কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এর বাস্তবতা

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

মানুষের প্রতিভা, কর্মদক্ষতা, গুণাবলি বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যম হলো শিক্ষা। তার আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। নান্দনিক ও আনন্দময় জীবনের পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তার অর্থপূর্ণ অবস্থান প্রয়োজন। আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা অর্জন করে উপার্জনক্ষম, সৃজনশীল ও আদর্শবান নাগরিক হওয়া তার দরকার। যেকোনো প্রেক্ষাপটে নিজেকে অভিযোজিত করা ব্যতীত তার পক্ষে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।

উন্নত বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে মানবিক গুণাবলি বিকাশের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভূমিকা থাকে। ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়কে সামনে রেখে এ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর জীবনকে আনন্দঘন করা, তাদেরকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতিযোগিতায় টেকসই করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত ও উৎপাদনমুখী করা, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের মাধ্যমে গভীর শিখন নিশ্চিত করা, পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনে সক্ষম করা এবং সমাজ ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো।

নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতার আলোকে পাঠদান আর যোগ্যতাকে মূল্যায়নের ভিত্তি ধরা হয়েছে। এতে ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন আর ৬০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একেক শিক্ষার্থীর মাঝে একেক গুণ লুক্কায়িত আছে। সাফল্য নির্দেশিকার সাহায্যে তার যোগাযোগ, ভাষা, সক্রিয় অংশগ্রহণ, সংগঠন ও সিদ্ধান্তগ্রহণ দক্ষতা এবং আচরণিক নির্দেশিকার সাহায্যে তার সততা, সাহস, সহনশীলতা, দায়িত্বশীলতা, জেন্ডার সচেতনতার মাত্রা রেকর্ড করার সুযোগ এ শিক্ষাক্রমে রাখা হয়েছে। সামষ্টিক ও শিখনকালীন মূল্যায়নের সমন্বয়ে ট্রান্সক্রিপ্ট দিয়ে তার শিখন অগ্রগতি যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে; যাতে প্রতিটি শ্রেণি শেষে শিক্ষার্থীর সবল ও দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

এমন শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত পারদর্শিতায় প্রাপ্ত সনদে জীবন-জীবিকার সুযোগ পাবে। যোগ্যতা অনুযায়ী পড়াশুনার নির্দিষ্ট স্তরে সে নিজেকে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত করতে পারবে, যা তার জীবিকার ক্ষেত্র তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। জীবন ও জীবিকাঘনিষ্ঠ শিক্ষা ও যোগ্যতা অর্জন করে সে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো যোগ্য নাগরিক হবে।

একাডেমিকের পাশাপাশি নৈতিক আচরণ চর্চার ব্যবস্থা এই শিক্ষাক্রমে আছে, যেটা পূর্ববর্তী শিক্ষাক্রমে সেভাবে ছিল না। একজন শিক্ষার্থীকে সৎ, উদ্যমী, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক হতে অনুপ্রাণিত করা, অন্যের মতামত ও অবস্থানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে উৎসাহিত করা, দেশ ও জাতি গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে আগ্রহী করা ইত্যাদি সবই রয়েছে এই শিক্ষাক্রমে। ফলে সামগ্রিক বিবেচনায় সে সবার জন্য যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ ছাড়া সে যেমন নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে পারে, তেমন গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ তৈরিতে বিশ্ব নাগরিকের ভূমিকা পালন করবে।

উল্লিখিত আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান শিক্ষাক্রম অত্যন্ত মানসম্মত। শিক্ষাক্রম সংস্করণে সরকারের পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী।

আপাতদৃষ্টিতে সরকারের এ পদক্ষেপ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনে হলেও শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষা গবেষক, অভিভাবকের একটি শ্রেণি হঠাৎ একটি নতুন শিক্ষাক্রম একটি জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়াকে অযৌক্তিক মনে করেন। পরিবেশ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন না ঘটিয়ে এমন উচ্চাভিলাষী শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব? শিক্ষার্থীর কাঁধ থেকে বোঝা কমানোর কথা বলে পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া, ক্লাসের পাঠ ক্লাসেই শেষ করার কথা বলে হোমওয়ার্ক উঠিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কতটা যৌক্তিক?

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এ শিক্ষাক্রমে উল্লেখ করার মতো অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। পাঠদান পদ্ধতি, প্রস্তুতি বা কর্মসম্পাদনমূলক যা আগের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টসাধ্য বাপার। নিত্যনতুন চিন্তা ও বাস্তবতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা সময়, শ্রম ও ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়। পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ বা চাপ না থাকায় শিক্ষার্থীর মধ্যে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের প্রতি আসক্তি এবং হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। এ শিক্ষাক্রম ভালোভাবে রপ্ত করা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবার জন্যই কষ্টকর ব্যাপার। জ্ঞান আহরণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পাঠদান প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণটাই অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার পুরোটাই বা অধিকাংশ ধারাবাহিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যৌক্তিক নয়। কারণ, জ্ঞান আহরণের প্রতি শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে সামষ্টিক মূল্যায়নের প্রভাবকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নাই।

নতুন কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবকরা চরম উদ্বিগ্ন। এ শিক্ষাক্রম সম্পর্কে তারা শঙ্কিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর তাঞ্জিম উদ্দিন খান কর্তৃক নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে আয়োজিত আলোচনার ভেন্যুর বুকিং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাতিল করা হয়েছে মর্মে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আব্দুল বাসির জানান (ডেইলি স্টার বাংলা, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩); অথচ ১৯৭৩ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা অধ্যাদেশ’ ৭৩ এ মত প্রকাশের ব্যাপক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এনসিটিবি সচিব নাসিমা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে শিক্ষাক্রম নিয়ে অপপ্রচার চালালে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে (দৈনিক প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩)। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারসম্বলিত কনটেন্ট আপলোড, কমেন্ট ও শেয়ার করতে নিষেধ করা হয়েছে (জাগো নিউজ-২৪, ২৮ নভেম্বর, ২০২৩)। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগে চারজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে (জাগো নিউজ-২৪, ২৮ নভেম্বর-২০২৩)। এ সমস্ত ঘটনা প্রমাণ করে সরকার এই শিক্ষাক্রমের ক্ষেত্রে নেতিবাচক কোনো সমালোচনা সহ্য করতে চায় না। এ কারণ এ শিক্ষাক্রমের নেতিবাচক ধারণা সাধারণ জনগণকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

এ ক্ষেত্রে সরকারের বক্তব্য হলো জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। এর উপযোগিতা ও বাস্তবতা যাচাই করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ২০২২ সালে ৬২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ শিক্ষাক্রম প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ লক্ষ করা গেছে। এজন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।

আমাদের দেশ ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন অতটা সহজ নয়। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোর উপর ভিত্তি করে এ শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীর জীবনঘনিষ্ট বা পরিস্থিতিভিত্তিক কাজের উপর নতুন শিক্ষাক্রমের সুফল নির্ভরশীল। উক্ত পরিবেশ বা পরিস্থিতির বাস্তবতা বা জনমুখিতা বিচার্যবিষয়। এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাকাঠামো যে জীবনধারা, আদর্শ ও চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে তার সাথে আমাদের দেশের জীবনমান, চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর ফারাক রয়েছে।

কার্যনির্ভর বা জীবনভিত্তিক শিক্ষাই যে কেবল মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে এমনটি নয়। তাকে যদি প্রকৃত শিক্ষিত হতে হয় তবে তার আদর্শ, বিশ্বাস ও চিন্তাভাবনা সবক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে জীবনভিত্তিক বা বাস্তবভিত্তিক বা এর থেকে উত্তম কোনো শিক্ষা তখনই কোনো জাতিকে শেখানো সম্ভব, যখন সে একে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করবে। এককথায় কোনো জাতির উপর একটি আদর্শ বা ভাবধারা চাপিয়ে দেওয়া তখনই সম্ভব যখন সে উক্ত আদর্শকে স্বেচ্ছায় ধারণ করে। একথা মনে রাখা দরকার যে, ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত দেশে সবাই ইসলামের আলোকে জীবনযাপন করে। তাদের উপর এমন কোনো সংস্কৃতি বা শিক্ষা পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, যা তাদেরকে ধর্মীয় আদর্শ ও পরকালীন চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষার কথা বলে তাদেরকে আদর্শহীন মানুষে পরিণত করার পরিণাম কখনোও ভালো হবে না। আল্লাহ আমাদের সকলের বোঝার তাওফীক্ব দিন- আমীন! (স.)

Magazine