اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
প্রতিবছর মে মাস আসলেই উঠে আসে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকারের কথা। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক শ্রমঘণ্টা ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে। হে মার্কেটের কাছে তাদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ১০/১২ শ্রমিক নিহত হয়। তাই ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশে ১ মে’কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালিত হচ্ছে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে। বাংলাদেশেও এ দিনে সরকারি ছুটি থাকে। কিন্তু তারপরও কি শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছে বা পাচ্ছে? আসলে এসব দিবসটিবস দিয়ে কিছুই হবে না; বরং উল্টো মে দিবস পালনের নামে একদিন শ্রমিকরা কাজ না করায় বিশ্বজুড়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া যে কোনো বিক্ষোভে ফেতনা-ফাসাদ ও জীবনের ক্ষতির আশঙ্কা তো রয়েছেই। যাহোক, আজও শ্রমিকের ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত, এখনও তাদের বিরাট অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত। সাথে শিশুশ্রমের ব্যাপারটা না হয় না-ই উঠালাম।
সত্যি বলতে পৃথিবীর কোনো ধর্ম, আইন, মন্ত্রতন্ত্র, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আন্দোলন-ধর্মঘট শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। কেবল ইসলামই নিশ্চিত করতে পেরেছে তাদের ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা। এমনকি মালিকের দিকটাও ইসলাম মোটেও উপেক্ষা করেনি। বরং উভয়ের প্রাপ্য ন্যায্য হিসসা বুঝিয়ে দেওয়ার ও নেওয়ার ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি শুধু ইসলামই দিতে পেরেছে। মালিকের কাজ আদায়ে যেন কোনো প্রকার ত্রুটি না হয় সেজন্য ইসলাম সামর্থ্যবান ও আমানতদার শ্রমিক নিযুক্ত করার প্রতি উৎসাহিত করেছে (আল-ক্বছাছ, ২৮/২৬)। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিক যেহেতু দুর্বল থাকে এবং অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়, তাই তার অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম বেশি কঠোর ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি শ্রমিকের অধিকার রক্ষার ফযীলত ও মাহাত্ম্যের কথা ইসলামেই পাওয়া যায়। পাহাড়ের গুহায় আটকা পড়া তিন ব্যক্তির এক ব্যক্তি শ্রমিকের অধিকার রক্ষা করার কারণে আল্লাহ তাদেরকে কী পুরস্কর দিয়েছিলেন (বুখারী, হা/২২৭২), তা আমাদের সকলের জানা। এটা কি ইসলামে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার রক্ষার মাহাত্ম্য প্রমাণ করে না? শ্রমিকদের সাথে মানবিক ও কোমল আচরণ, তাদের প্রতি দয়া ও হৃদ্যতা প্রদর্শনের সাথে সাথে তাদের অধিকার কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ইসলাম তাগিদ দিয়েছে। তাদের উপর সাধ্যের বাইরে কাজ চাপাতেও ইসলাম নিষেধ করেছে। কর্মঘণ্টা নির্ধারণও উক্ত নীতির আওতায় পড়ে। অধিকার তো দূরের কথা, এমনকি ইসলাম শ্রমিক ও মালিককে ভ্রাতৃত্বের ডোরে বেঁধেছে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন, সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে খায়, সে কাপড় পরায়, যা সে পরে। তাকে সামর্থ্যের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে’ (বুখারী, হা/৩০)।
শ্রমিকের আরো যেসব অধিকারের কথা ইসলাম বলেছে: (১) মালের অধিকার: একজন শ্রমিকের এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এটা দুইভাবে হতে পারে: ক. সময়মতো মজুরি পরিশোধ করে। এ প্রসঙ্গে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তোমরা তার মজুরি দিয়ে দাও’ (ইবনু মাজাহ, হা/২৪৪৩)। খ. ন্যায্য মজুরি পরিশোধ করে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। ...আর একজন সে ব্যক্তি, যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে তার থেকে কাজ বুঝে নেয়, অথচ তার মজুরি দেয় না’ (বুখারী/২২২৭)। নির্ধারিত মজুরির সামান্যতম কম করলে জান্নাত হারাম ও জাহান্নাম অবধারিত হওয়ার ঘোষণা ইসলামে এসেছে (মুসলিম, হা/১৩৭)। (২) স্বাস্থ্যের অধিকার: শ্রমিককে এমন কাজে বাধ্য করা যাবে না, যেখানে তার স্বাস্থ্যের ঝুঁকি রয়েছে। মূসা আলাইহিস সালাম-কে কাজে নিয়োগের সময় শুআইব আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না’ (আল-ক্বছাছ, ২৮/২৭)। এমন কাজে বাধ্য করলে শ্রমিক চুক্তি বাতিল করতে পারে। (৩) সম্মানের অধিকার: ইসলাম শ্রমিককে তার যথার্থ মর্যাদা দিয়েছে। প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার খাদেমকে পর্যন্ত কোনো দিন ধমক তো দেননি; এমনকি কেন করেছো? কেন করোনি?- এরকম কথাও বলেননি (বুখারী, হা/৬০৩৮)। কোনো মুসলিমের সম্মানে আঘাত হানাকে ইসলাম হারাম করেছে (মুসলিম, হা/২৫৬৪)। আদমসন্তান হিসেবে সকলের সম্মানের ব্যাপারটা তো রয়েছেই (আল-ইসরা, ১৭/৭০)। (৪) ইবাদতের অধিকার: শ্রমিককে আল্লাহর ফরযকৃত ইবাদত আদায়ের সুযোগ দেওয়া ইসলামের নীতি; অন্যথায় মালিক দিকভ্রান্ত বলে বিবেচিত হবে (ইবরাহীম, ১৪/৩)। (৫) বিচারের অধিকার: এক পক্ষ যুলম করবে আরেক পক্ষ মাযলূম হবে- এটা হতে পারে না। সেজন্য একজন শ্রমিক তার উপর অন্যায়ের বিচার দাবির অধিকার রাখে। কারণ ইসলামে যাবতীয় যুলম হারাম (মুসলিম, হা/২৫৭৭)।
এভাবে সবদিক থেকে ইসলাম শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করেছে। অতএব, শ্রমনীতিসহ সবকিছুতে ফিরে আসতে হবে ইসলামেই। তাহলেই শান্তি, তাহলেই মুক্তি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন।