اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
মানবাধিকার বলতে মানুষের অধিকারকে বোঝানো হয়। মানুষ যেহেতু বুদ্ধিমান প্রাণী সেহেতু সে জন্মগতভাবেই অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জন্ম নিয়ে থাকে। সমগ্র পৃথিবীর সকল কিছুকে আল্লাহ তাআলা মানুষের সেবার জন্য অধীন করেছেন। মানুষকে ফেরেশতাদের দিয়ে সিজদা করিয়ে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। মানুষের অধিকার ও সম্মান দিতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে এবং মানুষের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পণ্যে পরিণত করা হারাম করেছেন। শুধু তাই নয়, চলমান বিশ্বব্যবস্থা প্রদত্ত পাঁচটি মৌলিক অধিকার ছাড়াও একমাত্র ইসলাম মানুষের সম্মানকে অন্যতম মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করেছে। কেউ কোনো মানুষের গীবত-অপবাদ দিতে পারবে না। কোনো মানুষের বিষয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে পারবে না। মানুষকে অপছন্দনীয় নামে ডাকতে পারবে না। ইসলামের সর্বোচ্চ নিদর্শন আল্লাহর ঘর পবিত্র কা‘বা ধ্বংস করার সাথে মানুষের জান, মাল ও সম্মানহানি করার গুনাহের তুলনা করা হয়েছে।
ইসলামের প্রতিটি হালাল-হারাম ও ফরয-সুন্নাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবনের হেফাযত। সকল হালাল হারাম হয়ে যেতে পারে এবং সকল হারাম হালাল হয়ে যেতে পারে শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য। আল্লাহ তাআলা যেহেতু ন্যায়পরায়ণ ও সত্যবাদী সত্তা, এইজন্য তাঁর কাছে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নাই। সকলই এক পিতা এক মাতা আদম ও হাওয়ার সন্তান। সবাই তাঁর বান্দা। কালো, সাদা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সকল মানবাধিকার তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। তিনি মহাজ্ঞানী, অত্যন্ত ধৈর্যশীল, অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তাঁর জ্ঞানের কারণে তাঁর বিধান উপযুক্ত। তাঁর ধৈর্যের কারণে দ্রুত শাস্তি নাই। সাক্ষী-প্রমাণ পেশ করা সাপেক্ষে যৌক্তিক শাস্তি। তাঁর শাস্তি কখনোই শুধু শাস্তি নয়; তাঁর শাস্তি মূলত ন্যায়। তথা অন্য মানুষকে ন্যায়বিচার দেওয়ার স্বার্থে শাস্তির বিধান দিতে হয়েছে। শাস্তির লক্ষ্য পৃথিবীতে শান্তি ও সুরক্ষা প্রতিষ্ঠা করা। অন্য মানুষের জান ও মালের হেফাযত করা। তাঁর আইনে কোনো বৈষম্য নাই। রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমারা সকলেই সমান। তাঁর প্রতিটি আদেশ তাঁর দয়া ও তাঁর কল্যাণকামিতা। আর তাঁর প্রতিটি নিষেধ মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচানো। এক কথায় আমরা বলতে পারি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবাধিকার ও সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ মানবাধিকার ইসলাম দিয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকে সেই ইসলাম ও মুসলিমদেরকে জাতিসংঘ মানবাধিকার শিখাচ্ছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ইউনিভার্সাল ডিকলারেশন অব হিউম্যান রাইটস (ইউডিএইচআর) ঘোষণা করে। যেই ঘোষণার অসংখ্য বিষয় মুসলিম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যেমন উক্ত ঘোষণায় পরিবার বা সমাজের বন্ধনকে গুরুত্ব না দিয়েই ব্যক্তিকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। যেমন ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি’র নামে বিকৃত যৌনাচারকে প্রমোট করা হয়েছে। ছেলে-মেয়ে জেন্ডার বা লিঙ্গ চেঞ্জ করতে পারবে। এটাই নাকি তার জেন্ডারের স্বাধীনতা। ছেলে হয়ে মেয়ের মতো সাজবে আর মেয়ে হয়ে ছেলের মতো সাজবে। এক কথায় ক্বওমে লূতের মতো নিম্ন শ্রেণির সকল বিকৃত মানসিকতার বৈধতা।
আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করে ছেলে-মেয়ের সম্পদ বণ্টন হবে সমানভাবে। যা কখনোই পারিবারিক, সামাজিক দায়িত্বের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে না। বরং সমান বণ্টনে ইসলামী সমাজব্যবস্থায় পুরুষ বৈষম্যের শিকার হবে। মহান আল্লাহর নিকটে বিধান প্রণয়নে কখনোই ছেলে বা মেয়ের অতিরিক্ত সুবিধা ধর্তব্য নয়। তিনি মহাজ্ঞানী, তিনি ভারসাম্য ও ন্যায়কে সামনে রেখে বিধান প্রণয়ন করে থাকেন। লিঙ্গ আলাদা হওয়ার পরও পিতা ও মাতা ছেলের সম্পত্তিতে সন্তান থাকলে সমানভাগে সম্পদ পেয়ে থাকেন। লিঙ্গ আলাদা হওয়ার পরও পিতার সম্পত্তিতে কন্যা তার চাচার চেয়ে বেশি অংশ পেয়ে থাকেন। সুতরাং আল্লাহর বিধানে লিঙ্গ ধর্তব্য নয়। মহান আল্লাহর সম্পত্তি বণ্টনে কয়েকটি বিষয়কে সামনে রাখা হয়েছে। মৃত ব্যক্তি থেকে কে কত নিকটে, স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে কার আগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কে পরিবারে কেমন দায়িত্ব পালন করে থাকে—এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে সবার প্রতি ন্যায় রক্ষা করে পরিবার ও সমাজের ভারসাম্য রেখে সম্পত্তি বণ্টনের বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।
অতএব উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, জাতিসংঘের মানবাধিকার বহু দিক থেকে আমাদের ধর্ম সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর স্ত্রীগণের নামে কটূক্তি করার অধিকারের নাম হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বা বাকস্বাধীনতা। কাদিয়ানীদের স্বীকৃতি হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার। পাহাড়ি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের জন্য আলাদা দেশের বৈধতা তৈরি করা হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার। এই কারণেই এখন পর্যন্ত সঊদী আরব এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি। সঊদী আরবসহ মুসলিম দেশগুলো জাতিসংঘের বিকল্প হিসেবে OIC-এর মাধ্যমে ১৯৯০ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে ‘Islamic Human Rights’ ঘোষণা করে। যার মূল প্রতিপাদ্য ছিলে- All human rights are subject to Islamic Shariah.
পরিশেষে বলতে চাই, যে জাতিসংঘ ফিলিস্তীনে ইসরাঈলের গণহত্যা বন্ধ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ, কাশ্মীরের মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ— তারা বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য কী করবে? জাতিসংঘের নিজের মধ্যেই তো ন্যূনতম গণতন্ত্র নাই। সেখানে পৃথিবীর সকল দেশের সিদ্ধান্তগ্রহণের নিজস্ব স্বাধীনতা নাই। পৃথিবীর সকল দেশ একত্রিত হয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিলেও তা জাতিসংঘের স্থায়ী কমিটির যেকোনো এক দেশের ভেটোতে বাতিল হয়ে যেতে পারে। সেই পাঁচটি দেশ হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি— আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স। জাতিসংঘে এই পাঁচ দেশের স্বৈরাচারী ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, খাদ্যকে মানবাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার এক প্রস্তাবে ২০২১ সালের নভেম্বর ভোটাভুটি হয়। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ একমত হলেও আমেরিকা ও ইসরাঈল বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। আমেরিকার ভেটোর কারণে ন্যূনতম সকল মানুষের জন্য খাদ্যকে মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। তাইতো তারা আজ বীরদর্পে গাযায় ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিয়ে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছে। যে জাতিসংঘ গাযার মানুষের ন্যূনতম খাবারের অধিকার দিতে পারে না, সেই জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস বাংলাদেশের মাটিতে জুলাইয়ের রক্তের উপর তৈরি হতে পারে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। বাংলার মুসলিম তাদের নিজস্ব শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বদ্ধপরিকর ইনশা-আল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানদের সুমতি দান করুন! (প্র. স.)