اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিজমের অবসান হয় ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। উক্ত গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ছাত্র-জনতা ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মহানায়ক আবূ সাঈদ তার ফেসবুক টাইমলাইনে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফসহ আরও অনেক উলামায়ে কেরামের বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার দিয়েছেন। যেমন গত ২০শে মে একটি পোস্টে তিনি শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফের ‘অবৈধ সম্পর্ক’ বিষয়ক একটি ভিডিও শেয়ার দিয়ে লেখেন, ‘Allah maf koruk, jina theke mukto rakhuk!’. সুতরাং আমরা এ কথা জোর গলাতেই বলতে পারি শুধু ইসলামপন্থি জনগণ নয়, বরং সালাফী ছাত্র-জনতারও ব্যাপক ভূমিকা ছিল উক্ত পটপরিবর্তনে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ছাত্র-জনতার বিজয়ের সকল ক্রেডিট কিছু বাম ও এনজিওরা নিজেদের ঘরে নিয়ে গেছে। বিভিন্ন মাস্টার মাইন্ডের গল্প ফেঁদে বিশাল এই অর্জনকে একপেশে করে ফেলা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে ইসলামপন্থি জনগণের প্রতি বিরূপ আচরণ ধর্মপ্রাণ জনগণকে হতাশা করেছে। বিশেষ করে শিক্ষা সংস্কার কমিটিতে চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী দুজন ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং ইসলাম শিক্ষা বই প্রণয়নে কুখ্যাত হাদীছ অস্বীকারকারীকে দায়িত্ব প্রদান করা অন্যতম। পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কোনো আলেমকে সংস্কার কমিটিতে না রাখা। উক্ত বিষয়গুলো থেকে তৈরি হওয়া হতাশা ইসলামদরদি মানুষদেরকে ইসলামের সামগ্রিক বিজয় নিয়ে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। কীভাবে কোন পদ্ধতিতে ইসলামের সামগ্রিক বিজয় সম্ভব, সে বিষয়ে জনমনে বিভিন্ন প্রশ্ন ও ধোঁয়াশা বিরাজমান।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামের রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন হচ্ছে খেলাফত। ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যবাদিতার উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা হচ্ছে খেলাফত। যেখানে মানুষের ছয়টি মৌলিক অধিকার— অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও সম্মান সুরক্ষিত-সুনিশ্চিত। ন্যায় ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এখানে সূদভিত্তিক গোলাম বানানোর যালেম অর্থনীতি নিষিদ্ধ। এখানে অর্থনীতিতে মানুষের সমতা ও ব্যক্তিমালিকানার মধ্যে এমনভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে যা কলমের ভাষায় ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। ইসলামী খেলাফতে নেতৃত্ব নির্ধারণের ব্যবস্থাও বর্তমান বিশ্বের যে-কোনো ইলেকশন সিস্টেমের চেয়ে শতভাগ টেকসই, অর্থ সাশ্রয়ী ও দ্বন্দ্ব নিরসনকারী। যেখানে নেতৃত্ব নিয়ে গ্রুপিং তৈরি হওয়ার সুযোগ নাই। সেই গ্রপিংকে কাজে লাগিয়ে চরিত্রহননের ও সম্মানহানির অযাচিত চর্চা নাই। যোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত পরামর্শ সভার মাধ্যমে প্রার্থীবিহীন গোপন ব্যালটে নেতা নির্ধারণের অতি সাশ্রয়ী ও কালক্ষেপণমুক্ত পদ্ধতিই হচ্ছে খেলাফতে নেতৃত্ব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতার সরিষা সমপরিমাণ স্থান ইসলামের বিচারব্যবস্থায় নাই। ফলত দ্রুত ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সমাজে দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, খেলাফত আসবে কীভাবে? শতধা বিভক্ত মুসলিম জনতার কেউ মনে করছেন গণতান্ত্রিক ভোটের মাধ্যমে তারা ইসলামকে বিজয়ী করবেন। আবার কেউ ভাবছেন অস্ত্র বিপ্লবই একমাত্র সমাধান। আবার কেউ শুধু দাওয়াতী কাজের মধ্যেই সবকিছুকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। মূলত, আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠাই একমাত্র সফলতা বিষয়টি কখনোই এমন নয়; বহু নবী রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ছাড়াই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। প্রকৃত মুমিনের একমাত্র সফলতা হচ্ছে জান্নাতে যাওয়া। তবে হ্যাঁ, ইসলামের সামগ্রিক বিজয় এবং ইসলামের সার্বজনীন কল্যাণকামিতা রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন। আমরা মনে করি তাঁর জীবনীই আমাদের জন্য জ্বলন্ত নিদর্শন ও সকল দিকনির্দেশনা গ্রহণের জন্য একমাত্র উদাহরণ। পৃথিবীর সকল তন্ত্র-মন্ত্রের চেয়ে তার সীরাতই আমাদের জন্য প্রকৃত পথ প্রদর্শনকারী। আমরা যদি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনীকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করি তাহলে ইসলামের সামগ্রিক বিজয়ের জন্য কয়েকটি বিষয় অতি জরুরী কর্তব্য হিসেবে দেখতে পাব। যথা—
ব্যাপক দাওয়াতী কাজ করা: সকল নবীকে মহান আল্লাহ প্রাথমিক যে দায়িত্বটি প্রদান করেছিলেন তা হচ্ছে দাওয়াতী কাজ করা। দাওয়াতী কাজ করার ক্ষেত্রে তারা সবসময় নিজ সময়ের শক্তিশালী রাজা-বাদশাহ বা সমাজপতিদের দিয়ে শুরু করতেন। যেমন মূসা আলাইহিস সালাম দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেছেন ফেরাউনকে দিয়ে। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতী কাজ শুরু করেছেন কুরাইশ বংশের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে একত্রিত করার মাধ্যমে। পাশাপাশি নবীগণের দাওয়াতী কাজের অন্যতম স্ট্র্যাটেজি ছিল তাওহীদের দাওয়াতের মাধ্যমে দাওয়াত আরম্ভ করা এবং কোনো প্রকার কম্প্রোমাইজ না করা। তারা কখনোই আদর্শে ছাড় দিয়ে চুক্তিবদ্ধ বা জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করেননি। সুতরাং মৃত্যু না আসা পর্যন্ত দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে হবে। চূড়ান্ত সফলতা মহান আল্লাহর হাতে।
সমাজ ও দেশের সাথে সম্পৃক্ত থাকা: নবীগণকে মহান আল্লাহ শুধু দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে তৈরি করেননি; বরং নেতৃত্বের সকল যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে সকল নবীরই রাষ্ট্রনেতা ও সমাজনেতা হওয়ার যোগ্যতা ছিল এবং নবীদের মধ্যে যাদেরকে রাষ্ট্রনেতা হওয়ার তাওফীক্ব দান করেছিলেন তারা তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় শতভাগ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। নবীগণ গবেষক বা লেখক ছিলেন না; তারা মূলত ছিলেন সমাজসেবক ও মানবসেবক। তারা জন্মগত সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ হওয়ার অনন্য গুণে গুণান্বিত ছিলেন। মহান আল্লাহর ইবাদত ব্যতীত বাকী সময়টুকু তারা মানুষের পিছনে ব্যয় করতেন। তাদের উন্নত চরিত্র ছিল তাদের দাওয়াতে প্রভাবিত হওয়ার অন্যতম মূল কারণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকের যুগে মুসলিমরা ইসলামকে শুধু মসজিদ ও মাদরাসার চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আলেম-উলামা সমাজ ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। ফলত ইসলামের সামগ্রিক চেহারা জনগণের সামনে ফুটিয়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরি করা: আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাজনীতি একটি ধোঁকা মাত্র। গণতন্ত্রের নামে কখনোই জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় না; বরং দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। গণতন্ত্রের নামে অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী ধনতন্ত্র তৈরি হয়। যার মাধ্যমে কর্পোরেট গোলামীর জিঞ্জিরে মানুষ আবদ্ধ হয়ে যায়। আর এটিই আধুনিক দাসত্ব। অন্যদিকে ব্যক্তি ও পরিবার জীবনে লিবারেলিজম-এর নামে অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা চর্চা করতে গিয়ে মানুষ শয়তানের গোলামে পরিণত হয়ে যায়। যার অন্যতম জ্বলন্ত উদাহরণ এল.জি.বি.টি.কিউ এবং ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু। ফলত গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়া আকাশকুসুম কল্পনার শামিল। এই গণতন্ত্রের বেড়াজালের মধ্যেও ইয়াহূদীরা নিজেদের স্বতন্ত্রতা ধরে রেখেছে শক্তিশালী মিডিয়া ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আমরা মুসলিমরা এই জায়গায় পিছিয়ে আছি। আমরা গণতন্ত্রের ধোঁকায় পতিত হয়ে ভোটের রাজনীতিতে আমাদের সকল পণ্ডশ্রম ব্যয় করে যাচ্ছি। আমাদের জন্য জরুরী ভিত্তিতে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নাই।
রাজনীতি সচেতন থাকা: গণতন্ত্রের রাজনীতি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে ভোটে অংশগ্রহণ পরিত্যাগ করার অর্থ এই নয় যে, রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাওয়া। আমাদের অনেকেই এতটাই রাজনীতি অসচেতন যে, তারা সমাজে তাদের অবস্থান ও অস্তিত্ব জানান দেওয়া থেকেও নিজেদেরকে বিরত রেখেছেন, যা কখনোই ইসলামসম্মত হতে পারে না। আমাদেরকে অবশ্যই সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা প্রদান করতে হবে। আর এটিই উম্মাতে মুসলিমার সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। অতএব, সরাসরি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না থাকলেও আমরা কখনোই সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়া বন্ধ করব না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রীয় সকল সৎকাজে সহযোগিতা করা এবং রাষ্ট্রীয় সকল অসৎকাজে সাধ্য অনুযায়ী প্রতিবাদ ও বাধা প্রদান করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।
উপরের বিষয়গুলো আমরা আমাদের জায়গা থেকে সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে করতে পারলে মহান আল্লাহ চাইলে আমাদের সামগ্রিক বিজয় দান করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা ঈমান আনয়ন করে ও সৎ আমল করে তাদের জন্য মহান আল্লাহর ওয়াদা হচ্ছে, অবশ্য অবশ্যই তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবেন যেমন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং মনোনীত দ্বীন ইসলামকে পৃথিবীতে শক্তিশালী করবেন। আর ভীতির পরিবর্তে নিরাপত্তা প্রতিস্থাপিত করবেন’ (আন-নূর, ২৪/৫৫)।
আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন এবং সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন! (প্র. স.)