কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনে রামাযানের শিক্ষা কতটা ফলদায়ক?

post title will place here

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ

মমতাময় আদর্শে ঘেরা, গ্রামীণ জীবনের পবিত্র ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ একসাথে মিলেমিশে থাকার গ্রামীণ দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। ছোট্ট শিশুদের মাঠে-ঘাটে গোবর, শস্য ও কালবৈশাখী ঝড়ে আম কুড়ানোর দৃশ্য এখন আর নাই। আর্থ উপার্জনের জন্য খুব সকালে কাজের উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের বেরিয়ে যাওয়া আর হয় না। অথচ আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মাতকে ভোরে বরকত ও প্রাচুর্য দান করো’ (আবূ দাঊদ, হা/২৬০৬)। পঞ্চায়েত প্রথার নির্মল স্বচ্ছ মমতাময়ী সামাজিক বন্ধন এখন অনুপস্থিত। দ্বন্দ্ব-কলহের সমাধানে গ্রাম্য বিচারব্যবস্থা এখন উঠে গেছে। নৈতিক আদর্শ ধরে রাখার দৃশ্য এখন প্রায় অনুপস্থিত। যদিও গ্রাম্য প্রথার বাঁকে বাঁকে নির্যাতনের চিত্র বিদ্যমান ছিল।

একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের মানুষের পারস্পারিক ও সামাজিক বন্ধন এমন গভীর ছিল যে, কোনো একজন মানুষ আহত বা বিপদগ্রস্ত হলে, সবাই তাকে সাহায্যের জন্য ছুটে যেত, কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নাই। এখন পাশের বাসার মানুষটির মৃত্যু হলেও কোনো খবর রাখা হয় না। অথচ আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইকে সাহায্য করবে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন’ (মুসলিম, হা/২৫৮০)। গাছের ফল, জমির ফসল, বাড়ির উঠানে বেড়ে উঠা শাকসবজি প্রতিবেশী, পথিক ও অসহায়কে অকাতরে বিতরণ করা হতো। কারণ, সে সমাজে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, ‘যে কোনো মুসলিম যখন কোনো গাছ লাগায় অথবা ফসল বোনে অতঃপর তা হতে কোনো পাখি, মানুষ অথবা পশু (তার ফল ইত্যাদি) খায়, তখন ঐ খাওয়া ফল-ফসল তার জন্য ছাদাক্বাস্বরূপ হয়’ (মুসলিম, হা/১৫৫৩) —এর শিক্ষা বাস্তবায়ন হতো।

এলাকার স্বার্থে, মানুষের কল্যাণে, দেশের সেবায় কাজ করা হতো। কবর খনন, রাস্তা মেরামত, অসহায় পরিবারকে সাহায্য ইত্যাদি কাজের কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হতো না। কারণ, এগুলোকে মহৎ কাজ মনে করা হতো। জীবনের পরবর্তী পর্যায়গুলো আরও সুন্দর, মধুর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ার ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক ফলাফল আছে। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা আমাকে দুর্বলদের মধ্যে খোঁজো। কেননা তোমরা তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে রিযিক্ব ও সাহায্য পেয়ে থাকো’ (আবূ দাঊদ, হা/২৫৯৪)। কিন্তু এই আদর্শের বাস্তবায়ন বর্তমান সমাজে নাই।

ছেলেমেয়ে কিশোর বয়সেই পরিবারকে সাহায্য করত। জমি চাষ, গবাদিপশু পালন, মাছ শিকার ইত্যাদি কাজ করে তারা পরিবারিক সচ্ছলতায় অবদান রাখত। কারণ, অর্থ উপার্জনের প্রতি উপদেশ দিয়ে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মানুষ নিজ হাতের যে উপার্জন খায় তার চেয়ে উত্তম কোনো খাদ্য হতে পারে না’ (বুখার‌ী, হা/২০৭২)। কিন্তু বর্তমানে তারা বাবার কষ্টে উপার্জিত টাকায় ক্রয়কৃত স্মার্টফোনে টিকটক দেখে। লেখাপড়ার পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে। আগে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ছিল রক্ষণশীল। ধর্মীয় আদর্শ ও পারিবারিক কঠোর বাধ্যবাধকতায় জীবন ছিল নিয়ন্ত্রিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মক্তব, যানবহন ও আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে নারী-পুরুষের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় ছিল। সমাজের প্রত্যেক সদস্যের উপর পরিবারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। পরিবারে সেই রক্ষণশীলতা এখন আর নাই। অথচ আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দাইয়ুছ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। দাইয়ুছ ঐ ব্যক্তি যে তার পরিবারে পাপ সংঘটিত হতে সাহায্য করে’ (নাসাঈ, হা/২৫৬১)

পারিবারিক জীবনে সচ্ছলতা লাভে মানুষের চেষ্টা সর্বদা চলমান। স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের জন্য তার সংগ্রাম অব্যাহত। এভাবে একসময় সে ধর্মীয় আদর্শকে এড়িয়ে যায়। ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণের গণ্ডি থেকে সে ধীরে ধীরে বের হতে থাকে। সুখী জীবনের অলীক স্বপ্নে সে পরকালকে ভুলে যায়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে সে সুখের ভিত্তি মনে করে। অর্থ উপার্জনের প্রচণ্ড নেশায় সে প্রবাসে পাড়ি জমায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী’ (আল-আ‘লা, ৮৭/১৬-১৭)। কিন্তু সেখানে আল্লাহভীতি কিংবা লোকলজ্জা কোনোটাই তাকে পতিতালয়ে গমন বা অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক থেকে বাধা দেয় না। এমনকি একান্ত নির্জনে যৌনক্ষুধা মিটাতে হারাম পথ অবলম্বন থেকে সে বিরত থাকে না। অপরদিকে তার বিবাহিত স্ত্রীও প্রতিবেশী কিংবা পরপুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জাড়িয়ে পড়ে। ফলে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক থাকার কথা, যেখানে সত্য ও আবেগের প্রচণ্ড প্রভাব থাকার কথা, যেখানে দুজনের মমত্ববোধ আরো গভীর হওয়ার কথা, সেখানে অবিশ্বাস আর প্রতারণার দানা বাঁধে। এভাবে অর্থসম্পদের প্রচণ্ড লোভ আর ধর্মহীনতা একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়।

একটা সময় এমন ছিল, যেখানেই অন্যায় হতো সেখানেই একজন যুবকের প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত হতো, কিন্তু বর্তমানে সেটা আর হয় না। যেখানে তার সত্যের পেছনে ছোটার কথা, সেখানে সে এখন নীরব দর্শক। যেখানে তার অন্যায়কে প্রতিহত করার কথা, সেখানে সে নিশ্চুপ। যেখানে তার মন ও চেতনায় প্রতিবাদের ঝড় থাকার কথা, সেখানে সে ভীতু ও সন্ত্রস্ত। তাকে প্রতিবাদের কথা বলা হলে, সে সমাজের এমন চিত্রকে স্বাভাবিক মনে করে।

কোন অজানা ভীতি তার এ চেতনাকে ধ্বংস করে দিল! কোন শক্তি তার এ ইলাহীকে আদর্শকে বিলীন করে দিল! কোন অদৃশ্য শক্তি ‘মিথ্যা বলা চরম অপরাধ’ তার এমন বোধকে স্তিমিত করে দিল! যে তরুণ বা তরুণী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে তার সততা ও চারিত্রিক নিদর্শন মনে করত, কোথায় গেল তার এ চেতনা?

এখন সমাজে জনপ্রতিনিধিকে যা কিছু করতে দেখা যায়, তার বেশির ভাগই লোক দেখানো। সে বলে, সে সবকিছু মানুষের কল্যাণের জন্য করে, কিন্তু সে স্বার্থ ছাড়া কিছুই করে না। কারণ, জনগণের উপর প্রভাব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তাকে এসব করতে হয়। ক্ষমতা প্রদর্শন এবং নিজের অন্যায়কে আড়াল করা থাকে এর পিছনের উদ্দেশ্য।

মাহে রামাযানের শিক্ষা ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা। ছিয়াম সাধনা করে ধৈর্য ও আত্মসংযমের শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকে এ মাসে। খাদ্য গ্রহণের আবাধ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার শিক্ষা হয় এ মাসে। ফলে অসহায় ও দুঃখী মানুষের কষ্ট অনুভব করা যায়। সৃষ্টি জীবের প্রতি দয়া, উদারতা ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সমাজ চিত্র ভিন্ন। একজন মানুষের যেখানে মানবিক হওয়ার কথা, যেখানে ক্রেতার প্রতি উদার হওয়ার কথা, যেখানে সাধারণের প্রতি মানবিক হওয়ার কথা, সেখানে সে তাদের উপর কঠোর হয়, অর্থ আয়ের নানান কৌশল অবলম্বন করে এবং তার অপরাধপ্রবণতা আরও বেড়ে যায়।

রামাযান আসে আমাদের নিকট রহমত, বরকত ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে। জীবন পরিবর্তনের বিশাল সুযোগ নিয়ে। নিজেকে বদলিয়ে ফেলার অফুরন্ত উপায় নিয়ে। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ইত্যাদি নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তার ব্যাপক আয়োজন নিয়ে। আমাদের অবশ্যই ছিয়াম সাধনা করে ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত হবে। পোশাক কেনার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে অসহায়-দরিদ্র মানুষের সহায়তায় অর্থ ব্যয় করবে। দামী খাদ্য খাওয়ার অভ্যস ত্যাগ করে মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা ও আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয়ে করতে হবে। রামাযান মাস উপলক্ষ্যে অতি মুনাফা অর্জনের পথ বর্জন করে উদারতা ও মানবিকতার পথ অবলম্বন করতে হবে। এমন যদি করতে না পারা যায় তবে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে আমি তোমাদের পরিবর্তে নিয়ে আসব অন্য এক সম্প্রদায়। অতঃপর তারা তোমাদের মতো হবে না’ (মুহাম্মাদ, ৪৭/৩৮)। 

হে আল্লাহ! তুমি আমাদের দেশের সর্বস্তরের মানুষকে তাদের জীবনের পরিণাম সম্পর্কে ভাববার তাওফীক্ব দান করো। প্রত্যেকের জীবনের কিছু সময় মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার সুযোগ করে দাও। প্রত্যেকেই রামাযানের কল্যাণ সমানভাবে উপভোগ করার ক্ষমতা দান করো। প্রত্যেককে সমালোচনা, অন্যায়, অবিচার ও হারাম উপার্জন ইত্যাদি থেকে বিরত রাখো। অন্যের দোষ না খুঁজে নিজের দোষ খোঁজার ক্ষমতা দান করো। অন্যের পেছনে না লেগে আয়নায় নিজের পাপগুলো দেখে বিরত থাকার ক্ষমতা দান করো। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের অহেতুক সমালোচনা থেকে রক্ষা করো। চারিত্রিক উৎকর্ষতা আর মহানুভবতার উদার শিক্ষা লাভে আমাদের ধন্য করো। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে অহংকার ও অহমিকার পথ বর্জন করে সত্য পথে আসার সক্ষমতা দান করো। আমীন! (স.)

Magazine