اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যার মূল শিকড় ইউরোপীয় উপনিবেশ। ফিলিস্তীন-ইসরাঈল সংঘাত থেকে শুরু করে কাশ্মীর-ভারত বিরোধ, ভারতীয় মুসলিমদের বঞ্চনা, রোহিঙ্গা-মায়ানমার সংকট এবং আফ্রিকান মুসলিমদের উপর চলমান নির্যাতন—এসব সবকিছুর উৎসই উপনিবেশ। আজও মুসলিমদের জীবনধারায় সেই ঔপনিবেশিক ছায়া স্পষ্ট।
যেমন ফেরাউনের যুগের দীর্ঘ দাসত্ব ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব আলাইহিমুস সালাম-এর সন্তান বনি ইসরাঈলের স্বভাব-চরিত্রকে বদলে দিয়ে তাদেরকে এক আত্মবিশ্বাসী জাতি থেকে পরিণত করেছিল আত্মগ্লানিতে ভোগা, দাসত্বপুষ্ট এক জনগোষ্ঠীতে—ঠিক তেমনিভাবে ইউরোপীয় উপনিবেশও মুসলিমদের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্যকে ভেঙে দিয়েছে। মিথ্যা, দুর্নীতি, বিশ্বাসভঙ্গ ও দায়িত্বের খেয়ানত আজ আমাদের সমাজে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে মুসলিম সমাজে সহজেই বিভক্তি সৃষ্টি করা যায়, কারণ অনেকেই ক্ষমতার লোভে বা টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যায়। এটাই গোলামের মানসিকতা—যার একটি স্পষ্ট উদাহরণ আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশ।
আফ্রিকা একটি খনিজ-সমৃদ্ধ মহাদেশ। বিশ্বের মোট স্বর্ণের প্রায় ২০–২৫% আফ্রিকা সরবরাহ করে। হীরার ক্ষেত্রে এই হার ৬০–৭০%, প্লাটিনামের ৮০% আসে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। কঙ্গোতে উৎপাদিত হয় কোল্টানের ৬০–৭০%, যা আধুনিক ইলেকট্রনিক্স, বিশেষ করে স্মার্টফোন তৈরিতে অপরিহার্য। এছাড়াও বিশ্বের বক্সাইটের ২০–২৫% আসে আফ্রিকা থেকে, যা অ্যালুমিনিয়ামের মূল কাঁচামাল। এত সমৃদ্ধ একটি মহাদেশ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপীয় শক্তির দ্বারা শোষিত হয়েছে—প্রকাশ্যেও, আবার ছদ্মবেশেও। ইউরোপ আফ্রিকার সম্পদে আলোকিত, অথচ আফ্রিকা আজও অন্ধকারে। এটি আধুনিক যুগের অন্যতম নির্মম বাস্তবতা।
আফ্রিকায় উপনিবেশ শুরু হয় ১৬২৪ সালে সেনেগালের উপকূলীয় অঞ্চলে ফরাসিদের বাণিজ্য কার্যক্রমের মাধ্যমে—যেমনটা উপমহাদেশেও হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে। ভারতীয় মুসলিমদের মতো আফ্রিকার মুসলিমরাও ফ্রান্স, ব্রিটেন ও ইতালির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন জিহাদ করেছেন। যেমন আমাদের ছিল তিতুমীর বা শাহ ইসমাইলের মতো বীর, তেমনি তাদেরও ছিল উপনিবেশবিরোধী জিহাদে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্ববর্গের ইতিহাস যেমন, মরু-সিংহ উমার আল-মুখতার, হাজী উমার আল-ফুতি, সামোরি তুরে রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তির পরাজয়ের পর তারা বাধ্য হয় উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা দিতে। আমরা যেমন ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করি, আফ্রিকার অনেক দেশও ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে স্বাধীনতা পায়। তবে সেই স্বাধীনতা ছিল শর্তযুক্ত সীমিত স্বাধীনতা। বিশেষ করে ফ্রান্স যেসব শর্ত আরোপ করেছিল, তা ছিল একরকম আধুনিক ঔপনিবেশিকতা।
ফ্রান্স ‘Françafrique’ নামে একটি প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করে এবং প্রায় ১৪টি আফ্রিকান দেশকে এর আওতায় নিয়ে আসে। এই দেশগুলোর জন্য ফ্রান্সের প্রদত্ত শর্তগুলোর মধ্যে ছিল:
(১) ফ্রান্সের তৈরি রাযিয়াল্লাহু আনহুFছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফ্রাঙ্ক মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে, যার মান নির্ধারণ করবে ফ্রান্স ইউরোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে।
(২) ঔপনিবেশিক সময়ের তথাকথিত উন্নয়নের জন্য দেশগুলোকে কর দিতে হবে।
(৩) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮০% রিজার্ভ ফ্রান্সে রাখতে হবে, যার মধ্যে বছরে মাত্র ১৫% ব্যবহারের অনুমতি থাকবে। অতিরিক্ত দরকার হলে সেই টাকায় ঋণ নিতে হবে, যার সীমা সর্বোচ্চ ২০%।
(৪) দেশের খনিজ সম্পদ উত্তোলনে ফ্রান্স পাবে অগ্রাধিকার।
(৫) সরকারি টেন্ডারগুলোতে ফরাসি কোম্পানিগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
(৬) প্রতিরক্ষা ও সামরিক সহযোগিতা কেবল ফ্রান্সের মাধ্যমেই নিতে হবে—অস্ত্র কেনা বা প্রশিক্ষণ অন্য কোনো দেশ থেকে নেওয়া যাবে না।
(৭) ফরাসি ভাষাকে করতে হবে রাষ্ট্রভাষা।
(৮) শিক্ষা কারিকুলাম নির্ধারণ করবে ফ্রান্স।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ভারতের সাথে কাছাকাছি এরকম সাত দফা চুক্তি হয়েছিল।
টোগো, মালি ও গিনি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করায় ফ্রান্স তাদের কঠোর শাস্তি দেয়। গিনিকে পরিণত করে ধ্বংসস্তূপে, আর টোগো ও মালির প্রেসিডেন্টদের হত্যা করা হয়। যেহেতু ফরাসি সেনা প্রশিক্ষণে তৈরি এই দেশগুলোর সেনাবাহিনী মূলত ফ্রান্সের অনুগত, তাই অভ্যুত্থান ঘটানো তাদের পক্ষে সহজ। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে সেনাবাহিনী নিজেদের দেশের বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়। গত ৫০ বছরে আফ্রিকার ২৬টি দেশে ৭০টিরও বেশি সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আফ্রিকাকে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সিরিয়া ও আফগানিস্তানের মুজাহিদদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে, তেমনি এই যুদ্ধের উপকার এখন আফ্রিকার মুসলিম বিদ্রোহীরাও পাচ্ছে। কারণ ফ্রান্স এখন ইউক্রেনকে সহযোগিতা করতে গিয়ে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যয়েই হিমশিম খাচ্ছে। এই সুযোগে মালি, নাইজার ও বুরকিনা ফাসোতে দেশপ্রেমিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নেতৃত্বের নাম ইবরাহীম ত্রাওরে। তিনি পশ্চিমা মিডিয়া, IMF, Wরাযিয়াল্লাহু আনহুমারাহিমাহুমুল্লাহ—এসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। তাদেরকে তিনি অভিহিত করেন মিথ্যাবাদী, স্বার্থান্বেষী এবং বিশ্বব্যবস্থার দাসত্ব প্রতিষ্ঠাকারী শক্তি হিসেবে।
ত্রাওরে বুরকিনা ফাসোর জন্য নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছেন, দেশের সোনা খনি জাতীয়করণ করেছেন এবং সাহেল নামে একটি নতুন জোট গঠন করেছেন ‘Alliance of Sahel States (AES)’। সাহারা মরুভূমি ও সবুজ ভূমির সংযোগস্থলকে সাহেল বলা হয়। এই জোট প্রকাশ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তাদের অন্যতম মূলনীতি— দেশের খনিজ দেশের মানুষের জন্য ব্যয় হবে।
তবে চ্যালেঞ্জ হলো, কোনো বিপ্লব যদি আদর্শ ও নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে তা টিকে থাকে না। ইসলামের চেয়ে আদর্শগতভাবে পরিপূর্ণ ও মানবকল্যাণমুখী কোনো সিস্টেম পৃথিবীতে নেই। ইবরাহীম ত্রাওরে সরাসরি ইসলামবিরোধী না হলেও, ইসলামকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চান না। উপনিবেশ মুসলিমদের মধ্যে এমন এক হীনম্মন্যতা ঢুকিয়ে দিয়েছে, যার কারণে আজ অনেক মুসলিম বিপ্লবীও মনে করেন—ইসলামের নাম নিলে তিনি সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তাই তারা ইসলামকে ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ রাখেন এবং রাষ্ট্রপর্যায়ে দাসত্ব বজায় রাখেন। শুধু মনিব পরিবর্তন হয়, কাল ইউরোপের দাস আজ আমেরিকার দাস এবং আগামীকাল চীন-রাশিয়ার দাস। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, পশ্চিমাবিরোধী বিপ্লবী শক্তি নিজেরাও কোনো না কোনো ইসলামবিরোধী এজেন্ডার অংশ হয়ে পড়ে। যেমন ইবরাহীম ত্রাওরে ওয়াগনার বাহিনীর মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে মুসলিমদের ওপরই হামলা চালাচ্ছেন।
ইবরাহীম ত্রাওরের উত্থান উপনিবেশবিরোধী চেতনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঠিক আছে, কিন্তু এটি সমাধান নয়। মুসলিমদের একমাত্র মুক্তির পথ হলো ইসলাম। ইসলামের আদর্শের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে, হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে গর্বের সাথে ইসলামকে ধারণ করে ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। একমাত্র ইসলামই দিতে পারে সত্যিকার স্থায়ী মুক্তি। (প্র. স.)