে, ইসরাঈল এক ভয়াবহ গোয়েন্দা, ড্রোন ও বিমান হামলার সম্মিলিত অভিযান চালায় ইরানের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যবস্তুর ওপর। এই হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মুহাম্মাদ বাঘেরি, আইজিআরসি প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি এবং পদার্থবিজ্ঞানী মুহাম্মাদ মেহদি তেহরাঞ্চিসহ প্রায় এক ডজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন।
ইরানও পাল্টা মিসাইল হামলা শুরু করেছে। তারা তেল আবিব, হাইফাসহ বিভিন্ন শহরের দিকে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে। ইসরাঈলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইরান যেকোনো সময় হরমুজ প্রণালি বন্ধ ঘোষণা করতে পারে। পারস্য উপসাগর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ থেকে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানি ও রপ্তানির প্রধান রুট এই প্রণালি। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, অন্যান্য পরাশক্তিও এতে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে আমাদের একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। খামেনি নেতৃত্বাধীন তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের পূর্বে ইরানের শাসনক্ষমতায় ছিল রেজা শাহ পাহলভিরা। তাদের সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং সে কারণে ইরান কখনোই ইসরাঈলের জন্য হুমকি ছিল না। ইরান ও ইসরাঈলের মধ্যে মুখোমুখি শত্রুতা শুরু হয় ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে।
পারস্যরা যেমন কট্টর শীআ মতবাদের অনুসারী, তেমনি ইসরাঈলি ইয়াহূদীরাও কট্টর ধর্মীয় বিশ্বাসে দৃঢ়। ইসরাঈলের যেমন মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে, ইরানেরও রয়েছে তেমনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্ন। ইসরাঈল ও আমেরিকার যেমন নিজস্ব বিশ্বব্যবস্থা (world order) রয়েছে, ইরানও তেমনি নিজস্ব এক বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। উভয় দেশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক প্রায় নাই বললেই চলে। বিশেষ করে ইরানের শীআ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সুন্নী রাষ্ট্রগুলো সবসময় সন্দেহের চোখে দেখে এবং সেই সন্দেহের পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও রয়েছে।
ইরান বহু সুন্নী দেশে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যেমন ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেনকে দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়েছিল। পরবর্তীতে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের সময়ও ইরান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছিল। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শীআ শাসন রক্ষায় কাসেম সোলাইমানির নেতৃত্বে বহু সুন্নী মুজাহিদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। হুথি শীআ বিদ্রোহীদের সঊদী আরবের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিয়ে সঊদীকে বিপদে ফেলা হয়েছে। বাহরাইনে একাধিকবার ক্যু-এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড ইরানের উচ্চাকাঙ্ক্ষারই প্রমাণ।
অন্যদিকে আমেরিকা ও ইসরাঈলের নিজস্ব বিশ্বব্যবস্থা আছে, যেখানে তাদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন কোনো শক্তিকে তারা সহ্য করে না। তাদের কাছে শীআ, সুন্নী, খ্রিষ্টান—এই পরিচয়গুলো গৌণ। অতীতে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানোর জন্য পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে মুজাহিদদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। পরে যখন সেই মুজাহিদরা স্বাধীন হয়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, তখন তাদেরকেও আমেরিকা নিজের বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকি মনে করে। একইভাবে, রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে রেখে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। একই পরিকল্পনায় ধীরে ধীরে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তারা এসব অঞ্চল থেকে অবাধে তেল উত্তোলন করছে। কাতার থেকে ইউরোপে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে, যার ফলে ইউরোপের গ্যাস নির্ভরতা রাশিয়ার ওপর থেকে সরে যাবে। যদি এই রুটে তুরস্ক কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তাকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।
চীনের সঙ্গেও আমেরিকার একটি প্রযুক্তিকেন্দ্রিক ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। প্রযুক্তিগত আধিপত্য বজায় রাখতে আমেরিকা সেন্সিটিভ কিছু প্রযুক্তি নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। যখনই কোনো দেশ প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখায়, তখন আমেরিকা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এর মধ্যে রয়েছে: পারমাণবিক প্রযুক্তি (Nuclear Technology), উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ডিফেন্স প্রযুক্তি (Missile & Defense Systems), AI ও সাইবার-ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি, Stealth Technology (রাডার এভয়েডিং প্রযুক্তি), জিন প্রকৌশল ও বায়োটেকনোলজি (Advanced Biotech), সেমিকন্ডাক্টর ও চিপ তৈরির মূল প্রযুক্তি, Hypersonic এবং Directed Energy Weapons (Laser & Microwave অস্ত্র) ইত্যাদি।
ইরান, রাশিয়া ও চীন এ সকল প্রযুক্তি অর্জনে সচেষ্ট এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলও। ইরানের বিরুদ্ধে হামলার মূল কারণ ছিল এই অভিযোগ—তারা পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্স প্ল্যাটফর্মে ঘোষণা দেন, আমেরিকা ইরানকে ৬০ দিন সময় দিয়েছিল একটি পারমাণবিক চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য। যারা এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিল, তাদের ‘সরিয়ে দেওয়া’ হয়েছে। যদি ইরান চুক্তিতে না আসে, তাহলে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবহার করে ইরানকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে। এই আলোচনায় ওমান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছিল। তবে ইসরাঈল চাচ্ছিল না যে, ইরানের সঙ্গে কোনো শান্তি আলোচনা হোক।
ইরান, তার সব প্রক্সি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায়, সম্প্রতি সঊদী আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছিল। ইসরাঈল এটাও মেনে নিতে পারছিল না। পাশাপাশি, সিরিয়ায় ইরানের পরাজয়, লেবাননে হিজবুল্লাহর দুর্বলতা এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার ব্যস্ততায়—ইরান ইতিহাসের এক অত্যন্ত দুর্বল মুহূর্তে রয়েছে। এই সুযোগ ইসরাঈল হাতছাড়া করতে চায়নি। ইরানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো—তার অভ্যন্তরে এমন অনেক গোষ্ঠী রয়েছে, যারা মোসাদের হয়ে কাজ করে। সেই গোয়েন্দাদের মাধ্যমে ইরানের অভ্যন্তরে ড্রোন পাঠিয়ে সেখান থেকেই হামলা পরিচালিত হয়েছে। এটি মোসাদের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গোয়েন্দা হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যদি ইসরাঈল ইরানকে সফলভাবে পরাস্ত করতে পারে এবং সেখানে একটি পুতুল সরকার বসাতে পারে, তবে পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে তুরস্ক। এভাবেই তারা মুসলিম বিশ্বের কোনো শক্তিশালী দেশকে টিকিয়ে রাখতে চায় না। একসময় ‘গ্রেটার ইসরাঈল’ প্রতিষ্ঠা করে মসজিদে আক্বছা ধ্বংস করে ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মাণ করবে। আমরা চাইলে এই সংঘাতকে রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আধিপত্যের যুদ্ধ।
ইসরাঈল তার ইরানবিরোধী সামরিক অভিযানের নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এই নামটি হিব্রু বাইবেলের ‘বুক অব নাম্বারস’ (২৩:২৪) থেকে নেওয়া, যেখানে বলা হয়েছে— ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না’। নেতানিয়াহু এই নাম ঘোষণার আগে মসজিদে আক্বছার ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’-এর একটি ফাটলে একটি চিরকুট রেখে আসেন, যাতে লেখা ছিল— ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে’। সেই চিত্র সংবাদমাধ্যমে প্রকাশও করা হয়।
ইসরাঈল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেল থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। যেমন- ‘অ্যারো অব বাশান’, ‘আমালেক’-এর কাহিনি কিংবা ‘বুক অব ডিউটেরনমি’-এর উদ্ধৃতি। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বাইবেলের ‘বুক অব ডিউটেরনমি’ (২৫:১৭) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি’। এই কাহিনির মাধ্যমে নেতানিয়াহু একটি সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন করার ইঙ্গিত দেন। এমনকি ইসরাঈলের অস্ত্র ও প্রযুক্তির নামকরণও ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে নেওয়া— যেমন: ‘ল্যাভেন্ডার’, ‘দ্য গসপেল’, ‘জেরিকো মিসাইল’, ‘ডেভিড’স স্লিং’।
দুঃখজনক হলেও সত্য, যখন ইসরাঈলের ইয়াহূদীরা এবং ভারতের হিন্দুরা কট্টর ধর্মীয় চেতনায় বলীয়ান, তখন মুসলিমরা প্রতিযোগিতা করছে কে কত বড় সেক্যুলার হতে পারে তা প্রমাণ করতে। দীর্ঘ ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক গোলামি মুসলিমদের আত্মমর্যাদা, চেতনা ও দ্বীনী চরিত্রকে এমনভাবে বিনষ্ট করেছে যে, তারা দুনিয়ার মোহে নিজেদের সবকিছু বিকিয়ে দিতে দ্বিধা করে না।
হ্যাঁ, মুসলিমরা সামরিক শক্তিতে আমেরিকা ও ইসরাঈলের তুলনায় দুর্বল; কিন্তু আল্লাহর শক্তি সবার ওপরে। আদ জাতির ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ বলেন,﴿فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً﴾ ‘আর আদ জাতি পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করেছিল এবং বলেছিল, “আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী আর কে আছে?” তারা কি জানে না, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের চেয়েও অধিক শক্তিধর?’ (ফুছছিলাত, ৪১/১৫)।
ফেরাউন যেভাবে মহান আল্লাহর অলৌকিক শক্তির সামনে পরাজিত হয়েছিল, আজকের যুগের ফেরাউনরাও আল্লাহর শক্তির সামনেই পরাজিত হবে। তবে তার পূর্বে মূসা আলাইহিস সালাম -এর মতো ঈমান, আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা ও ইখলাছের সাথে নিরন্তর চেষ্টা লাগবে। মুসলিমরা যেদিন তাদের সর্বোচ্চটা করবে, সেদিন আসমান থেকে আল্লাহর অলৌকিক শক্তি নেমে আসবে। সেই অলৌকিক শক্তিতেই এই ফেরাউনদের ধ্বংস হবে ইনশা-আল্লাহ। মুসলিমদের জরুরী ভিত্তিতে কলোনিয়াল মাইন্ডসেট থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজ দ্বীন নিয়ে হীনম্মন্যতা থেকে বেরিয়ে আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান ব্যক্তিত্ব গঠনে মনোযোগী হতে হবে, যাতে তাদের মধ্যে দুর্নীতি, মিথ্যা ও প্রতারণার মতো গোলামির স্বভাবগুলো না থাকে। এরপর জ্ঞানের জগতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, সর্বোচ্চ প্রোডাক্টিভ হতে হবে। আল্লাহর পতাকাকে উচ্চ করার জন্য দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে হবে। সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সর্বোচ্চ চেষ্টা যেদিন একত্রিত হবে, ইনশা-আল্লাহ বিজয় আসবেই। (প্র. স.)